স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর যোদ্ধা শ্রমিক নেতা নূর আহমদ

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী | সোমবার , ৮ আগস্ট, ২০২২ at ৭:৫২ পূর্বাহ্ণ

আওয়ামী লীগ ও শ্রমিক লীগ-এ দুয়ের মাঝে নূর আহমদের পরিচয় আটকে গিয়েছিলো। তিনি প্রথমে শ্রমিক লীগ, পরে আওয়ামী লীগ করেছিলেন। কিন্তু পরেরটাই বড় হয়ে উঠেছিলো তাঁর জীবনে । তিনি অবশ্যই বড় শ্রমিক নেতা ছিলেন। কিন্তু অবধারিত রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাঁকে রাজনৈতিক নেতার আসনেই প্রতিষ্ঠা এনে দিয়েছিলো। স্বাধীনতার কিছু আগে থেকে তিনি এবং জামাল ভাই (এসএম জামালউদ্দিন) হাজারী গলির মুখে বিনোদা ভবনে শ্রমিক লীগের কর্মকাণ্ডে ভীষণ ব্যস্ত থাকলেও দু’জনই পরবর্তীকালে রাজনৈতিক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে আওয়ামী লীগ নেতা হিসেবে অধিকতর পরিচিতি লাভ করেন।
জনগণকে ছাত্র, যুবক, শ্রমিক, কৃষক ইত্যাদি অংশে বিভক্ত করে প্রত্যেক অংশের জন্য আলাদা আলাদা সংগঠন গড়ে তোলা-এটা কমিউনিস্ট পার্টির রীতি। আওয়ামী লীগ শ্রমিক লীগ নামে আলাদা সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে শ্রমিকদের নিয়ে রাজনীতি আরম্ভ করে ৬৯ সালে। কিন্তু চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে একথা খাটে না। কারণ চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও শহর আওয়ামী লীগের প্রথম সাধারণ সম্পাদক জহুর আহমদ চৌধুরী দেশভাগের পূর্বে তাঁর কলকাতার জীবন থেকে একজন ট্রেড ইউনিয়ন নেতা এবং দেশভাগের পর চট্টগ্রামে এসেও তিনি ট্রেড ইউনিয়নের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখেন। তিনি আওয়ামী রাজনীতি ও শ্রমিক রাজনীতি যুগপৎ চালিয়ে যান। জহুর আহমদ চৌধুরীর প্রভাবে শ্রমিক লীগ প্রতিষ্ঠার অনেক আগেই চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের মধ্যে কয়েকজন শ্রমিক নেতা দেখা দিয়েছিলেন। এদের মধ্যে জহুর আহমদ চৌধুরীর ঘোড়ার গাড়ি চালক ইউনিয়নের সেক্রেটারি আগ্রাবাদ মুহুরী পাড়ার ছিদ্দিক আহমদ, কাট্টলীর জামশেদ আহমদ চৌধুরী, বিটিসির মোহাম্মদ উল্লাহ, মুনাফ, সন্তোষ ও নিত্য বাবু প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। নূর আহমদও এদের দলে পড়েন। রহমতউল্লাহ চৌধুরীর নামও এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা মেতে পারে। নূর আহমদ মোহাম্মদ উল্লাহ ভূঁইয়ার মতোই বিটিসি কর্মচারী ইউনিয়নের নেতা ছিলেন। তিনি ১৯৬৫ সালে বিটিসি কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ৬৯-এ শ্রমিক লীগ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তিনি শ্রমিক লীগে চলে আসেন এবং শ্রমিক লীগের ধারায় ট্রেড ইউনিয়ন করতে থাকেন। তখন এম এ হান্নান একটা ফ্যাক্টর হিসেবে আবির্ভূত হন। হান্নান ছিলেন এমএ আজিজের বিশ্বস্ত সহচর এবং ৬৯-এর শ্রমিক লীগ গঠনের সময় তিনি চট্টগ্রামে শ্রমিক লীগের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তার আগেই আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তিনি জহুর আহমদ চৌধুরীর ধারা থেকে এম এ আজিজের ধারায় সরে আসেন।
বিশিষ্ট রাজনীতিক, ট্রেড ইউনিয়নিস্ট, স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চট্টগ্রামের রাজনৈতিক অঙ্গনে তাঁর একটা বিশেষ স্থান ছিলো। ১৯৩৬ সালে সীতাকুণ্ড উপজেলার ভাটিয়ারি ইউনিয়নের ইমামনগর গ্রামে তাঁর জন্ম। তাঁর পিতার নাম নজির আহমদ সারেং। তাঁর অধ্যয়নকালেই ফৌজদারহাটে পাকিস্তান টোবাকো কোম্পানি স্থাপিত হয়; সেখানে চাকরির সুযোগ উপস্থিত হলে তিনি বিলম্ব না করে সে চাকরিতে ঢুকে যান, প্রয়োজনও ছিলো পরিবারের জন্য উপার্জনের।
যেসব নেতা-কর্মীর জন্য আওয়ামী লীগ আজো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এবং যাঁরা আওয়ামী লীগের অহংকারের বস্তু ও গর্বের ধন, হীরেজহরৎ মণিমুক্তোর চেয়েও দামী, তাঁদের মধ্যে নূর আহমদ একজন। আওয়ামী লীগকে পাগলের ন্যায় ভালোবাসতেন, ষাটের দশকে এমন কিছু ‘আওয়ামী লীগ পাগল’ মানুষ দেখা দিয়েছিলেন; তাঁদেরকে যদি বলা হতো সারাদেশ একদিকে, শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগ অন্যদিকে, তুমি কোনটা নেবে? তারা বলতেন আমাকে মুজিব দাও, আমার জন্য আওয়ামী লীগই ভালো। নূর আহমদ এই দলেরই মানুষ, আওয়ামী লীগ-পাগল নেতা বা কর্মী। আওয়ামী লীগের জন্য হেন কাজ নেই যা তারা করতে পারতেন না, ঝগড়া, মারপিট, কিলাকিলি, ঘুষোঘুষি, লাঠালাঠি, কিছুতেই আপত্তি ছিলো না তাঁদের। তবুও আওয়ামী লীগ সই।
১৯৬৬ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি লালদিঘিতে বঙ্গবন্ধু ৬ দফা ঘোষণা করার পর থেকে নূর আহমদ একদিকে শ্রমিক সংগঠন অন্যদিকে শ্রমিকদের মধ্যে ছয় দফা প্রচার ও আওয়ামী লীগের প্রভাব বিস্তারের জন্য সর্বস্ব পণ করে নিজেকে ২৪ ঘণ্টা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত করেন।
রাজনীতি ক্ষেত্রে তিনি নবাগত ছিলেন না। ’৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের হয়ে নূর আহমদ সীতাকুণ্ডে কাজ করেছেন, সেই থেকে তিনি আওয়ামী লীগের সদস্য। লিপটন চা কোম্পানিতে চাকরি করার সময়েই তিনি শ্রম আন্দোলনে সর্বপ্রথম অংশগ্রহণ করেন আর প্রথমবার চাকরিও হারান তখন।
টোবাকোতে তিনি প্রথম ১৯৬২ সালে সহ-সম্পাদক ও ১৯৬৫ সালে সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন দীর্ঘ আট বছর; এই ইউনিয়ন নির্বাচিত সিবিএ হিসেবে কাজ করেছে।
ছয় দফা আন্দোলনের শুরুতে নূর আহমদের স্বাভাবিক সংগঠনজাত অভিজ্ঞতা কাজে লাগে। তার কাজের পরিধি বিস্তৃত হয়। ফৌজদারহাট থেকে সীতাকুণ্ডের প্রত্যন্ত এলাকা পর্যন্ত তার কর্মক্ষেত্রে পরিণত হয়। একই সঙ্গে তিনি তিন তিনটি কাজের দায়িত্ব নেন। আওয়ামী লীগ ও শ্রমিক লীগ সংগঠন ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠনেও তার অভিজ্ঞতা কাজে লাগে।
৭১-এর মার্চ মাসের অসহযোগ আন্দোলন পরিচালনা করতে করতে নূর আহমদ মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। তিনি হান্নান সাহেবের সঙ্গে হরিণাতেই অবস্থান নেন এবং সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় সীতাকুণ্ড, মিরসরাই ও ফটিকছড়ি থানার যুবকেরা ব্যাপক হারে সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অংশ নিয়েছিল। ফলে প্রবীণ নেতা হিসেবে ঝুঁকি নিয়ে নূর আহমদকে এদের গাইড করে হানাদার অধিকৃত দেশে গোপনে নিয়ে আসার দায়িত্ব নিতে হয়।
নৌ কমান্ডো প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদেরও পথ প্রদর্শক হিসেবে কাজ করেন নূর আহমদ। এই নৌ কমান্ডোদের শহরে প্রবেশেও তাঁর ভূমিকা ছিল। ভাটিয়ারির ইমাম নগরে বাড়ি হওয়াতে তাঁর পক্ষে সীতাকুণ্ডের নাড়িনক্ষত্র জানা ছিল। ১নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার রফিকুল ইসলাম বীরোত্তমের সক্রিয় সহকর্মী ছিলেন তিনি। আর সেই সময়ে এই হরিণা থেকে সমস্ত চট্টগ্রামের গেরিলা অপারেশনগুলো স্থির, নিয়ন্ত্রণ ও কার্যকর করা হতো। সেখানে সংসদ সদস্য মোশাররফ হোসেন, মীর্জা মনসুর, ডাক্তার মান্নান সহ অগণিত আওয়ামী লীগ, শ্রমিক লীগ ও ছাত্রলীগ নেতা কর্মী সর্বক্ষণের জন্যে হানাদার বাহিনীর মোকাবেলায় প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। নূর আহমদ তাদেরও পথ প্রদর্শক ছিলেন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নূর আহমদ আবার তাঁর মূল কাজ অর্থাৎ শ্রমিকদের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৭২ সালে সোভিয়েত রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় সফরে আমন্ত্রিত হয়ে শ্রমিক প্রতিনিধি হিসেবে তিনি সেখানে দেড়মাস অবস্থান করেন।
নূর আমদের স্ত্রী সামসুন নাহার, তাদের ৪ কন্যা, ২ পুত্র। কন্যাগণ : কোহিনুর আকতার-এইচএসসি-গৃহিণী, স্বামী মীর কাসেম আমিরী-অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক; পারভীন আকতার এম.এ (ইংরেজি), সহকারী অধ্যাপক, স্বামী ইঞ্জিনিয়ার শেখ জসিম উদ্দিন গাজী, ব্যবসায়ী শাহীদ আকতার গোলাপ এমএ (ইংরেজি)-গৃহিণী, স্বামী ইঞ্জিনিয়ার আনোয়ারুল আজিম পারভেজ; নীহারিকা শামীম ঝিনুক, এম.কম (হিসাববিজ্ঞান), ম্যানেজার তিতাস গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোং কানাডা প্রবাসী, স্বামী ইঞ্জিনিয়ার শফিকুল আলম হীরক। পুত্রদ্বয়-এমএ হান্নান, এম কম (ব্যবস্থাপনা), ব্যবসায়ী এমএ মান্নান শিমুল-এম কম (ব্যবস্থাপনা), ব্যবসায়ী।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক, সংস্কৃতি সংগঠক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅসাম্প্রদায়িক সরকারের আমলে কেন সাম্প্রদায়িক সহিংসতা
পরবর্তী নিবন্ধবঙ্গমাতা : সাধারণের মাঝে অসাধারণ মহীয়সী নারী