অবস্থা পাল্টায়নি তেমন

কামরুন নাহার রোজী | শনিবার , ২৯ অক্টোবর, ২০২২ at ১০:৩৫ পূর্বাহ্ণ

নারী মানে বাদ্যযন্ত্র, যে সুরে বাজাবে সে সুরে বাজবে। যেন পুতুল। তাই না? হ্যাঁ, এমনই তো হয়ে আসছে অনন্তকাল ধরে। নারীদের এই সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠে সুষ্ঠু ও গঠনমূলক স্বাধীনতায় এগিয়ে যাওয়ার পথ আজ প্রশ্নের সম্মুখীন।

পাল্টেছে যুগ, পাল্টেছে পরিবেশ, বেড়েছে সামগ্রিক গণসচেতনতা। সেই সাথে নারীর অগ্রগতিও থেমে নেই। তবুও তাকে ঘরে-বাইরে পথচলায় নানামুখী বিরূপ প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়। এসব বাধা দূর করতে এ পর্যন্ত মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অফিসিয়াল নন-অফিসিয়াল অনেক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। এ ব্যাপারে বিভিন্ন জেলায় উপজেলায় নানা কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। নারীরা যার যার অবস্থান থেকে সফলও হয়েছে। সমপ্রতি নেপালের কাঠমুন্ডুতে অনুষ্ঠিত ফুটবল খেলায় ১৯ বছর পর ট্রফি জিতেছে বাংলাদেশের নারী ফুটবলার। এ-সত্যিই নারী জাতির জন্য, বাংলাদেশের জন্য গর্বের। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, নারীদের ব্যাপারে আমাদের আন্তঃসামাজিক পরিবেশ, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও মানসিকতা এখনো বদলায়নি। রয়ে গেছে সেই আগের মতো গতানুগতিক।

বিজ্ঞান, প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে, বেড়েছে সরকারি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা। বেড়েছে শিক্ষার্থীর হার। কিন্তু আফসোস, বাড়েনি গুণগত শিক্ষার মান। যে শিক্ষায় থাকবে অপরের প্রতি বিশেষ করে নারীদের প্রতি সহমর্মিতা, সম্মান ও সমীহ করার সামগ্রিক আয়োজন।

আজ থেকে অনেক অনেক বছর আগে নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন বলেছিলেন, ‘তোমাদের কন্যাগুলোকে শিক্ষা দিয়া ছাড়িয়া দাও ওরা নিজেদের অন্ন সংস্থান নিজেরাই করবে’। তিনি এ-ও ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, এমন একদিন আসবে যেদিন দেশের প্রতিটি স্তরে প্রতিটি পেশায় নারীদের অবস্থান থাকবে। এই মহীয়সী নারীর ভবিষ্যদ্বাণী আজ অনেকাংশে বাস্তবায়িত হয়েছে। আজ দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেত্রী, স্পিকার, শিক্ষামন্ত্রী থেকে শুরু করে ডাক্তার, পাইলট, ইঞ্জিনিয়ার এমনকি অটোরিক্সাচালক, হকার, কুলি, ফুটবলার, কারাতে, সেলসম্যান পর্যন্ত নানা ক্ষেত্রে নারীদের অবস্থান চোখে পড়ার মতো।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, এসবই আলোকিত লোকসমাজে। আসলে রাস্তায়, অলিতে-গলিতে, পাড়ায়-পাড়ায়, সংসারে, ঘরে ঘরে লোকচক্ষুর অন্তরালে কী হচ্ছে, নেপথ্যে কী ঘটছে তা হয়তো কারো চোখে পড়ে না। আজও অনেক নারী দীর্ঘদিন ধরে সয়ে যাওয়া নির্যাতনের বঞ্চনার কথা বলতে ভয় পায়, লজ্জা পায়। অথবা কারো দাবানলে চেপে যায়। আমরা যা দেখি বা শুনি তা অনেকটা অসম্পূর্ণ বা মিথ্যে। আমাদেরকে লোক সম্মুখে যা জানানো হচ্ছে সেই ঘটনার পেছনে হয়তো আরো ঘটনা আছে। এখানে এমন সব ঘটনা ঘটে যায় যা ক্যামেরাবন্দি হয় না। আদালতে সোপর্দ করা হয় না, খবরের কাগজের খোরাক হয় না। অন্তরের খবর অন্তরালেই রয়ে যায়। ধীরে ধীরে সকলের অজান্তে মরণের পথ বেছে নেয় এই অবহেলিত নারী। সংসারের মারপ্যাঁচের ঘেরাটোপ থেকে ছুটকারা পাওয়ার জন্য অনেকে সংসার ত্যাগ করে, অনেকে নিজেকে বিক্রি করে দেয় সমাজের কাছে। হাতে গোনা কতিপয় নারী ছাড়া বাকি সব ধুঁকে ধুঁকে মরছে। অপমান কষ্ট নিপীড়ন লাঞ্ছনা সহ্য করতে করতে কেউ মরণের পথ বেছে নিচ্ছে আর কেউবা নিজের আমিত্বকে কবর দিয়ে অন্যমানুষে রূপান্তরিত হচ্ছে। জীবনের বাকি দিনগুলোতে মানুষের বেশে বেঁচে থাকলেও সে যেন একটা জীবন্ত লাশের মতো। অনেক ক্ষেত্রে দারিদ্র্য ও নিরক্ষরতার অভিশাপে নারীর এই সংকট আরো বেড়ে যাচ্ছে।

সংসারের চলমান রীতি-রেওয়াজ একটু খরনজরে খেয়াল করলে দেখা যাবে, কোনো কোনো সংসারে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই চাকরিরত। একসাথে বাসায় ফেরে দুজনেই ক্লান্ত শ্রান্ত অবসন্ন হয়ে পুরুষ লোকটি ঘরে ঢুকে এসি ছেড়ে রিমোর্ট কন্ট্রোল হাতে নিয়ে সোফায় এলিয়ে দেয় ক্লান্ত শরীর। মনের মতো করে বিশ্রাম নেয় আর মজার মজার ভিডিও দেখে মনের খোরাক মেটায়। আর অপরজন- নারী নামক মানুষটি মুখে হাতে ছিটেফোঁটা পানির ঝাপটা দিয়ে তড়িঘড়ি করে দৌড় দেয় হেঁসেলে। বড়ই উৎকণ্ঠিত হয়ে এটা সেটা দিয়ে স্বামীর জন্য পরিবারের বাকি সব সদস্যের জন্য মুখরোচক কোনো নাস্তা তৈরি করতে লেগে যান। সকলের সামনে পরিবেশনও করে বেশ কায়দা করে। এরপরও সবাইকে খেতে দিয়ে বাকি সব কাজে লেগে পড়ে। কেউ হয়তো একবারও জানতে চায়নি- ও খেয়েছে কিনা অথবা কারো একবারও চোখে পড়েনি তার কোনো বিশ্রামের এতটুকু প্রয়োজন আছে কিনা। প্রয়োজন থাকবেও বা কেন?

সবার আগে পাখিদের সাথে ঘুম থেকে উঠতে হয়ে এই নারীকে আবার সবার শেষে ঘুমোতে যেতে হয়। ওর ঘুম কম হলো না বেশি হলো ঘুম পেকেছে না কাঁচাই রয়ে গেছে তাতে কারো কিচ্ছু এসে যায় না। ঢুলু ঢুলু চোখে ভোরবেলায় রুটি মেলতে মেলতে দিনের শুরু হয়। রাতের শেষ হয় সবার ঘুমের আয়োজন শেষে সমস্ত কাজ নিপটানোর পর।। কারণ ও নারী। ওর ভাগ সবসময় কম। ওর জন্য তো সবকিছুতে না..ই। ‘না’ দিয়েই তো নারীর শুরু। মাছের বড় অংশটা হয় স্বামীর নয় ছেলের নয় বড় কোনো কর্তার । পুড়ে যাওয়া নাস্তাটা কিংবা রুটিটা অথবা পুড়ে যাওয়া ভাত অসুন্দর যা কিছু আছে সবকিছু নারীর ভাগে।

এমন অনেক সংসারে দেখা যায় স্বামীর চেয়ে স্ত্রী বেশি অর্থ উপার্জন করে। আর স্বামী অপেক্ষাকৃত কম। তখনও যদি কোনো কারণে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার কথা ওঠে তা নারীর।

আমার নিজের ছোটোবেলার কথাই বলি, আমি যখন এসএসসি পরীক্ষায় খুব ভালো রেজাল্ট করি আমার মা খুশি হয়ে সবার কাছে বলছিল- এই রেজাল্টটা যদি ও না করে আমার ছেলে করতো অনেক ভালো হতো। সেদিন কিছুটা বিস্মিত হয়েছিলাম। কারণ আমি নারী। আমি তো বংশে বাতি জ্বালাবো না। বংশ উদ্ধার করবো না। বাংলাদেশের নারী ফুটবলাররা এশিয়া মহাদেশে একদিকে সুনাম বয়ে আনলেও অন্যদিকে দেখুন..

মিলি দত্ত উচ্চ মাধ্যমিকে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। চট্টগ্রাম থেকে ফুটবল খেলে। জেলায় জেলায় খেলতে যায়। ছোটবেলা থেকেই ওর খেলাধুলার প্রতি বেশি ঝোঁক। বেশ পারদর্শীও বটে। প্রচুর পুরস্কার জিতেছে এ-পর্যন্ত। কিন্তু সমাজ ওকে ভালো চোখে দেখে না। ঘরের চেয়ে পরের আপত্তি বেশি। আসা-যাওয়ার পথে প্রতিদিন ওকে নানা ধরনের কটুক্তি শুনতে হয়। সইতে হয় অসহনীয় যন্ত্রণা। মানসিক টানাপোড়েন। খিটখিটে হয়ে যায় মেজাজ। এতে পড়ালেখার মনোযোগেও ব্যাঘাত ঘটে। যেদিন টুর্নামেন্ট থাকে বাসে করে ঘরে ফিরে সে। বাসের সমস্ত যাত্রী ওর দিকে এমনভাবে তাকিয়ে থাকে যেন মনে হয় ও মস্ত বড় কোনো অপরাধ করে এসেছে কিংবা জেল ফেরত খুনের আসামি। বাইরের কথা কি বলবো, ঘরে যে নানীর সাথেও বসবাস করে সেই-ই ওর সাথে কথা বন্ধ করে দিয়েছে অনেক দিন আগে থেকে। ছোটবেলায় মা মরে যায় মিলির। তিন ভাই বোনের সংসার। বাবা বেকারিতে কাজ করে। এই কথাগুলো বলতে বলতে ওর কান্না উথলে ওঠে কন্ঠ পর্যন্ত। আড়ালে চোখ মোছে।

যেখানে স্কুলের প্রতিটি শ্রেণি থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষায় উচ্চ পেশায় উচ্চ পদে সমাসীন আছে নারী, এগিয়ে আছে নারী, সেখানে এখনো পর্যন্ত নারীদের কম মনে করা হয়। কর্মক্ষেত্রে নারীদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করা হয়। নারীর চেয়ে বেশি পুরুষদেরই উপযুক্ত মনে করা হয়। অর্থাৎ এখনো অনেক প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা সমান মেধা সমান পরিশ্রমের পরেও নারীদের চেয়ে পুরুষদের বেশি মূল্যায়ন করে যাচ্ছে। অশিক্ষিত থেকে শিক্ষিত শ্রেণি পর্যন্ত একটা কথা প্রচলিত আছে- মেয়েরা কখনো ছেলেদের চেয়ে বেশি বোঝে না। মেয়েরা যতই শিক্ষিত হোক না কেন চুলা ঠেলতেই হবে। হ্যাঁ চুলা তো ঠেলবেই কিন্তু ‘যে রাধে সে চুলও বাঁধে।’

নারীর চরিত্র ঠিক যেন খাঁটি তরল দুধের মতো, এত সাদা এত পবিত্র যে, এক ফোঁটা টক পড়লেই সাথে সাথে নষ্ট। নারীর চরিত্র ঠিক তেমনি সমাজ ও সমাজের মানুষের কাছে এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, এক ইঞ্চি ডানে-বামে হেলে পড়লেই সর্বনাশ। অথচ আশ্চর্যের বিষয়, যে মানুষটার চরিত্র সবার কাছে সমাজের কাছে এত বেশি গুরুত্বপূর্ণ সেই নারী মানুষটার কোনো গুরুত্বই কারো কাছে নেই।

শুধু তা-ই নয়। মেয়েরা যখন বাপের বাড়িতে থেকে আদরে আহ্লাদে বড় হয়। তারপর একদিন বিয়ে হয়। বিয়ের পর যে-কোনো অজুহাতে অন্যায়ের ছুতো ধরে বাড়ি থেকে বের করে দিতে পারে তার স্বামী। বলতে পারে- ‘এই মুহূর্তে আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যা।’ আবার যখন বাপের বাড়িতে ফিরে যায় তখন দেখা যায় ওই বাড়িটাও ওর না। ভাইয়ের অথবা বাপের। কী দাঁড়ালো তাহলে? ওর না রইলো বাপের বা ভাইয়ের বাড়ি না রইলো শ্বশুর বা স্বামীর বাড়ি। ওর নিজের কোনো ঘর নেই, ঠাঁই নেই, ঠিকানা নেই।

মোটকথা, বাইরের জগত ছাড়া ঘর থেকে শুরু করে শ্বশুরবাড়ি পর্যন্ত নীরবে নিভৃতে মেয়েরা পদে পদে ছোট ছোট অনেক বঞ্চনার শিকার হয়। এটি ভিতরে ভিতরে বড় ধরনের সংকটের ইংগিত দেয়। এই অবস্থা চলতে থাকলে এ দেশ কখনো উন্নত জাতিতে পরিণত হবে না। একটা সংসার একটা সমাজ একটা জাতির সৌন্দর্য নির্ভর করে নারী-পুরুষ দু’জনের সমান অংশগ্রহণে। নারীর প্রতি সম্মানবোধ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি সুষ্ঠু জীবন ব্যবস্থা আজ জরুরি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। একজনকে দলিত করে আরেকজনকে মাথায় তুলে নয়; মেয়েশিশু থেকে শুরু করে নারীর ওপর ঘরে-বাইরে যেকোনো ধরনের লাঞ্ছনা-বঞ্চনার জন্য দেশে কঠোর আইন প্রতিষ্ঠা ও তার বাস্তবায়নে উদ্যোগী হওয়া উচিত। তার জন্য প্রথম পদক্ষেপ হওয়া চাই ঘরে-বাইরে আপনার আমার প্রতিবাদের সৎসাহস।

সহকারী শিক্ষিকা, সেন্ট্রাল পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ

পূর্ববর্তী নিবন্ধসুধাকণ্ঠ প্রেম
পরবর্তী নিবন্ধআসকার দীঘির পাড় লোকনাথ মন্দিরে পুরস্কার বিতরণ