কমে গেছে গ্যাসের চাপ, রান্নায় দুর্ভোগ

হালিশহরে পাইপ লাইন কেটে যাওয়ায় বিস্তৃত এলাকায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ

হাসান আকবর | রবিবার , ১২ জানুয়ারি, ২০২৫ at ৬:০১ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামে গ্যাসের চাপ মারাত্মকভাবে কমে গেছে। শীতের দাপটের পাশাপাশি কক্সবাজারের মহেশখালীতে এক্সিলারেট এনার্জি পরিচালিত এলএনজি ফ্লোটিং স্টোরেজ রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট (এফএসআরইউ) মেরামতে থাকায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। এতে পুরো পরিস্থিতি নাজুক হয়ে উঠে। অপরদিকে হালিশহরে খালের মধ্যে থাকা একটি ১০ ইঞ্চি ব্যাসের গ্যাস পাইপ লাইন কেটে যাওয়ায় হালিশহর, আগ্রাবাদ এবং খুলশীসহ বিস্তৃত এলাকায় গ্যাস সরবরাহ প্রায় পুরোটাই বন্ধ হয়ে রয়েছে। গ্যাস সংকটের কারণে চট্টগ্রামের বহু মানুষকেই হোটেল রেস্তোরাঁ থেকে খাবার কিনে খেতে হচ্ছে। হোটেল রেস্তোরাঁয়ও জুটছে না খাবার। কোনো কোনো পরিবার ইলেক্ট্রিক এবং মাটির চুলা ব্যবহার করেও রান্নাবান্নার কাজ সারছে।

সূত্র জানিয়েছে, চট্টগ্রামের গ্যাস সরবরাহ পুরোপুরি আমদানি নির্ভর। বিদেশ থেকে আমদানিকৃত এলএনজি সরবরাহ ঠিকঠাক থাকলেই চট্টগ্রামে গ্যাস থাকে। আমদানিকৃত এলএনজি সরবরাহের কোথাও ছন্দপতন ঘটলেই চট্টগ্রামে গ্যাসের যোগান থমকে যায়। কক্সবাজারের মহেশখালীতে এক্সিলারেট এনার্জি পরিচালিত এলএনজি ফ্লোটিং স্টোরেজ রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিটের (এফএসআরইউ) সংস্কারের জন্য গত শুক্রবার থেকে আগামীকাল সোমবার পর্যন্ত গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়েছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে সোমবার দুপুর ১২টায় গ্যাস সরবরাহ শুরু করার কথা রয়েছে। যা চট্টগ্রাম পর্যন্ত পৌঁছে সরবরাহ স্বাভাবিক করতে কয়েক ঘণ্টা সময় লাগবে।

কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (কেজিডিসিএল) দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা জানান, দুইটি এলএনজি টার্মিনাল থেকে চট্টগ্রাম হয়ে ন্যাশনাল গ্রিডে গ্যাস যায়। এরমধ্যে একটি টার্মিনাল পুরোপুরি বন্ধ থাকায় গ্যাস সরবরাহ অর্ধেকে নেমে আসে। এতে করে চট্টগ্রামে গ্যাসের যোগান স্বাভাবিকভাবেই কমে যায়। এছাড়া শীতের সময় গ্যাসের চাপ স্বাভাবিকভাবেই কম থাকে। বর্তমানে প্রচণ্ড শীতের কারণে গ্যাসের চাপ কমে গেছে। একদিকে গ্যাসের সরবরাহ অর্ধেকে নেমে যাওয়া এবং অপরদিকে শীতের দাপট থাকায় চট্টগ্রামে গ্যাসের হাহাকার শুরু হয়েছে। মহেশখালী থেকে এলএনজি না আসলে চট্টগ্রামে অন্য কোনো সোর্স থেকে গ্যাস আসার কোনো পথ নেই বলেও তিনি স্বীকার করেন। বলেন, আগে কুমিল্লা অঞ্চলের যে গ্যাস আশুগঞ্জবাখরাবাদ পাইপ লাইন হয়ে আসতো তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এখন কোনো কারণে এলএনজি আমদানি ব্যাহত হলে চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবে।

কেজিডিসিএলএর অপর একজন কর্মকর্তা বলেন, চট্টগ্রামে ৩৫০ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো গ্যাসের চাহিদা রয়েছে। তবে দুটি সার কারখানা চট্টগ্রাম ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড (সিইউএফএল) ও কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানি (কাফকো) বন্ধ থাকায় গত কয়েকদিন ধরে ২৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পেলেই চট্টগ্রামের পরিস্থিতি কোনোরকমে সামাল দেয়া যাচ্ছে। তবে মহেশখালীর দুইটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনালের একটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চট্টগ্রামে এখন ২০০ থেকে ২২০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস দেয়া হচ্ছে। এতে গ্যাসের চাপ কমলেও কোনোরকমে সামলে নেয়া সম্ভব হচ্ছে বলে ওই কর্মকর্তা দৈনিক আজাদীকে জানিয়েছেন।

এদিকে চাহিদা অনুষায়ী গ্যাস না থাকায় চট্টগ্রামে রান্না ঘরের চুলা থেকে শুরু করে কলকারখানা এবং সিএনজি রিফুয়েলিং স্টেশনসহ সর্বত্রই কমবেশি সংকট চলছে। চট্টগ্রামের প্রায় ৬ লাখ আবাসিক গ্রাহক, ৬০টিরও বেশি সিএনজি রিফুয়েলিং স্টেশন এবং অগুনতি বাণিজ্যিক এবং শিল্প গ্রাহক নানাভাবে ভোগান্তিতে পড়েছেন। বিশেষ করে রান্নাবান্নার চুলাগুলো দিনের শুরুতে বন্ধ হয়ে যায়। সকালের নাস্তা এবং দুপুরের রান্নাবান্না করতে অনেকেই এলপিজি সিলিন্ডার কিনে ঘরে নিচ্ছেন। সামর্থ্যবানেরা এলপিজি সিলিন্ডার কিনে পরিস্থিতি সামাল দিলেও সামর্থ্যহীনদের দুর্ভোগ চরমে। কেউ কেউ ঘরের মধ্যে ইটের চুলা বানিয়ে রান্নাবান্না সারছেন। এতে শুধু ভোগান্তিই নয়, একই সাথে বাড়ছে ঝুঁকিও। শহুরে বাসাবাড়িতে কয়লা বা কেরোসিনের চুলা জ্বালিয়ে রান্নাবান্নার সুযোগ সীমিত বলেও সূত্রগুলো মন্তব্য করেছে।

অপরদিকে মড়ার উপর খাড়ার ঘাঁর মতো একটি পাইপ লাইন কেটে যাওয়ায় নগরীর জনবহুল এবং গুরুত্বপূর্ণ কিছু এলাকায় গ্যাস সরবরাহ প্রায় পুরোটাই বন্ধ হয়ে গেছে। কেজিডিসিএল এর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নগরীর হালিশহরের বড়পোল এলাকায় খালের মধ্যে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কাজ করার সময় দুর্ঘটনাবশত ১০ ইঞ্চি ব্যাসের একটি সঞ্চালন পাইপ লাইন কেটে গেছে। গত বৃহস্পতিবার রাতে সংঘটিত এই ঘটনার পর পুরো হালিশহর, আগ্রাবাদ এবং খুলশী থানা এলাকার গ্যাস সরবরাহ বিঘ্নিত হচ্ছে। এতে কোনো কোনো এলাকায় গ্যাস পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। কোনো কোনো এলাকায় মিটমিট করে জ্বলছে।

ক্ষতিগ্রস্ত পাইপলাইনটি জরুরি ভিত্তিতে মেরামতের কাজ চলছে বলে উল্লেখ করে কর্ণফুলী গ্যাসের কর্মকর্তারা জানান, আজকের মধ্যে এই পাইপ লাইন পুনঃস্থাপনের কাজ সম্পন্ন হবে। তবে এলএনজি যোগান স্বাভাবিক না হলে এসব জায়গায়ও গ্যাসের চাপ স্বাভাবিক হবে না বলে তারা জানান।

শুধু আগ্রাবাদ, হালিশহর বা খুলশীই নয়, নগরীর দেওয়ান বাজার, পূর্ব নাসিরাবাদ, ষোলশহর, আসকার দীঘির পাড়, বাকলিয়া, কোতোয়ালী থানাধীন বিভিন্ন এলাকায় গ্যাসের সংকট বিরাজ করছে। গ্যাসের চাপ কমে যাওয়ায় বিভিন্ন স্থানে রান্নাবান্না বন্ধ হয়ে গেছে।

কর্ণফুলী গ্যাসের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা বলেছেন, মহেশখালীর ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল ঠিকঠাকভাবে চালু হলে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে। তবে শীতের দাপট থাকলে গ্যাসের চাপ স্বাভাবিকভাবেই কম থাকবে। বিষয়টিতে কারো কোনো হাত নেই বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

উল্লেখ্য, দেশে বর্তমানে গ্যাসের চাহিদা প্রায় ৩ হাজার ৮শ মিলিয়ন ঘনফুট। দেশের গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে উত্তোলিত এবং আমদানিকৃত এলএনজি মিলে দেশে বর্তমানে ২ হাজার ৮শ থেকে ৩ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ দেয়া হয়। এর মধ্যে ২৫ শতাংশেরও বেশি যোগান আসে আমদানিকৃত এলএনজি থেকে। এতে করে এলএনজি আমদানি ব্যাহত বা কোনো কারণে সরবরাহে ধস নামলে সারাদেশেই গ্যাস সেক্টরে সংকট প্রকট হয়ে উঠে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৩০০ বস্তা টিএসপি সার ‘পাচারকালে’ ট্রাকসহ আটক ৪
পরবর্তী নিবন্ধএকদিনের ব্যবধানে তাপমাত্রা বেড়েছে ২ ডিগ্রি