আশ্রমে ১৩৫ জনের মৃত্যু হয়েছে : আদালতে মিল্টন

তিনি মরদেহ দাফন করতেন রাতে, দিতেন ভুয়া সনদ : ডিবি | শুক্রবার , ৩ মে, ২০২৪ at ৬:৪৫ পূর্বাহ্ণ

চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার আশ্রমে বর্তমানে ২৫৬ জন নাম পরিচয়হীন মানুষ রয়েছেন। ইতোপূর্বে আশ্রমে ১৩৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। রিমান্ড শুনানিকালে ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তোফাজ্জল হোসেনের আদালতে এ তথ্য জানিয়েছেন সংস্থাটির চেয়ারম্যান মিল্টন সমাদ্দার। এদিকে ডিবি জানিয়েছে, সিটি কর্পোরেশনের সনদ ছাড়াই রাতে মরদেহ দাফন করতেন মিল্টন। এক্ষেত্রে নিজেকে নিরাপদ রাখতে সিটি কর্পোরেশনের নকল সিল দিয়ে মৃত্যু সনদ তৈরি করে রাখতেন। খবর বিডিনিউজ ও বাংলানিউজের।

গতকাল বৃহস্পতিবার রিমান্ড শুনানির সময় মিল্টন সমাদ্দারকে কিছু প্রশ্ন করেন বিচারক। উত্তরে মিল্টন বলেন, চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার আশ্রম ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠা করি। পরের বছর সমাজসেবা অধিদপ্তরে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করি। আমাদের কার্যক্রম দেখে অধিদপ্তর ২০১৮ সালে নিবন্ধন দেয়। এখানে শুধু পরিচয়হীন ছিন্নমূল মানুষকে এনে আশ্রয় ও চিকিৎসা দিই। আশ্রম সাধারণ মানুষের অনুদানে পরিচালিত হয়। ২০১৭ সাল থেকে সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে আয়ব্যয়ের অডিট রিপোর্ট সংরক্ষণ করি। বর্তমানে এখানে ২৫৬ জন আশ্রিত মানুষ আছে। এ পর্যন্ত ১৩৫ জন আশ্রমে থাকা অবস্থায় মারা যায়। তাদের সমাহিতকরণের জন্য আমরা নিজস্ব চিকিৎসক দ্বারা নিশ্চিত হয়ে মৃত্যুর কারণ সম্বলিত প্রত্যয়নপত্র দিই। এটা শুধু দাফনের কাজে ব্যবহৃত হয়। এসব মানুষকে দাফনের দায়িত্ব নিতে আমরা সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কাছে আবেদন করি। এমনকি হাইকোর্টেও আমরা আবেদন করেছিলাম। কিন্তু কেউ তাদের দায়িত্ব না নেওয়ায় নিজস্বভাবে তালিকা করে প্রত্যয়নপত্র দিয়ে দাফনের ব্যবস্থা করি।

এর আগে দুপুর ১টা ২০ মিনিটের দিকে মিল্টন সমাদ্দারকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হয়। এরপর তাকে ঢাকা সিএমএম আদালতের হাজতখানায় হাজির করা হয়। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাতদিনের রিমান্ড আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) উপপরিদর্শক (এসআই) মোহাম্মদ কামাল হোসেন। আসামিপক্ষের আইনজীবী রিমান্ড বাতিলপূর্বক জামিন আবেদন করেন।

রিমান্ড শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মহানগর পিপি আব্দুল্লাহ আবু বলেন, মানবতার ফেরিওয়ালার নামে তিনি প্রতারণা, অর্থ তসরুপ, অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বিক্রি ও মানব পাচারের মতো ঘটনার সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। তাই এসব তথ্য উদঘাটনে তদন্ত কর্মকর্তার প্রার্থিত সাতদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা আবশ্যক।

এর আগে বুধবার (১ মে) রাতে রাজধানীর মিরপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে মিল্টন সমাদ্দারকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। তার বিরুদ্ধে মিরপুর মডেল থানায় প্রতারণার মাধ্যমে জালিয়াতি, মানবপাচার এবং মারধর ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে তিনটি মামলা দায়ের করে পুলিশ।

বৃহস্পতিবার দুপুরে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে এক ব্রিফিংয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ বলেন, মিল্টন সমাদ্দার রাতে মরদেহ দাফন করতেন। লাশ দাফন করার ক্ষেত্রে সিটি কর্পোরেশনের কোনো সনদ না নিয়ে নিজেই লিখে স্বাক্ষর করতেন এবং সিটি কর্পোরেশনের সিল নিজেই মারতেন। সেই কাগজগুলো আমরা উদ্ধার করেছি।

মিল্টনের স্ত্রীর বিরুদ্ধেও আশ্রয়কেন্দ্রের ব্যক্তিদের মারধরের অভিযোগ এসেছে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে। জানতে চাইলে হারুন অর রশিদ বলেন, মিল্টন রিমান্ডে এলে তার স্ত্রীকেও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হবে। তবে তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে কেউ মামলা করলে সে ক্ষেত্রে আইনানুযায়ী তাকেও গ্রেপ্তার করা হবে।

মিল্টন তার ফেসবুক পাতায় তিনটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে নিজের পরিচয় তুলে ধরেন। এগুলো হলচাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার, চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার ফাউন্ডেশন ও মিল্টন হোম কেয়ার প্রাইভেট লিমিটেড। এর মধ্যে প্রথম দুটো স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান এবং পরেরটি কোম্পানি। বরিশাল থেকে আসা মিল্টন রাঙামাটির চন্দ্রঘোনা খ্রিস্টান হাসপাতাল থেকে নার্সিংয়ে ডিপ্লোমা সম্পন্ন করেছেন বলে দাবি করেন। রাজধানীর মিরপুরের পাইকপাড়ায় চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার নামের প্রতিষ্ঠানটিকে তিনি বলেন আশ্রম।

তার পেইজগুলোতে সড়কে পড়ে থাকা অসহায় বৃদ্ধ কিংবা আশ্রয়কেন্দ্রের শিশুদের অনেক ছবিভিডিও শেয়ার করা হয়। পাশাপাশি বিভিন্ন সময় দুস্থদের থাকার এ কেন্দ্র পরিদর্শনে আসা মন্ত্রী থেকে শুরু করে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ভিডিও পোস্ট করেছেন তিনি। অনেক ভিডিওতে আশ্রমের বাসিন্দা বৃদ্ধবৃদ্ধাদের বাবামা ও শিশুদের সন্তান সম্বোধন করেন মিল্টন। এসব ভিডিওর পাশাপাশি তার ফেসবুক পেইজে ১০টির বেশি মোবাইল ব্যাংকিং নম্বর রয়েছে, যেগুলোর মাধ্যমে অনুদান সংগ্রহ করেন তিনি। তার দাবি, ওই অনুদানেই চলে এসব কেন্দ্র।

গত কয়েকদিন ধরে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এসব কেন্দ্র ঘিরে অনিয়ম, বৃদ্ধদের চিকিৎসা না দেওয়াসহ নানান অভিযোগের খবর আসছিল। এরপর তৎপর হয় ডিবি। বুধবার সন্ধ্যায় মিরপুর থেকে মিল্টনকে গ্রেপ্তারের পর মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের কথা জানান গোয়েন্দা কর্মকর্তা হারুন অর রশীদ।

পরে তিনি বলেন, মিল্টন তার বাবাকে পেটানোর পর এলাকাবাসী তাকে পিটিয়ে এলাকা থেকে বের করে দেয়। এরপরে সে শাহবাগে ওষুধের দোকানে কাজ করত। পরে ওষুধ চুরি করার অভিযোগে কাজ হারায়। পরে কিছু লেখাপড়াও করে। গণমাধ্যমে এসেছে তার ওখানে অপারেশন থিয়েটার আছে। সে বেশিরভাগ লাশ রাতে দাফন করে। আশ্রমে বৃদ্ধদের চিকিৎসা দেওয়া হয় না বলে গণমাধ্যমে এসেছে। নিজেই ডেথ সার্টিফিকেট তৈরি করে ডাক্তারের সিল ছাপ্পড় জাল করে। সে ৯০০ লাশ দাফন করলেও ৮০০ লাশের ডকুমেন্ট দেখাতে পারেনি। যারা লাশের গোসল দিয়েছে তারা কিডনির পাশে রক্তের দাগও পেয়েছে। তাকে আমরা ডিজজ্ঞাসাবাদ করব তিনি ডেথ সার্টিফিকেট নেন না কেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধধান ক্ষেত পাহারারত তিনজনকে রাতে অপহরণ, সকালে উদ্ধার
পরবর্তী নিবন্ধপ্রধান আসামি কিশোর গ্যাং লিডার জুলুসহ গ্রেপ্তার ২