প্রজ্ঞাবান রাজনীতিবিদ আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু

বোরহান উদ্দিন চৌধুরী মুরাদ | সোমবার , ৪ নভেম্বর, ২০২৪ at ৮:২০ পূর্বাহ্ণ

আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর মতো বড়মাপের মহৎ হৃদয় জাতীয় নেতার সাহচর্য লাভের সুযোগ যাঁর হয়েছে, তিনি সৌভাগ্যবান। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমি তাঁর অভিভাবকত্বে তাঁর সঙ্গে রাষ্ট্রের সেবামূলক কাজ করেছি এবং তাঁর সেবা করার সুযোগ পেয়েছি। আমি তাঁকে অনেক কাছ থেকে দেখেছি, মিশেছি। সুখদুঃখের সঙ্গী হয়েছি। আমি দেখেছি তাঁর মধ্যে এক নরম প্রকৃতির হৃদয়, মানুষকে ভালোবাসার উদার মনমানসিকতা। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু সব লোভলালসার ঊর্ধ্বে উঠে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ নির্মাণের সম্মুখ সৈনিক ছিলেন। তিনি স্বাধীনতাউত্তরকালের সেই সব বিরল রাজনীতিবিদের অন্যতম, যাঁরা আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে হাল ধরেছেন। রাজনীতি করেছেন নিজের অর্থ ব্যয় করে। বর্ষীয়ান আওয়ামী লীগ নেতা মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ছিলেন এমনই এক অসাধারণ মহান পুরুষ। ১৯৪৫ সালে আনোয়ারার হাইলধর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু। তাঁর বাবার নাম নুরুজ্জামান চৌধুরী। তিনি ছিলেন আইনজীবী এবং জমিদার। তাঁর মায়ের নাম খোরশেদা বেগম। তিনি বাংলাদেশের স্বনামধন্য শিল্পপতি, চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর জমিদার সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর কন্যা নুর নাহার জামানের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।

তিনি ব্যক্তিজীবনে তিন পুত্র ও তিন কন্যা সন্তানের জনক। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ১৯৫৮ সালে পটিয়া হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। একই বছর ঢাকা নটর ডেম কলেজে ভর্তি হন। ইন্টারমিডিয়েটে পড়ার সময় তিনি বৃত্তি পেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে ভর্তি হন। পরে তিনি নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে পড়াশোনা করেন। সেখান থেকে অ্যাসোসিয়েট ডিগ্রি নিয়ে ১৯৬৪ সালের ডিসেম্বরে দেশে ফেরেন। ১৯৬৫ সালে তিনি বড় ভাইয়ের সঙ্গে ব্যবসায় যোগ দেন।

এ ছাড়া দেশে থাকা অবস্থায় ১৯৫৮ সালে দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের সদস্য নির্বাচিত হন আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু। এরপর দেশে ফিরে আবার ১৯৬৭ সাল থেকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাঁর পথচলা শুরু। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি আনোয়ারা ও পশ্চিম পটিয়া থেকে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন।

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু। চট্টগ্রামের রাজনীতিতে তিনি প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। দীর্ঘ সময় ধরে ছিলেন দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। চারবার জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পাশাপাশি ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য। নবম জাতীয় সংসদে তিনি ছিলেন পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি।

মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে অসহযোগ আন্দোলনের সময় তাঁর পাথরঘাটাস্থ জুপিটার হাউস থেকে সংগ্রাম কমিটির কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতো। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা চট্টগ্রামে আসার পর জুপিটার হাউস থেকে সাইক্লোস্টাইল করে প্রচার করা হয়। তাঁর বাসা থেকে স্বাধীনতার ঘোষণাটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রসহ সব জায়গায় পাঠানো হয়। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ভারতে গমন করেন এবং সেখানে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন। তিনি মুজিবনগর সরকারের ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটির সদস্য ছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন। বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠন ছিল তাঁর মূল লক্ষ্য। তিনি প্রথম লন্ডনে যান। সেখান থেকে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের সদস্য হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যান।

১৯৭০ সালের প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য (এমপিএ) হিসেবে আখতারুজ্জামান চৌধুরী ১৯৭২ সালে গঠিত বাংলাদেশ গণপরিষদের সদস্য হন এবং বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নে ভূমিকা রাখেন।

স্বাধীনতার পর ১৯৮৬, ১৯৯১ ও ২০০৮ সালে তিনি জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। স্বাধীনতার পর আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় শিল্প ও বাণিজ্য সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন।

আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে তিনি কারানির্যাতন ভোগ করেন। তিনি দুই দফায় চট্টগ্রাম চেম্বারের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ১৯৮৮ সালে তিনি দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ওআইসিভুক্ত দেশগুলোর চেম্বারের প্রেসিডেন্ট হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৯ সালে তিনি ৭৭ জাতি গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তিনিই একমাত্র বাংলাদেশি, যিনি এই মর্যাদাপূর্ণ আন্তর্জাতিক সংস্থার ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন।

আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু একজন সমাজহিতৈষী, দানবীর ও জনদরদি ছিলেন। ১৯৬৭ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি হাইলধর ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত চেয়ারম্যান ছিলেন। স্বাধীনতার পরেও তিনি হাইলধর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং থানা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। আনোয়ারা ডিগ্রি কলেজ, যোগেশ চন্দ্র মেমোরিয়াল ট্রাস্ট, হাইলধর বশিরুজ্জামান উচ্চ বিদ্যালয়, বরুমচড়া বশিরুজ্জামান উচ্চ বিদ্যালয় ও ঝিবাশি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতাসহ বটতলী মোহছেন আউলিয়া ডিগ্রি কলেজ, চন্দনাইশ বরমা কলেজ, এনায়েত বাজার মহিলা কলেজ, এ জে চৌধুরী ডিগ্রি কলেজ, রায়পুর উপকূলীয় উচ্চ বিদ্যালয়সহ আনোয়ারা, পশ্চিম পটিয়া ও চট্টগ্রামের অনেক স্কুলকলেজের প্রতিষ্ঠাতা ও দাতা সদস্য। এ ছাড়া বহু জনহিতকর কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তিনি। রাজনীতিতেই নয়, আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু একজন সফল ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তা ছিলেন।

স্বাধীনতার আগে তিনি বাটালী রোডে রয়েল ইন্ডাস্ট্রি নামে একটি কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। একই সঙ্গে তিনি বড় ভাইয়ের কারখানাগুলোও দেখাশোনা করতেন। পরবর্তী সময়ে আখতারুজ্জামান বাবু আসিফ স্টিল মিল, জাভেদ স্টিল মিল, আসিফ সিনথেটিক, প্যান আম বনস্পতি, আফরোজা অয়েল মিল, বেঙ্গল সিনথেটিক প্রডাক্ট ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ভ্যানগার্ড স্টিল মিল, সিনথেটিক রেজিন প্রডাক্ট ক্রয় করে স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশের প্রথম দুই দশকে জামান শিল্পগোষ্ঠীর গোড়াপত্তন করেন। তিনি বিদেশি মালিকানাধীন আরামিট মিল ক্রয় করে সেটিকে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করান। বাংলাদেশে বেসরকারি ব্যাংকিং সেক্টর প্রতিষ্ঠায় তিনি পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন। তিনি দেশে দ্বিতীয় প্রাইভেট ব্যাংক ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেডের (ইউসিবিএল) উদ্যোক্তা এবং প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু দেশের ব্যবসায়ী সমাজের মুখপাত্র ও ব্যবসায়ী নেতা হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

রাজনীতিতে যেমন; ব্যবসা, ব্যাংক, বীমা ও শিল্প স্থাপনেও তিনি ছিলেন একজন ঈর্ষণীয় সফল ব্যক্তিত্ব। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তিনি ছিলেন একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তাঁর অবদান অপরিসীম। যেকোনো কঠিন সময়ে দলের জন্য তিনি ছিলেন নিবেদিত এক কর্মী। ছিলেন চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের একজন অভিভাবক।

২০২১ সালে মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে স্বাধীনতা পদক (মরণোত্তর) অর্জন করেন। এই প্রজ্ঞাবান রাজনীতিবিদ, শিল্পোদ্যোক্তা ও সমাজসেবকের ১১তম মৃত্যুবাষির্ষকীতে জানাই শ্রদ্ধা।

লেখক : মরহুম আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু এমপির সাবেক একান্ত সচিব।

পূর্ববর্তী নিবন্ধটেকসই উন্নয়নের জন্য নিরাপদ সড়ক অপরিহার্য
পরবর্তী নিবন্ধসংস্কারের রূপরেখায় আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন