পরিবেশ দূষণরোধে সচেতনতা বাড়াতে হবে

তরুণ কান্তি বড়ুয়া | সোমবার , ৫ জুন, ২০২৩ at ৬:০৫ পূর্বাহ্ণ

পরিবেশ বলতে আমরা এমন একটা বিষয়কে বুঝি যা পারিপার্শ্বিক প্রকৃতির মাঝে মানুষ, প্রাণীকুল, গাছপালা, নদীনালা, পাহাড় পর্বত, সাগর ইত্যাদি সবকিছুকেই টিকে থাকতে সহায়তা করে। আমাদের চারপাশে স্বাস্থ্যসম্মত যেসব উপাদান আছে তা সব নিয়েই আমাদের পরিবেশ। অর্থাৎ কৃত্রিম উপায়ে নয়, প্রাকৃতিক ভাবে যেসব বস্তু আমাদের চারপাশে রয়েছে যেমন গাছপালা, পশুপাখি, জীবজন্তু, মাটি, পানি, বায়ু, সূর্যের আলো, মানব সমাজসব মিলিয়েই আমাদের পরিবেশ। পরিবেশ শব্দটি পৃথিবী এবং পৃথিবীর অন্যান্য উপাদান বা উৎসের সাথে সম্পৃক্ত। পরিবেশের সংজ্ঞা বলতে মানব জীবনের সাথে জড়িয়ে থাকা জীবন্ত বা জীবন বিহীন উপাদান, তাদের প্রভাব ও প্রতিক্রিয়াকে বুঝিয়ে থাকে। প্রকৃতি বলতে আনন্দ সৌন্দর্যের সমাহারকে বুঝায় আর পরিবেশ হলো সেসব বাহ্যিক অবস্থার সমষ্টি যা জীবনের বৃদ্ধি ও সমৃদ্ধিকে প্রভাবিত করে। আমাদের পরিবেশ দুইভাগে বিভক্ত। ক) প্রাকৃতিক বা ভৌত পরিবেশ, ) কৃত্রিম পরিবেশ বা মানবসৃষ্ট পরিবেশ

প্রকৃতির উদারভাবে দান করা আমাদের চারপাশে যেসব উপাদান রয়েছে সেসব উপাদান নিয়ে প্রাকৃতিক পরিবেশ গঠিত। প্রাকৃতিক পরিবেশের উপাদানগুলো হলো মানুষ, মাটি, পানি, বাতাস, পশুপাখি, জীবজন্তু, নদী, সাগর, পাহাড়, মরুভূমি ইত্যাদি। যে পরিবেশ মানুষ সৃষ্টি করেছে সে পরিবেশই সামাজিক /কৃত্রিম বা মানবসৃষ্ট পরিবেশ। মানবসৃষ্ট পরিবেশ হলো বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, পোষাক পরিচ্ছদ, নৌকা, ট্রেন, উড়োজাহাজ, রকেট, মহাকাশযান ইত্যাদি।

পরিবেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ উপাদান রয়েছে। বিভিন্ন উপাদানের সাথে ক্ষতিকর পদার্থের মিশ্রণে পরিবেশ দূষিত হয়ে থাকে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় পরিবেশ দূষিত হলেই পরিবেশ দূষণ ঘটে থাকে। এসবের মধ্যে বায়ু দূষণ, শব্দ দূষণ, পানি দূষণ ও মৃত্তিকা দূষণ অন্যতম। উল্লেখিত দূষণগুলোর মাধ্যমে পরিবেশ যেমন ভীষণ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তেমনি এগুলো মানব দেহের উপর প্রভূত ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে থাকে। পরিবেশ দূষণের ফলে পরিবেশে স্বাভাবিক ভারসাম্য নষ্ট হয় যার ফলে জীব জগতের স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশ বহুলাংশে বিঘ্নিত হয়। দূষণ বিভিন্ন উপায়ে হয়ে থাকে, যেমন প্রাকৃতিক উপায়ে আগ্নেয়গিরির উদগীরণকৃত ধোঁয়া, লাভা ইত্যাদির মাধ্যমে, তাছাড়া মানবসৃষ্ট দূষণ, কলকারখানা থেকে নির্গত ধোঁয়া বা বজ্য যা বাতাস, পানি ও ভূমি মধ্যে দূষণ সৃষ্টি করে। মানুষের ব্যবহৃত অনেক বস্তুই পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী। যেমন মোটর যান থেকে ধোঁয়া নির্গমন নলের মাধ্যমে ছড়ানো দূষিত ধোঁয়া, বিদ্যুৎ সৃষ্টিতে পোড়ানো কয়লার ধোঁয়া বায়ু দূষণ ঘটিয়ে থাকে। তাছাড়া শিল্প কারখানা বা বসত বাড়ি থেকে যত্রতত্র ফেলে দেওয়া বজ্য সমূহ, অসচেতনভাবে নালা নর্দমায় বা ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগে ফেলা বর্জ্যসমূহ বায়ু বা পানির দূষণ সৃষ্টি করে।

আমাদের দেশে মানুষ প্রকৃতির পরিবেশ দূষণ নিয়ে সচেতন নয় বললেই চলে। বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে পরিবেশ দূষণ নিয়ে অনেক সতর্কবার্তা প্রচার হওয়া সত্ত্বেও উদাসীনতার ফলে পরিবেশ দূষণ আমাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে যার ফলে পরিবেশ দূষণ রোধ বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। পানি নিষ্কাশনের ড্রেনগুলো সাধারণত জলাশয়ের সাথে সংযুক্ত থাকার কারণে শহর, হাটবাজার, বাসাবাড়ির ময়লা আবর্জনা ও বিভিন্ন প্রাণীর মলমূত্র খালবিল নদীতে পড়ে নদী কিংবা জলাধারের পানিতে দূষণ ঘটাচ্ছে। এর ফলে পানির সাথে বায়ু দূষণও ঘটাচ্ছে। কাজেই পানি দূষণ রোধ করার জন্য প্রতিটি শিল্প কারখানার সাথেই ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট(ই টি পি)স্থাপন অত্যাবশ্যক ও বাধ্যতামূলক করা উচিৎ। এছাড়া বাড়ির ময়লা আবর্জনা অসচেতন ভাবে নালা নর্দমায় ফেলা হয় যা সাগর কিংবা নদীতে গিয়ে পানি দূষণ ঘটায়। কাজেই ময়লা আবর্জনা পানিতে না ফেলে নির্দিষ্ট স্থানে ফেলা হলে তাতে পানি এবং বায়ুর দুটো দূষণই রোধ করা যাবে।

শুষ্ক ঋতুতে মানুষ আবর্জনা সংগ্রহের পর তা পুড়িয়ে নষ্ট করে থাকেন। এ থেকে নির্গত ধোঁয়া পরিবেশের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এছাড়া ধুমপানও বায়ু দূষণের অন্যতম কারণ। ইদানীং আমাদের দেশে ফ্যানের পরিবর্তে এয়ার কন্ডিশনারের ব্যবহার অনেক গুণ বেড়ে গেছে। এসব এসি ব্যবহারে প্রচুর পরিমাণে বিদ্যুৎ খরচ হয় এবং এ থেকে অনেক তাপ নির্গত হয় যা পরিবেশ দূষণে যথেষ্ট প্রভাব ফেলে। ঘরবাড়ি, কল কারখানার ফায়ার প্লেস থেকে প্রচুর পরিমাণে গ্যাস নির্গত হয় যা বায়ু দূষণের জন্য দায়ী। অন্যদিকে জমিতে পোকা নিধনের জন্য যে কীটনাশক ব্যবহার করা হয় তা মাটি, বায়ু ও পানি, এই তিন ক্ষেত্রকে দূষিত করে। বাস ট্রাক. রেলগাড়ি, লঞ্চ, স্টিমার, হাইড্রোলিক হর্ণের শব্দ, বিমানের বিকট শব্দ, শিল্লকারখানা, ইট পাথর ভাঙার শব্দ, মাইকের শব্দ, ঢাকডোল পেটানোর শব্দ শব্দ দূষণ ঘটায়। বায়ু দূষণ শ্বাসকষ্ট জনিত রোগের কারণ হতে পারে। এর ফলশ্রুতিতে ঘটে থাকে হাঁপানি, ব্রঙ্কাইটিস ও ক্যানসারের মতো জীবন বিধ্বংসী রোগগুলো। তাছাড়া পানি দূষণের ফলে কলেরা, টাইফয়েড ও আমাশয়ের মতো রোগের বৃদ্ধি ঘটে। ভূমি দূষণের ফলে মাটির ক্ষয় ও প্রাকৃতিক আবাসস্থল ধ্বংস হয়ে থাকে।

সুস্থ জীবন যাপনের জন্য একটি স্বাস্থ্যকর পরিবেশের প্রয়োজন। সুতরাং আমাদের উচিৎ সর্বপ্রকারে পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখা। সাধারণ জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করণ এবং পরিবেশ সংরক্ষণে সরকার কর্তৃক গৃহীত প্রতিটি উদ্যোগ সফল করতে পারলে পরিবেশ দূষণ অনেকাংশে রোধ করা সম্ভব হবে। কাজেই স্বাস্থ্যকর জীবন যাপনের জন্য পরিবেশের গুরুত্ব অপরিসীম। আর সুস্থ জীবন যাপন করতে আমাদের নির্মল বাতাস, পরিষ্কার পানি এবং মুক্ত বিশুদ্ধ প্রকৃতির প্রয়োজন। প্রকৃতি থেকে আমরা অনেক উপাদান পেয়ে থাকি যা স্বাস্থ্যসম্মত জীবন যাপনে আমাদেরকে প্রভূত সাহায্য করে থাকে।

প্রকৃতির পরিবেশ ও সকল উপাদানের সাথে মানুষের রয়েছে এক নিবিড় সম্পর্ক। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হচ্ছে যে আমরা মানুষরাই দিন দিন আমাদের পরিবেশকে ভীষণ বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছি। আমাদের বেঁচে থাকার জন্য অতীব প্রয়োজনীয় পানি, খাদ্য ও বায়ুর মতো অপরিহার্য উপাদানগুলো আমরা দূষণের হাত থেকে রক্ষা করতে পারছি না। মানুষের অসাবধানতা ও লোভের কারণে প্রতিনিয়তই দূষিত হচ্ছে আমাদের চারপাশের পরিবেশ। বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, দূষণ ও পরিবেশগত ঝুঁকির কারণে যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত তার অন্যতম একটি হলো বাংলাদেশ এবং এদেশে প্রতি বছর যত মানুষের মৃত্যু হয় তার ২৮ শতাংশ মারা যায় পরিবেশ দূষণ জনিত বিভিন্ন রোগের কারণে।

পৃথিবীর আবহাওয়া ও জলবায়ুতে পরিবেশ দূষণের মারাত্মক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। যার ফলে বৃষ্টির সময়ে অনাবৃষ্টি, খরার সময়ে বৃষ্টি কিংবা শীতের সময়ে গরম। একইসাথে গ্রীণহাউস প্রতিক্রিয়ার কারণে বেড়ে চলছে বৈশ্বিক তাপমাত্রা যা বাংলাদেশের মতো দুর্যোগপূর্ণ দেশগুলোর জন্য একটা অশনিসংকেতই বটে। জাতিসংঘের সতর্কীকরণ বার্তায় বলা হয়েছে পরবর্তী ৫০ বছরে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৩ ফুট বাড়লে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ১৭ শতাংশের মতো ভূমি পানির নিচে তলিয়ে যেতে পারে। কাজেই আমাদের পরিবেশ ও জলবায়ুতে ভারসাম্য রক্ষা করে সুস্থ সুন্দর পরিবেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে আমাদেরকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। এই পৃথিবীকে আমাদের এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য করে রাখতে হলে পরিবেশ সংরক্ষণে আমাদেরকে বলিষ্ঠ উদ্যোগ গ্রহণে ব্রতী হতে হবে। তাছাড়া পরিবেশ দূষণ রোধ করতে হলে আমাদের অবশ্যই দূষণকারী পদার্থের নির্গমন ও ক্ষতিকারক রাসায়নিকের নির্গমন কমাতে হবে। পরিবেশ দূষণের কারণগুলো চিহ্নিত করে দূষণ প্রতিরোধে স্বচ্ছ ধারণা লাভ করতে হবে। সবার জন্য স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আমাদের যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। দেশের জনগণকে যথার্থভাবে শিক্ষিত করে গড়ে তুলে সবার মধ্যে পরিবেশ সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।

লেখক : সাবেক অধ্যক্ষ, রাঙ্গুনিয়া সরকারি কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধইটের বিকল্প পরিবেশবান্ধব সাশ্রয়ী কংক্রিট ব্লক ব্যবহার প্রসঙ্গে
পরবর্তী নিবন্ধজয় বাংলা শিল্পীগোষ্ঠী চট্টগ্রামের সভা