প্রায় বিলুপ্তির পথে গ্রামবাংলার ঐতিহ্য

রতন কুমার তুরী | সোমবার , ১৯ এপ্রিল, ২০২১ at ৬:০৭ পূর্বাহ্ণ

দূর অতীতের এদেশের গ্রামবাংলার বেশকিছু ঐতিহ্য এখনও মনে দোলা দেয়, তারমধ্যে প্রধান প্রধান হলো পালকি, ঢেঁকি, লাঙ্গল, তাঁতশিল্প, পালাগান ইত্যাদি। সেকালে বিয়ের সময় নতুন বর এবং কনেকে পালকিতে করে বরের বাড়িতে নেয়ার রেওয়াজ ছিলো। এসময় বেয়ারারা নানা রকম গান করতে করতে দূরের পথ পাড়ি দিতো। অবশ্য বড় জমিদার বাড়ির লোক জনেরাও পালকিতে চড়ে বিভিন্ন জায়গায় যাওয়ার রেওয়াজ ছিলো। তবে যে কোনো বিয়েতে পালকির ব্যবহার ছিলো আবশ্যিক। বিয়ের সময় বেয়ারাদের ব্যাপক কদর করা হতো তাদের জন্য রান্না করা হতো ভালো ভালো খাবার এর বাইরে তাদের জন্য বরাদ্দ হতো, চা,পান,তামাক ইত্যাদি। গ্রামের কোনো জমিদার কিংবা বড় লোকের বিয়ে হলে তো কথাই ছিলোনা বিয়ের মাস খানেক আগেই থেকেই বিয়ে বাড়িতে লেগে থাকতো আত্মীয়, স্বজন, পাড়া, প্রতিবেশিদের আসা যাওয়া। সবাই হৈহুল্লোড় করতো গানবাজনা করতো আরো কতো কী।
বিয়ে উৎসবের এ আমেজটা বরের বাড়ির চেয়ে কনের বাড়িতে একটু বেশিই হতো। বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরও আরো কিছুদিন বিয়ে বাড়িগুলোতে উৎসবের আমেজ লেগে থাকতো। বিয়ের পরও পালকির ব্যবহার ছিল, বিশেষ করে কনে যখন বাপের বাড়ি যেতো এবং বাপের বাড়ি থেকে বরের বাড়িতে আসতো ঠিক সে সময়গুলোতে। বর্তমানে বাঙালির এই ঐতিহ্যের অংশ পালকিকে তেমন একটা দেখা যায় না, পালকির এই জায়গাটা দখল করে নিয়েছে আধুনিক যুগের মটর গাড়ি। ফলে এই ঐতিহ্য আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে। এরপর প্রায় বিলুপ্তির পথে আছে গ্রাম বাংলার হ্যান্ড মেইড চাল, ধান, মুড়ি, মুড়কি চাপাই যন্ত্র ঢেঁকি। একসময় এই ঢেঁকির কদর ছিলো পুরো বাংলাজুড়ে। সারা বছরই ঢেঁকিতে চাল, ধান চাপাই করা হতো। চাল চাপাই করে চিড়া বানানো হতো ঢেঁকিতেই আর সে চিড়া দিয়ে বানানো হতো মোয়াসহ বিভিন্ন ধরনের সুস্বাদু খাবার। সেসময় ধানকে ঢেঁকিতে চাটাই করে চাল করা হতো এসব চালকে ঢেঁকিচাটা চাল বলা হতো। ঢেঁকিচাটা চাল অসম্ভব সুস্বাদু এবং বরকতময় ছিলো। এই ঢেঁকিতে চাল, ধান ভানার জন্য পাড়ার মহিলারা জটলা করে থাকতো এবং তারা বিভিন্ন গানের সুরে ঢেঁকিতে ধান, চাল ভানতো। তার গ্রাম্য একটি প্রবাদ এখনও প্রচলিত আছে, এটি এখনও সবাই মুখে মুখে বলে, ধান ভানতে শিবের গীত অর্থাৎ সেসময় গ্রামবাংলার নারীরা ঢেঁকিতে ধান ভানার সময় দীর্ঘ সময় কাটানোর জন্য শিবের গান করতো। এটে ধানও ভানা হতো আবার শিবের গীতও করা হতো। এই ঢেঁকি বানানো হতো একপ্রকার শক্তগাছকে সামনের দিকে একটু চোছালো করে। ঢেঁকির সামনের দিকটা একটু ভারি থাকে এবং নিচের দিকে নোয়ানো থাকে আর অপরপ্রান্ত থাকে অপেক্ষাকৃত কমভারি এবং চ্যাপ্টা প্রকৃতির, এই চ্যাপ্টা অংশতেই মেয়েরা পা দিয়ে চাপ দিয়ে সবকিছু,কাজ সমাধা করে। প্রকৃতপক্ষে ঢেঁকির প্রচলন তখন প্রায় প্রতিটি গ্রামে গ্রামে ছিলো।
গেরস্তের বউ ঝিরা ঢেঁকির ব্যবহারে বেশ পারদর্শি ছিলো। সেসময় বেশিরভাগ মানুষের জমি ছিলো বিধায়,তারা সারা বছর জমিতে চাষ করতো আর সেই ধান ঢেঁকতেই প্রক্রিয়াজাত করার মাধ্যমে বিভিন্ন কিছু করতো। বর্তমানে এই ঢেঁকির ব্যবহার কোথাও নেই বললে চলে, বর্তমানে এই ঢেঁকির স্থান দখল করে নিয়েছে বিভিন্ন ধান ভানার কলের মেশিন। ফলে এই ঐতিহ্যটিও আজ বিলুপ্ত প্রায়। উত্তরবঙ্গের কোনো অঁজ পাড়া গাঁয়ে ঢেঁকি এখনও কিছু দেখা গেলেও সেগুলো অচল প্রায়। একসময় বাংলাময় ছিলো গোলাভরা ধান, পুকুরভরা মাছ। এই গোলাভরা ধানের জমিতে চাষ করার জন্য সবার ছিলো গোয়াল ভরা গরু, কারণ গরু ছাড়া তখন জমিতে চাষ করে ফসল ফলানো সম্ভব ছিলোনা আর এই গরুর সাথে নাঙ্গল জুড়ে দিয়ে জমিতে ফসল ফলানো হতো। এই নাঙ্গল ছিলো মূলত লোহার ফাল বিশিষ্ট গাছের বাঁকানো একপ্রকার যন্ত্র যা দিয়ে জমিকে খোড়ার মাধ্যমে মাটি আলগা করা হতো এবং সেই জমিতে পানি এবং গোবর সার দিয়ে চাষ করা হতো। সেসময় নাঙ্গল ছিলো কৃষকদের জমিতে ফসল ফলানোর একমাত্র যন্ত্র। একটুকরো চ্যাপটা লোহাকে হাতল ওয়ালা গাছের মাথায় অত্যন্ত কায়দা এবং দক্ষতার সাথে লাগিয়ে বানানো হতো নাঙ্গল। এই ঐতিহ্যটি বাংলাদেশের অনেক জায়গায় এখনও দেখা গেলেও কলের ট্র্যাক্টর যেভাবে চাষের জমি খোড়ছে অদূর ভবিষতে এটাও যে হারিয়ে যাবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা কারণ দিনদিন মানুষ প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে কম সময়ে বেশি কাজ এবং ফলাফলের প্রত্যাশা করে যারফলে এসব ঐতিহ্যবাহী জিনিষ আর প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে একসময় বিলুপ্ত হয়ে যায়। তাঁতশিল্প গ্রামের প্রতিটি জায়গায় না থাকলোও কিছুকিছু জায়গায় চোখে পড়তো। সম্পূর্ণ নিজস্ব কাট এবং বাঁশের মাধ্য যন্ত্র বানিয়ে শাড়ি,শাল, লুঙ্গি, থামি ইত্যাদি বানানো হত। তাঁতশিল্প একসময় বাংলাদেশে বেশ নাম করেছিলো এটা একপর্যায়ে কুটির শিল্প বলা হতো কারণ এর সকল যন্ত্রপাতি ঘরে কিংবা কুটিরে স্থাপন করে চালানো যতো এবং এর আওতায় সবকিছু হাতের ছোঁয়ার মাধ্যমে তৈরি করা হতো। এই তাঁতশিল্প বাংলাদেশের কোথাও কোথাও চোখে পড়লেও মেশিনের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে নাপেরে বেশিরভাগই ওঠে গেছে। এখন এটি পার্বত্য চট্টগ্রামের কোথাও কোথাও দেখা যায়। এর বাইরেও গ্রামের মানুষে মানুষে স্নেহ, মায়া, মমতার বন্ধন এখন তেমন একটা দেখা যায়না, সবাই যেনো নিজ নিজ স্বার্থ নিয়েই ব্যস্ত। একসময় গ্রামের সব ছেলেরা মিলে ডাংগুলি, হাডুডু, কানামাছি খেলা কতোইনা মধুর ছিলো। বিকেল হলেই সব ছেলেরা মিলে মাঠে খেলতো এসব খেলা। এখন এসব খেলা খেলতে গ্রামেও কোনো ছেলেকে দেখা যায় না, এরা শুধু ব্যস্ত থাকে ক্রিকেট কিংবা মোবাইল গেইম নিয়ে। এভাবে হয়তো এই ঐতিহ্যটিও হারিয়ে যাবে। প্রকৃতপক্ষে যে কোনো জাতি তার পুরোনো ঐতিহ্য সমূহকে বাঁচিয়ে রাখতে সমষ্টিগতভাবে চেষ্টা করা উচিত। এবিষয়ে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।
লেখক : কলেজ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধলুকোচুরি
পরবর্তী নিবন্ধকরোনার দ্বিতীয় ঢেউ-সুরাহা এম.টি.টি.টি.ভি ব্যবস্থাপত্রে