কুনমিং লেইক পাড়ের ঘোরাঘুরি শেষে গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদের বাইন দুয়ারে দাঁড়িয়ে থাকা লি খাঁর শকটের দিকে সপুত্রক এগুতে এগুতে ভেবেছিলাম, এভাবে দীপ্রকে ভূতসন্ধ্যায় একাকী আমার খোঁজে পাঠানোর অবিমৃষ্যকারিতার জন্য স্ত্রীকে এক হাত নিয়ে নিবো। কিন্তু হায় তা তো আর পারিনি! বরং বরাবরের মতো মুখোমুখি হয়েছিলাম তিরস্কারের নাকি থাতানির। আসলে ঐব্যাপারটাকে তিরস্কার বললে এর সঠিক ব্যঞ্জনা ফুটে উঠে না, যেমন ফুটে ওঠে আঞ্চলিক কথা ধাতানি খাওয়াতে। হ্যাঁ ঐ ধাতানি খাওয়ার পর থেকে এই একটু আগ পর্যন্ত বাইরের ধোঁয়াশা আবহাওয়ার উপর নেমে আসা অন্ধকারের মতন মনটাও গুম হয়েছিল। এই মুহূর্তে মিস ইনার উচ্চারিত ‘হি ইজ মাই এলদার ব্রাদার’ বাক্যটির ঝলকানিতে সে আঁধারের কেটে গেল চকিতে। সাথে সাথেই মনে হল, কী যে একটা ভুল করলাম। মনের ভেতর গুমরানো রাগের কারণে, গাড়ি থেকে নেমে লি খাঁকে সাধারণ ভদ্রতা করে যে ধন্যবাদ দিতে হয়, তাও তো দেইনি!
দ্রুত সে ভুল শোধরানোর জন্য হাসিমুখে মিস ইনা কে বললাম, তাই বলো! উনি তোমার ভাই? তোমার ভাই যেহেতু ভাল তো হবেনই ! চল চল তাকে একটু বলে আসি যে কাল আর দেখা হচ্ছে না। কিন্তু তারপর দিন অবশ্যই দেখা হবে। তার গাড়িতে করেই যে যাবো এয়ারপোর্ট তাও বলে আসি। আসার পর থেকেই দেখছি, এমনিতেই চটপটে মিস ইনার মুখে সারাক্ষণই লেগে আছি হাসি। হ্যাঁ এ ধরনের হোটেলগুলো তাদের কর্মীদের হাসিমুখে থাকার ট্রেনিং যেমন দেয়, তেমনি হুকুমও দেয়। তাতে এসব জায়গায় হাসি মুখের জয়জয়কার না থাকলেও, ছড়াছড়ি থাকে। যদিও ঐ ছড়াছড়ি হাসির বেশীরভাগকে মনে হয় আমার মেকি, কোষ্ঠকাঠিন্য মার্কা হাসি! সে জায়গায় মিস ইনা অবশ্যই ব্যতিক্রম। তার হাসিটা কেন জানি বড়ই প্রাকৃতিক আর আন্তরিক মনে হয়, সকল সময়েই।
আর এখন যখনই গাড়ির ভাড়া মিটিয়ে লিফটের দিকে এগুনোর বদলে ফের লি খাঁর কাছে যাবো বলে জানালাম, তাতে মিস ইনার সেই হাসি ও দেহভঙ্গিতে মনে হল একটা বাড়তি আনন্দের নাকি সুখের মাত্রা যোগ হলো। হয়েছে তা আমার মতো এক অচেনা বিদেশীর মুখে নিজের ভাইয়ের প্রশংসা শুনতে পারার গর্বে। স্বল্পচেনা এই চায়না নারীর মুখের সেই আনন্দের ঝলকে, নিজমনের গুমোট ভাব কেটে গেল নিমিষে।
হোটেলের গেইট পেরিয়ে পিক আপ ড্রপ এলাকার দিকে তাকাতেই দেখি ওখানটায় যে সাময়িক পার্কিংলট আছে তাতে তার বাহন পার্ক করে, গাড়ির মাঝ বরাবর জায়গায় পিঠ লাগিয়ে ডান হাঁটু ভাঁজ করে পা’টি গাড়ির গায়ে ঠেকিয়ে ধ্যানি সারসের মতো একপায়ে দাঁড়িয়ে লি খাঁ একমনে হাতের নখ কাটছে দাঁতে। এইমাত্র গেইট পেরিয়ে আমরা বেরুলেও, নজরে পড়েনি তা তার।
এদিকে সারাদিন পর ভাইয়ের দেখা পাওয়ার আনন্দেই হোক কিম্বা আমার মতো বিদেশী লোকের সামনে ভাইয়ের ওরকম ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকাটা পছন্দ না হওয়াতে তাকে সতর্ক করার জন্য হোক, মিস ইনা গলা উঁচু করে মাতৃভাষায় চিং চাং চুং চাং করতেই ধড়মড় করে এটেনশন হয়ে গেলেন লি খাঁ। ব্যাপারটাকে পাত্তা না দিয়ে মিস ইনা কে পিছু ফেলে সামনে এগিয়ে গিয়ে লি খাঁর সাথে হাত মিলিয়ে বললাম, ভেরি হ্যাপি! অয়েল ডান! পেছনে মিস ইনার চিং চাং চু চাং চলছে তখনো।
এদিকে একটু আগে কিছু না বলে হুড়মুড় করে হোটেলে ঢুকে গিয়ে, ফের বোনসমেত আমার ঐরকম ফিরে আসা দেখে সম্ভবত ঘাবড়ে গিয়েছিল লি খাঁ। হাত মেলানোর সেময়ে টের পাচ্ছিলাম তা। এখন দেখছি বরাবর কুমড়াপটাশের মতো গোমড়া মুখের না হলেও, ভাবলেসহীন মুখ করে থাকা, লি খাঁর চেহারায় হাসির আভা। বোনের উদ্দেশ্যে মৃদুকণ্ঠে চুং চাং করতে করতে মাথা নড করলো লি খাঁ আমার উদ্দেশ্যে
নাহ, আর দেরী করার দরকার নেই। কাজের ফাঁকে আমার উসিলায় কিছুক্ষণের জন্য হলেও যে ভাইবোনের মধ্যে মোলাকাত হল, করুক তারা সেটির সদ্ব্যবহার। এদের মাঝে আমার আর উটকো ঝামেলা হয়ে থাকার দরকার নেই। আসলে বাংলা বোন আর চায়না বোনে পার্থক্য যে নেই কোনো, তা তো বুঝে গেছি এরই মধ্যে! (চলবে)
লেখক : প্রাবন্ধিক, ভ্রমণ সাহিত্যিক