বঙ্গমাতা : সাধারণের মাঝে অসাধারণ মহীয়সী নারী

ড. আনোয়ারা আলম | সোমবার , ৮ আগস্ট, ২০২২ at ৭:৫৩ পূর্বাহ্ণ

‘আমার জীবনে দুটো বৃহৎ অবলম্বন আছে-একটি আমার আত্মবিশ্বাস, অপরটি আমার স্ত্রী, আমার আকৈশোর গৃহিণী’।
(মাযহারুল ইসলাম -বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব)।
‘নিরহংকার, দীপ্তিময়ী মুজিব পত্নী আমাদেরই মতো একেবারে সাধারণ এই তো যোগ্য অগ্নিপুরুষের সহধর্মিণী। বঙ্গবন্ধুর ভৎরবহফ, ঢ়যরষড়ংড়ঢ়যবৎ ধহফ মঁরফব’- ড.নীলিমা ইব্রাহিম।
‘গান্ধীপত্নী কস্তুরবা, নেহেরু কারাসঙ্গিনী কমলা, দেশবন্ধু সহধর্মিণী বাসন্তী দেবী বা ম্যান্ডেলাপত্নী উইনি ইতিহাসে স্থান পেয়েছে। কিন্তু বাঙালি জাতির মুক্তিদাতার স্ত্রী শক্তিদায়িনী, প্রেরণাদায়িনী মহিলার স্থান কেন ইতিহাসের পাতায় থাকবে না’। সাংবাদিক এ বি এম মুসা।
সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকে সমাজ বিনির্মাণে, বিভিন্ন সংগ্রামে বা আন্দোলনে বা মানুষের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠায় অনেক নারী নানাভাবে ইতিহাসের পাতায় স্মরণীয় হয়ে আছেন বা কেউ হারিয়ে গেছেন, উঠে আসেনি তাঁদের নাম ইতিহাসে। তবে তাদের অনেকেই সম্মুখ সারিতে ছিলেন। কিন্তু একেবারে পর্দার অন্তরালে একজন নারী আপন সংসারকে আগলে রেখেও বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছেন, তিনি বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেসা।
কারাগারে বা রাজপথে বা সংগ্রামে আন্দোলনে তিনি ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রেরণা ও শক্তি।
তবে শুধু সহধর্মিণী হিসেবে নয়, একজন দক্ষ নারী সংগঠক হিসেবে যিনি ধূপের মতো নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে বাংলার মুক্তিসংগ্রামে ভূমিকা রেখেছেন এবং বঙ্গবন্ধুকে হিমালয়সম আসনে অধিষ্ঠিত হতে সহায়তা করেছেন।
তাঁদের মধ্যে গভীর সম্পর্কের বিষয়টি বুঝতে পেরেছিলেন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক গুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তাই ১৯৪৬ সালের দাঙ্গায় বঙ্গবন্ধুকে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে দায়িত্ব পালনের আগে অসুস্থ স্ত্রীর অনুমতি নিতে বলেন। তখন বঙ্গবন্ধুর রেনুর চিঠির অংশবিশেষ- ‘আপনি শুধু আমার স্বামী হওয়ার জন্য জন্ম নেন নি, দেশের কাজ করার জন্যও জন্ম নিয়েছেন। দেশের কাজই আপনার বড়ো কাজ, আপনি নিশ্চিন্ত মনে সেই কাজে যান, আমার জন্য চিন্তা করবেন না’।
এ চিঠির মর্মার্থ অবহিত হওয়ার পর সোহরাওয়ার্দীর মন্তব্য ছিল ‘সে তোমার জন্য স্রষ্টার দেয়া অতি অমূল্য দান। অনুগ্রহ করে তাঁকে অবহেলা করো না’।
সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী তাঁদের আন্তসম্পর্ক নিয়ে বলেছেন, ‘অনেকেই জানেন শেখ মুজিব ছিলেন আপসহীন নেতা, বজ্রকঠিন ছিল তাঁর ব্যক্তিত্ব। কিন্তু অনেকেই জানেন না, এ বজ্রের চৌদ্দআনা বারুদই ছিলেন বেগম মুজিব। তাঁর সমর্থন, সাহায্য ও ষোলোআনা একাত্মতা ছাড়া বঙ্গবন্ধু আপসহীন নেতা হতে পারতেন না’।
বঙ্গবন্ধুর লেখক সত্তাকে জাগিয়ে তুলেছিলেন বঙ্গমাতা, বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনীর শুরুতে আছে’ আমার সহধর্মিণী একদিন জেলগেটে বসে বললেন, বসেই তো আছ, লেখ তোমার জীবনের কাহিনী। রেণু শুধু তাগাদা নয় -লেখার জন্য খাতাও দিয়েছিলেন’।
বঙ্গবন্ধুর লেখা গ্রন্থ্‌ অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও কারাগারের রোজনামচার পাতায় পাতায় রেনুর কথা। বঙ্গবন্ধুর রেণু আবাল্য কৈশোরের সঙ্গী-ফুলের মতো ছিলেন বিধায় ডাক নাম রেণু।
বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিশক্তি ছিল কিংবদন্তিতূল্য। অথচ স্ত্রীকে বলছেন-‘এই আমার জীবন্ত ডায়েরি। তাঁকে জিজ্ঞেস কর। আমার চাইতেও নির্ভুল বিবরণ পাবে। আমার চাইতেও তাঁর স্মৃতিশক্তি ভালো’
(আবদুল গাফফার চৌধুরী)
১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট বঙ্গমাতার জন্মদিন। অল্পবয়সে পরিণয় আর পরিণত বয়সে সংসারজীবনের শুরু। ছোট বয়স থেকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে লালন ও ধারণ করেছেন মনেপ্রাণে ও গভীর শ্রদ্ধায়।
১৯৪২ সালে বঙ্গবন্ধু যখন ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র, তখন থেকেই জড়িয়ে পড়েন রাজনীতি তথা বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে। এ সময়ে অর্থের যোগান দিতেন বঙ্গ মাতা। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পত্তি থেকে এমন কি নিজের গহনা বিক্রি করেও তিনি রাজনৈতিক অফিসের ভাড়া, সম্মেলনের টাকা যোগাড় করতেন।
বঙ্গবন্ধুর সুদীর্ঘ কারাজীবনের সময়ে তাঁর অবর্তমানে একজন নারী সংগঠক হিসেবে কাজ করেছেন।
১৯৬৬ সালের ছয়দফা আন্দোলন ছিলো জাতির মুক্তির সনদ। কিন্তু এ বিষয়ে ও নানা ষড়যন্ত্র চলছিলো। দলের মধ্যেও বিভক্তি ছিলো কিন্তু বঙ্গমাতার দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতার কারণে এ আন্দোলন বেগবান হয়ে উঠে।
১৯৬৮ সালের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গমাতার ভূমিকা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের একটা টার্নিং পয়েন্ট। জাতির পিতাকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে লাহোরে একটা গোলটেবিলের সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রমূলক পরিকল্পনা। বঙ্গমাতা এক্ষেত্রে কারাগারে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করে তাঁর দৃঢ়ভাবে দ্বিমত পোষণ করে কঠিন সিদ্ধান্ত জানান। ফলশ্রুতিতে গড়ে উঠে জনতার দুর্বার আন্দোলন ও সংগ্রাম আর পাক সরকার শেষ পর্যন্ত বাধ্য হলো বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে। শেখ মুজিবুর রহমান হলেন বঙ্গবন্ধু! অথচ এর উত্তর নেপথ্যে ছিলেন এক অতি সাধারণ অথচ অসাধারণ এক মহীয়সী নারী বেগম ফজিলাতুন নেসা! এমন এক ভূমিকার বিষয়টি কতো জন জানেন! বা ইতিহাসের পাতায় সুদীর্ঘ সময়ে এক সুনসান নীরবতা!
মহান একাত্তরের সাত মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ! যা পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণ। এ সময়টা বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলা যায় চরম এক সন্ধিক্ষণে পুরো জাতি। নানাজনের নানা পরামর্শ!
প্রচণ্ড মানসিক চাপে তিনি। এ সময়ে বললেন, ‘আপনার মন ও বিবেক যা চায় আজ তাই করুন। ভয়ে পিছিয়ে যাবেন না’। শেষ কথা ছিল – ‘মনে রাখবেন আপনার পেছনে বন্দুক, সামনে জনতা’
রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত লাখো জনতার সামনে রাজকীয়ভাবে মঞ্চে উঠলেন বঙ্গবন্ধু! আর এমন অত্যন্ত কুশলী দক্ষতায় সবদিক সামলিয়ে যে ভাষণ দিলেন! যা পরবর্তীতে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে ইতিহাসের পাতায়! আর নেপথ্যে ছিলেন এক অতি সাধারণ কিন্তু অসাধারণ এক গৃহবধূ, একজন মা একজন সাংসারিক জগতের নারী কিন্তু মহীয়সী তথা এক বীর নারী।
অন্যান্য মানবিক গুণাবলিও ছিলো তাঁর। ঘরে বসে মেয়েদের লেখাপড়া ও সেলাই শেখাতেন। গরীব ছেলেমেয়েদের আর্থিক সাহায্য ছাড়াও বিয়েতেও সাহায্য করতেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও স্বশিক্ষিত ছিলেন। অবসরে বিভিন্ন বিখ্যাত লেখকের লেখা বইয়ের সান্নিধ্যে থাকতেন।
স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী হিসেবে ফার্স্ট লেডি। কিন্তু এক্ষেত্রে জনগণ তাঁকে কখনোও সেই ভূমিকায় দেখেন নি। বরং তিনি পাকসেনাদের হাতে নির্যাতিতা নারীদের বুকে টেনে নিয়ে বলেছেন, ‘আমি তোমাদের মা’। বললেন ‘এই বীরাঙ্গনা নারীদের জন্য জাতি গর্বিত। কেননা তাঁরা প্রমাণ করেছে যে, বাংলাদেশে কেবল ছেলেরাই নয়, মেয়েরাও আত্মমর্যাদা বোধে কি অসম্ভব বলীয়ান’। (সূত্র:দৈনিক বাংলার বাণী, ১৭ ফাল্গুন, ১৩৭৮ বঙ্গাব্দ।)
রাষ্ট্রের সবচেয়ে ক্ষমতাবান ব্যক্তির জীবন সঙ্গী হয়েও কখনো ক্ষমতার কর্মকাণ্ডে হস্তক্ষেপ করেন নি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর অবদানের জন্য জাতি তাঁকে বঙ্গমাতা উপাধি দিয়েছে। বঙ্গবন্ধু যেমন আলোকবর্তিকা তেমনি বঙ্গমাতাও তাঁর অবদানের জন্য অবিস্মরণীয়। সর্বজন শ্রদ্ধেয় এই মহীয়সী নারীর জন্মদিনে তাঁকে স্মরণ করছি বিনম্র শ্রদ্ধায়।
লেখক : সাহিত্যিক; সাবেক অধ্যক্ষ, আগ্রাবাদ মহিলা কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্বাধীনতা সংগ্রামের বীর যোদ্ধা শ্রমিক নেতা নূর আহমদ
পরবর্তী নিবন্ধশিল্পপতি আনোয়ারুল আজিম চৌধুরীর মৃত্যুবার্ষিকী আজ