সুধাকণ্ঠ প্রেম

মহুয়া ভট্টাচার্য | শনিবার , ২৯ অক্টোবর, ২০২২ at ১০:৩৫ পূর্বাহ্ণ

পর্ব ২

কল্পনার বাবা ফেরার পর এ-নিয়ে নানা অশান্তি চলছে ঘরে। প্রথমত, কল্পনা যে-মানুষটির সাথে সময় কাটাচ্ছে তিনি কল্পনার চেয়ে ২৮ বছরের বড়। দ্বিতীয় কলকাতা কিংবা বম্বে ফিল্ম ও মিউজিক ইন্ড্রাস্টিতে হেন মানুষ নেই যারা ভূপেনদার বদ-অভ্যাস জানে না। আকণ্ঠ মদ্যপ ও শরীসঙ্গ প্রিয় এই মানুষটির সম্পর্কে ইতোমধ্যে বহু নারীকে জড়িয়ে রসালো গল্প চালু আছে। এমন কারো সাথে একসাথে থাকা নিজের জীবন নিয়ে জুয়ো খেলা ছাড়া আর কী। বিশেষত কল্পনার মতো একটি মেধাবী মেয়ের জন্য, সেন্ট জেভিয়ার্সের তুখোড় ছাত্রী কল্পনা। স্কুলের বেশ কয়েকটি নাটকেও দারুণ কাজ করেছে। ললিতা চেয়েছিলেন তার মামা শ্যাম বেনেগালের কাছে থেকে কল্পনা কাজ করুক। কিন্তু কল্পনাকে রাজী করানো গেলো না কিছুতেই। অবশেষে কল্পনা জানিয়েই দিলো সে কলকাতা যাচ্ছে তার ডকুমেন্টরি বানাতে।

কল্পনা ভূপেনকে বারবার করে বলছে ঘরের পরিবেশ দিন দিন বিষিয়ে উঠছে তার কাছে। বিশেষ করে, তার বাবার হঠাৎ করে বদলে যাওয়া। অতিরিক্ত মদ্যপান, মা ও বাবার মধ্যে অশান্তি, এবং কল্পনার কলকাতা যাওয়ার সিদ্ধান্তে পরিবারের বাধা সবকিছু মিলিয়ে কল্পনা এখন অস্থির বম্বে ত্যাগ করতে।

ভূপেনের সাথে পাকাপাকিভাবে একসাথে থাকা কিংবা তাকে ছেড়ে থাকার অস্থিরটুকু গোপন করে সে কেবল ভূপেনকে তার ডকুমেন্টরি বানানোর স্বপ্নটুকুর কথাই বলল এবং ভূপেনও তাকে ডেকে নিলো ‘বেশ, চলে এসো কলকাতা, আমি তোমাকে তোমার ডকুমেন্টরি বানাতে সাহায্য করব।’

কল্পনা কেবল এই ডাকটুকুর অপেক্ষায় ছিলো। কল্পনা ভূপেনের ছায়াতলে চিরদিনের মতো আশ্রয় নেওয়ার জন্য শুধুমাত্র এই হাতছানিটির প্রত্যাশায় ছিলো। কিন্তু আগোছালো উদাসীন, খামখেয়ালী ভূপেনকে তা বলা হয়নি বটে তবে কোনো উপায়ে সে অবশেষে ভূপেনের কাছে পৌঁছুতে তো পারছে! একদিকে ভূপেনের বৈচিত্র্যহীন জীবনযাত্রা, যেন নদীর নিস্তরঙ্গ বয়ে চলা। অপরদিকে পাহাড়ের বুক চিঁড়ে বেরিয়ে আসা একটি চঞ্চল। উদ্যোম ঝর্ণা যে তার গতিপথ খুঁজে নিতে আছড়ে পড়লে সেই তরঙ্গহীন অবিচল মৌন সন্ন্যাসী নদীর বুকে। সন্ন্যাসীর তপস্যায় ছেদ পড়ল। ধ্যান ভাঙ্গলো, চোখ মেলে তাকালেন। সামনে দেখতে পেলেন এক চঞ্চলা কন্যা যে এতদিন পর এলো তার তপস্যা ভাঙ্গাতে। সেই চঞ্চলা তটিনীকে অগরবের মত জটায় ধারণ করলেন তিনি। তারপর একসাথে পথচলা শুরু। ছিলেন ৪০টি বছর একসাথে।

বাবা-মায়ের দ্বন্দ্ব-সংঘাত, একে একে সমস্ত কাছের বন্ধুদের জীবনের গতিপথ বদলে যাওয়া, পরম বন্ধু-ভাবাগোপী লাজমির হঠাৎ অস্বাভাবিক পরিবর্তনের দুঃসহ কৈশোরকালে কল্পনা তার ত্রাণকর্তা হিসেবে যাঁর ছবিটি এঁকেছিলেন বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী ভূপেন হাজারিকা। চারপাশের মানুষ কল্পনাকে বলত ভূপেন-দা দায়িত্বজ্ঞানহীন, নারীসঙ্গলোভী, মাদকাসক্ত। উপরন্তু ভাষা, সংস্কৃতি, বয়স কোনটির সাথে সামঞ্জস্য ছিলো না চলচ্চিত্র নির্মাতা কল্পনা লাজমি ও বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী ভূপেন হাজারিকার। কল্পনা যখন পাকাপাকিভাবে ভূপেন হাজারিকার কলকাতার ফ্ল্যাটে থাকতে শুরু করেছেন তখন ভূপেন হাজারিকা একজন প্রায় বিধ্বস্ত মানুষ মদ, ধূমপান অনিয়মিত জীবন যাপনে।

নিজের ডকুমেন্টরির কাজ করার সাথে সাথে কল্পনা আরো একটি দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিলেন তা হলো ভূপেন হাজারিকার ম্যানেজারের দায়িত্ব। এই কাজটি অতটাও সহজ ছিলো না। যখন মানুষটি ভূপেন হাজারিকা! কল্পনার এই পথ কতখানি দুর্গম ছিলো তার একটি বিবরণ দেওয়া যাক। সেই সময় ভূপেন হাজরিকার প্রোগাম অর্গানাইজ করার দু’জন ব্রোকার ছিলেন তাদের একজন ছিলেন নিতাই বাবু। সাধারণত ভূপেন হাজারিকা যেসব সঙ্গীতানুষ্ঠানে গান গাইতেন সেই অর্থই ছিলো তাঁর একমাত্র উপার্জন। তাই কল্পনা লাজমিকে সেই দিকটি শক্ত হাতে পরিচালনা করতে গিয়ে একদিন প্রচন্ড বাক-বিতন্ডায় জড়িয়ে পড়তে হলো নিতাই বাবুর সাথে। প্রতিটি অনুষ্ঠানেই ভূপেন হাজারিকা আকণ্ঠ মদ্যপান করে গান গাইতে উঠতেন মঞ্চে, পাশে একটি ফ্লাস্কে…।কিংবা এমনই কিছু রাখতেন। পোগ্রাম অর্গানাইজার ও ব্রোকাররা মিলে বেশিরভাগ সময়েই অপ্রকৃতিস্থ ভূপেন হাজারিকাকে প্রাপ্য সম্মানি থেকে বঞ্চিত করতেন এবং ভূপেন হাজারিকা নিজেও সেই সম্পর্কে ছিলেন চরম উদাসীন। কল্পনা লাজমির দক্ষ ব্যবস্থাপনায় ভূপেন হাজারিকার আত্মোন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত হচ্ছিল। তিনি পুনরায় তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গাটি পুনরুদ্ধার করতে পারছিলেন বটে কিন্তু আর্থিক ক্ষতি রোধ করা যাচ্ছিলো না কিছুতেই। অতএব কল্পনাকে দৃঢ় হতে হলো।

তিনি ব্রোকার নিতাই বাবু ও সুবিধাবাদী অনুষ্ঠান কর্তৃপক্ষদের আর কোনো সুযোগ নিতে দিলেন না। নিতাই বাবু এবং অন্যান্যরা বুঝতে পারলেন ভূপেন হাজারিকার কাছে পৌঁছানোর সবচেয়ে বড় দেয়াল কল্পনা লাজমি এবং তা অতিক্রম করা দুরূহ। তবে ভূপেন হাজারিকা ছিলেন নির্মোহ, উদাসীন। তিনি কল্পনার এই দৃঢ় প্রচেষ্টাকে বৈষয়িক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করেছিলেন। বলেছিলেন

“Who do Dthink DU are? শালা বোম্বাইয়া বামুন! Tring tW Commercialiaee সব? শালা! after t have come in tW mylife, স্বরস্বতী তো যধং মড়হব, আভি তেরি ওয়াজে সে লক্ষী ভি ভাগ যায়েগি!”

এই ভূপেন হাজারিকা আমাদের অচেনা! যিনি লিখেছিলেন ‘এলোমেলো হাওয়া চোখে স্বপ্ন আনে। শরমে রাঙ্গে মন কেন কে জানে। ভালোবেসে চুপি চুপি দিয়েছে দোলা। একমুঠো অনুরাগে মন ভরালো।’ হয়তো কল্পনা লাজমির কাছেও এই ভূপেনকে অচেনা মনে হয়েছিলো মুহূর্তেই।

ভূপেন কখনো তার অতীত কল্পনাকে সাবলীলভাবে বলতে পারেন নি। বলতে চান নি। কল্পনা জানতেন ভূপেনের আগেও একটি সংসার ছিলো। কিন্তু কল্পনার এক জন্মদিনে সবচেয়ে অপ্রত্যাশিত ব্যবহারটি তিনি পেয়েছিলেন ভূপেনের কাছ থেকে। সেদিনই কল্পনা জেনেছিলেন ভূপেন হাজারিকার সাথে তাঁর স্ত্রীর কখনোই বিবাহ বিচ্ছেদ হয়নি। এবং তিনি বৈবাহিক সম্পর্কের প্রতি অনাগ্রহী ছিলেন। তাঁর নিজের জীবনে কল্পনার অবস্থান জানাতে গিয়ে তিনি কল্পনাকে বরাবরই একই কথাই বলেছেন-

“তুমি আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু my business Partner, my manager, that’s it! কল্প আমি কোনো পুরাতন সুতো কাটতে চাই না। নতুন কোনো সম্পর্ক বুনতেও চাই না। আমাকে এভাবেই মেনে নিতে হবে তোমার। এ ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই।’

পূর্ববর্তী নিবন্ধসহিংসতা নয়, সহিষ্ণুতার রাজনীতিই কাম্য
পরবর্তী নিবন্ধঅবস্থা পাল্টায়নি তেমন