অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ : বিনয় পাঠের উৎকীর্তন

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী | বুধবার , ২১ ডিসেম্বর, ২০২২ at ১০:২০ পূর্বাহ্ণ


অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ স্যারের প্রয়াণ দিবসে তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনে বরেণ্য কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত’র ‘নাম’ কবিতার কয়েকটি পংক্তি উপস্থাপন করতে চাই। “চাই, চাই, আজো চাই তোমারই কেবলি। আজো বলি, জনশূন্যতার কানে রুদ্ধ কন্ঠে বলি আজো বলি- অভাব তোমার/ অসহ্য অধুনা মোর, ভবিষ্যৎ বন্ধ অন্ধকার,” বচনে নয়; শুদ্ধতার পরিশীলিত আচরণে মহান ব্যক্তিত্বের বিকাশমানতার প্রকৃত পরিচয়। সার্বিক দিক থেকে মনুষ্যত্ব-মানবিকতা-ধার্মিকতা-অসাম্প্রদায়িকতা-দেশপ্রেমের অত্যুজ্জ্বল মহিমায় নন্দিত খালেদ স্যার ছিলেন অনাবিষ্কৃত একটি বিশাল প্রতিষ্ঠান। কাছ থেকে যারা তাঁকে দেখেছেন বা বোঝার চেষ্টা করেছেন, তাদের উপলব্ধিতে খালেদ স্যার উপরোল্লেখিত কবিতার উচ্চারণে প্রতিনিয়তই উচ্চকিত।

সূফিতাত্ত্বিক দর্শনে মানব ধর্মের যেসব বৈশিষ্ট্যে ব্যক্তি গৌরবোজ্জ্বল আলোয় উদ্ভাসিত হয় তার মৌলিক অনুষঙ্গ হচ্ছে তাসাউফ বা তাকওয়া। এর মর্মার্থ বিশ্লেষণে যে সত্যটুকু নিরন্তর প্রতিষ্ঠিত তা হলো বিনয়ের শিক্ষা-পাঠ্যক্রম। অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ উক্ত পাঠশালার একজন পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষক শুধু নয়; তাঁর জীবনচরিতে এর বহিঃপ্রকাশ ছিল অতুলনীয়। অত্যন্ত সহজ সরল জীবন প্রবাহের আচ্ছাদনে একজন সাধারণ কীভাবে আকাশচুম্বী অসাধারণ সমাজমানস হতে পারেন অধ্যাপক খালেদ স্যার ছিলেন তারই প্রকৃষ্ট উপমা। নিজেরই অজান্তে নির্লোভ-নির্মোহ মানসিকতায় মানুষের হৃদয় জয় করার অপরিসীম কৃতাহ্নিক বলয় তৈরি করেছিলেন অধ্যাপক খালেদ।

শঠতা-প্রতারণা-মিথ্যাচার-পরাজীবী কথিত বুদ্ধিজীবীর আবরণে যারা বিভিন্ন পদ-পদবি-পদক দখলে ব্যতিব্যস্ত থাকেন, অধ্যাপক খালেদ ছিলেন এই ব্যতিক্রম পন্থার পুরোধা পথিকৃৎ। সর্বজনশ্রদ্ধেয় গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধিবৃত্তিক ঘরনার অগ্রগণ্য অভিভাবক-রাজনীতিক ও সৎ-সততার জ্ঞানাঙ্কুর আদর্শ স্থাপনে অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। বিশ্বকবি রবীঠাকুরের প্রার্থনা কবিতার ‘চিত্ত যেথা ভয়শূণ্য, উচ্চ যেথা শির, জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর/আপন প্রাঙ্গণতলে দিবসশর্বরী/বসুধারে রাখে নাই খন্ড ক্ষুদ্র করি, যেথা বাক্য হৃদয়ের উৎসমুখ হতে উচ্ছ্বসিয়া উঠে, যেথা নির্বারিত স্রোতে দেশে দেশে দিশে দিশে কর্মধারা ধায়/অজস্র সহস্রবিধ চরিতার্থতায়।’ – চরণসমূহ যেন স্বাধীন মাতৃভূমির প্রথম সংবাদপত্র দৈনিক আজাদীর প্রয়াত সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ স্মরণেই রচিত হয়েছে। মুক্তির মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক চেতনায় পরিপূর্ণ পরিপুষ্ট ছিলেন অধ্যাপক খালেদ। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধে অকুতোভয় সংগঠক হিসেবে খালেদ স্যারের সক্রিয় ভূমিকা ছিল কিংবদন্তীতুল্য।

সত্তরের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু গভীর উৎসাহ ভরে দেশের অত্যন্ত ক্ষমতাধর বিরোধী নেতার বিরুদ্ধে খালেদ স্যারকে মনোনয়ন দিয়েছিলেন। সততা-মেধা-যোগ্যতা-জনপ্রিয়তার শীর্ষে নির্বাচনে বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয়লাভ করে অধ্যাপক খালেদ বঙ্গবন্ধুকে সেই আসনটি উপহার দিয়েছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে মুজিব নগর সরকার গঠন-স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র পরিচালনা-দেশমাতৃকার মুক্তিতে খালেদ স্যারের অসামান্য কর্মযজ্ঞ শুধু চট্টগ্রামে নয়; বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে অনন্য অধ্যায় নির্মাণ করেছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নিরলস প্রচেষ্টার ফসল বাঙালি জাতিরাষ্ট্রের জন্য স্বল্প সময়ের মধ্যে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পবিত্র সংবিধান প্রণয়ন। বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য-আস্থাভাজন হিসেবে অধ্যাপক মোহাম্মদ খালদ স্যারও এই পবিত্র সংবিধান প্রণয়নের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব কার্যকর করার লক্ষ্যে খালেদ স্যারের গভর্নর নিযুক্তিতে তিনি বঙ্গবন্ধুর হৃদয়গভীরে কতটুকু প্রোথিত ছিলেন তা সহজেই অনুমেয়।

আধুনিক জ্ঞান সভ্যতার বিশ্বখ্যাত অবেক্ষক দর্শনশাস্ত্রের জনক মহাজ্ঞানী সক্রেটিসের মতানুসারে মূল্যবান পোষাক-পরিচ্ছদ বাইরের আবরণ মাত্র। মানুষের সত্যিকার সৌন্দর্য হচ্ছে হৃদয়ের গভীরে প্রকৃত জ্ঞানের চাষাবাদ। মানব কল্যাণে মাঙ্গলিক নিবেদনে প্রায়োগিক জ্ঞানের প্রসারমান পাদপীঠে অনবদ্য কৃতি দীপিকার স্বরূপ উম্মোচন করেছেন অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ। শুধু আত্মশুদ্ধিতে গুণাঢ্য জ্ঞান অর্জন নয়; আদর্শিক চেতনায় জ্ঞানসৃজন ও বিতরণে সামাজিক অসঙ্গতি পরাভূত করার লক্ষ্যে তাঁর সকল কর্মযজ্ঞই ছিল জ্ঞাপিত। চট্টগ্রামস্থ রাউজান উপজেলার সুলতানপুর গ্রাম আদি আবাসভূমি হলেও; ১৯২২ সালে ৬ জুলাই খ্যাতিমান উচ্চপদস্থ পিতার চাকুরির সুবাদে ভারতের বিহার প্রদেশের রাজধানি পাটনাতে তাঁর জন্ম। সামষ্টিক মানবী উড্ডীনকে জাগরুক রাখেই ধরিত্রীর চিরন্তন বিধি অনুসরণে ২০০৩ সালে বিজয় মাসের ২১ তারিখ শেষ গন্তব্যের ঠিকানা না ফেরার দেশে খালেদ স্যার ফিরে গেছেন। দেশমাতৃকার মুক্তির বিজয় মাসে তাঁর পরলোকগমন করুণ প্রয়াণ দিবসকে অধিকতর তাৎপর্যপূর্ণ করেছে। আপামর জনগণের মাঝে নিরন্তর নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য অমর গৌরবগাঁথায় সাজিয়েছেন যেন অপূর্ব জীবনোদ্যান। বিহার সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত থাকা পিতার কর্মজীবনের সারথি হয়ে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত এক বর্ণাঢ্য শিশু-কিশোর জীবন অতিবাহিত করেন। পরবর্তীতে স্থায়ী ভিটেবাড়িতে ফিরে এসে নৈসর্গিক এক পরিবেশে বাল্যজীবনের সুখবোধকে জাগ্রত করেছেন।

১৯৪০ সালে মেট্রিক পাস করে চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হয়ে শিক্ষা কার্যক্রমের মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ না রেখে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডেও অত্যুজ্জ্বল অবস্থান ধারণ করেন। কলেজ জীবনের পদচারণায় তিনি ভারত বিভাগ আন্দোলনে যুক্ত হয়ে রাজনীতিতে তাঁর ত্যাগপাঠ শুরু করেন। ১৯৪২ সালে কৃতিত্বের সাথে আইএ পাস করে ঢাকা ও আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করার আগ্রহ থাকলেও ‘হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা’ ও ‘ভারত ছাড় আন্দোলন’ ইত্যাদির কারণে সেখানে ভর্তি হতে না পেরে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে বিএ শ্রেণিতে ভর্তি হন। সেখানেই তৎকালীন শেখ মুজিবুর রহমান বর্তমানে ‘বাঙালির বঙ্গবন্ধু বিশ্ববন্ধু শেখ মুজিব’ খ্যাত বিশ্বখ্যাত সর্বোচ্চ মর্যাদাসীন রাজনীতিকের সান্নিধ্যে আসেন। পিতার মৃত্যুজনিত পারিবারিক শূন্যতায় চট্টগ্রামে ফিরে এসে চট্টগ্রাম কলেজে পুনরায় ভর্তি হয়ে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন।

পরিবারের আর্থিক অবস্থা কিছুটা নাজুক হয়ে পড়লে অর্থোপার্জনে নানামুখী কর্মে যুক্ত হন। পুনরায় কলকাতায় গিয়ে অর্থনীতিতে এমএ পড়ার ইচ্ছার অবদমন ঘটিয়ে তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলার স্যার আজিজুল হকের পরামর্শক্রমে নতুন প্রতিষ্ঠিত ইসলামের ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হয়ে ১৯৪৭ সালে এমএ পাস করেন। উল্লেখযোগ্য যে, কলকাতায় এমএ পড়াকালীন সময়ে আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করেন তাঁর শ্রদ্ধেয় মামা দৈনিক আজাদীর প্রতিষ্ঠাতা ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক। অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ শিক্ষাজীবনের পরিসমাপ্তি ও কর্মজীবনে প্রবেশ করে বিভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতায় পরিপুষ্ট হন। দেশলাইয়-ফাউনটেন পেন-প্রতিরক্ষা সনদ বিক্রির ব্যবসা, ‘ফ্রেন্ডস ষ্টোর’ নামে ডিপার্টমেন্টাল ষ্টোর প্রতিষ্ঠা-বাঁশ ও বেতের ফার্নিচারের ব্যবসা, ক্লিয়ারিং-ফরওয়ার্ডিং ব্যবসায় মনোনিবেশ করেও পরিপূর্ণ আত্মসন্তুষ্টি পূরণে ব্যর্থ হন।

পরবর্তী পর্যায়ে কিছু দিন প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন-রাউজান স্কুলের শিক্ষকতা এবং সর্বোপরি দীর্ঘ সময় নাজিরহাট কলেজে অধ্যাপনা করে জীবনযুদ্ধে ত্রৈরাশিক তপস্যায় নিয়োজিত হন। আন্দরকিল্লা টাউন কো-অপারেটিভ ব্যাংক এবং পরে গ্রীন্ডলেজ ব্যাংকে চাকুরি চলাকালে ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে ফ্রন্টের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় নেমে পড়েন। আবারও ব্যাংকে যোগদান করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অন্যায়ের সাথে আপস করার কলুষতাকে পরিহার করে ১৯৫৫ সালে ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে দিয়ে আবার শিক্ষকতায় ফিরে আসেন। জীবনের নির্মম বাস্তবতায় বারবার কঠিন সঙ্কটের মুখোমুখী দাঁড়িয়েও আদর্শ থেকে ন্যুনতম বিচ্যুত না হয়ে সকল ক্ষেত্রে সৎ-সত্যবাদিতা, নিষ্ঠা ও একাগ্রতার পরিচয়-পরিধি সমৃদ্ধ করেছেন। নানা কারণে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ভিন্ন কর্মসংস্থানের সাথে যুক্ত হয়েও নীতি-নৈতিকতার সাথে সৎ জীবন যাপনের অতুলনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন। এরই মধ্যে তাঁর জীবনাদর্শ ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেকের প্রস্তাবে কোহিনূর প্রেস ও সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘কোহিনূর’ প্রকাশে নিজেকে সমর্পণ করেন।

বাংলাদেশের কৃতিমানব অনগ্রসর মুসলমানদের শিক্ষায় অগ্রবর্তী হওয়া এবং কুসংস্কারমুক্ত অবাধ ধার্মিক ও অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার আচ্ছাদনে সমাজকে এগিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে ১৯৬০ সাল ৫ সেপ্টেম্বর দৈনিক আজাদী পত্রিকা প্রকাশ করেন। এই পত্রিকার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে সুষ্ঠু সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ একজন অকুতোভয় কলমযোদ্ধা হিসেবে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। ধারাবাহিকতায় আদর্শ-তীর্থ মামা ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক এর দ্বিতীয় মেয়ে বা মামাতো বোনকে বিয়ে করে সংসার জীবন শুরু করেন। অনুপম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক অধ্যাপক খালেদের মধ্যে নিখাদ গুণাবলীর প্রতিফলন দেখতে পান। পত্রিকা প্রকাশের দুই বৎসর পর ১৯৬২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর দৈনিক আজাদীর এই মহান প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক পরলোকগমন করলে অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদকে দৈনিক আজাদী পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্বভার গ্রহণ করতে হয়। গণমাধ্যম জগতে উজ্জ্বল তারকা হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি অধ্যাপক খালেদকে রাজনৈতিক জীবনে অত্যধিক সমৃদ্ধির উঁচুমার্গে পৌঁছে দেয়। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগ দিয়ে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনসহ পাকিস্তান বিরোধী প্রায় প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে নিবিড় ও সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ শেষরাত্রে বা ২৬ মার্চে প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণা পাঠের সঙ্গেও তাঁর সংশ্লিষ্টতা ছিল প্রশংসনীয়।

চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব ও চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠায় অধ্যাপক খালেদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব তাঁর এই অবদানের জন্য ২০১১ সাল থেকে ‘অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ স্মারক বক্তৃতা’ প্রবর্তন করে। প্রতিবছর তাঁর জন্মদিন উপলক্ষে নির্ধারিত বিষয়ে এই বক্তৃতা পর্ব অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। আমার ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণে; যে কোন সময় খালেদ স্যারের সাক্ষাতে তাঁর হাসিমুখ ও অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বরণ এবং আনন্দঘন আলাপচারিতার দৃশ্যপট এখনো অপরিমেয় অনুপ্রেরণা-প্রেষণার উপাদানরূপে বিবেচ্য। বিশ্ববিদ্যালয়সহ যে কোন শিক্ষককে ‘স্যার’ সম্বোধন ও কথোপকথনে তাঁর অমায়িক এবং হৃদয়গ্রাহী আকর্ষণীয় সম্ভাষণ সবাইকে বিমুগ্ধ করে রাখত। পবিত্র মাইজভান্ডার দরবার শরীফের সাথে সম্পৃক্ততায় বহু অনুষ্ঠানে আমাদের নানাবিধ আধ্যাত্মিক আলোচনা এবং আচার-অর্চণা দুজনকেই অনেক কাছের করে তুলেছে। আমাকে সমধিক স্নেহ ও সম্মান করে তাঁর পিতৃতুল্য ও শিক্ষকসুলভ মমতার প্রকাশ কখনো ভুলবার নয়।

তাঁর একটি বক্তব্য আমি প্রায় অনুষ্ঠানে প্রাসঙ্গিকতায় উদ্ধৃত করি। বক্তব্যটুকু ছিল এই – ‘একদিন আমাদের প্রিয় রাসুলে পাক (সাঃ) এর কাছে একজন ব্যক্তি তার ছেলেকে নিয়ে আসেন এবং রাসুলে পাক (সা:) কে প্রগাঢ় ভক্তির সাথে নিয়ে আসা সন্তানকে চিনি কম খাওয়ার পরামর্শদানের অনুরোধ করেন। রাসুলে পাক (সাঃ) অনেকক্ষণ চিন্তা করে উক্ত ব্যক্তিকে ছেলেকে নিয়ে সপ্তাহখানেক পরে আসতে বলেন। পরের সপ্তাহে উক্ত ব্যক্তি রাসুলে পাক (সা:) এর সম্মুখে তার আবেদন পুনরায় পেশ করলে রাসুলে পাক (সা:) তার ছেলেকে চিনি কম খেতে বলেন। বহুকষ্টে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে এই ভদ্রলোক রাসুলে পাক (সা:) এর দরবারে এসেছিলেন। কিছুটা ক্ষোভের সাথে ব্যক্তিটি রাসুলে পাক (সা:) কে বলেন, আপনি বিগত সপ্তাহে এই সামান্য কথাটুকু বলে দিলে আজকে আমাদের এত কষ্ট করে এখানে আর আসতে হতো না। জবাবে রাসুলে পাক (সাঃ) বললেন, দেখ বাবা – আমি বিগত সপ্তাহ পর্যন্ত নিজেই চিনি বেশি খেতাম। নিজে চিনি বেশি খেয়ে অন্যকে কিভাবে কম খেতে বলি ? গত এক সপ্তাহ ধরে আমি চিনি কম খাওয়ার অভ্যাস করেছি এবং গতকাল পর্যন্ত একেবারেই চিনি না খাওয়ার মতোই নিজেকে প্রস্তুত করেছি। যেহেতু আমি চিনি একবারেই কম খাচ্ছি, আজকে আমি অন্যকে চিনি কম খেতে বলতে পারছি।

প্রিয় রাসুলে পাক (সা:)’র এই অমূল্য বাণী শুনে উক্ত ব্যক্তি যারপরনাই লজ্জিত হলেন এবং দু:খ প্রকাশ করলেন। একই সাথে উপলব্ধি করতে পারলেন; নিজে যে কাজ করতে পারিনা সে কাজ অন্যকে করতে বলা সমীচীন নয় এবং তা নীতি-আদর্শ বহির্ভূত।’ খালেদ স্যার এই অমিয় কালামকে ধারণ করেই জীবন প্রতিপালনে উদ্বুদ্ধ হয়ে অন্যকেও উদ্বুদ্ধ করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলেন। আজকের এই প্রয়াণ দিবসে তাঁর আদর্শিক অভিভাবক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু, প্রিয় মামা ও শ্বশুর ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক এবং পরম শ্রদ্ধেয় স্যারের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। পূত-পবিত্র, ন্যায়-সত্যনিষ্ঠ এই মহান অবিস্মৃত কৃতাভিষেক রচয়িতা অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ দেশবাসীর হৃদয়ে দীর্ঘ সময় পরিগ্রাহক থাকবেন – দৃঢ়চিত্তে এই আশাবাদটুকু ব্যক্ত করছি।

লেখক : শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএক আলোকবর্তিকা
পরবর্তী নিবন্ধরাঙ্গুনিয়ায় দুই ভাই হত্যা মামলায় দুই ভাই গ্রেফতার