ইটের বিকল্প পরিবেশবান্ধব সাশ্রয়ী কংক্রিট ব্লক ব্যবহার প্রসঙ্গে

জিয়া হাবীব আহসান | সোমবার , ৫ জুন, ২০২৩ at ৬:০৪ পূর্বাহ্ণ

সরকার ইট প্রস্তুত ও ইট ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন২০১৩ প্রণয়ন করেছে। কিন্তু এ আইনের পুরোপুরি বাস্তবায়ন এখনও সম্ভব হয়নি। আইনে যেসব ক্ষমতা দেয়া আছে সেসব ক্ষমতা প্রয়োগ না করার ফলে আইনের এরকম বরখেলাপ চলছেই। আইনে আছে, জেলা প্রশাসকের লাইসেন্স বা অনুমতি ছাড়া কোনো ইট ভাটা স্থাপন করা যাবে না (৪ ধারা)। কিন্তু দেশের সব ইট ভাটার অনুমোদন নেই। চাষযোগ্য জমির উপরিভাগের মাটি ইটভাটায় ব্যবহারের কারণে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ছে। ফলে ২০৩০ সালের মধ্যে জাতিসংঘ ঘোষিত লাগসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা, পুষ্টি ও কৃষিতে টেকসই উন্নয়ন বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ইটভাটা থেকে মারাত্মক পরিবেশ দূষণ হওয়ায় তা থেকে মুক্তি পেতে আমাদের রোডম্যাপ নিয়ে অগ্রসর হতে হবে। নির্মাণ কাজে পরিবেশবান্ধব কংক্রিট ব্লকের বহুল ব্যবহার একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। অবৈধ ইটভাটায় পুরোপুরি বন্ধ করতে নির্দেশ দিয়েছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট। এ মুহূর্তে প্রয়োজন ইটের বিকল্প পরিবেশ বান্ধব সাশ্রয়ী কংক্রিট ব্লক দিয়া নির্মাণ কাজ বাধ্যতামূলক করা। কারণ অবৈধ ইট ভাটায় পুড়ছে পরিবেশ। সরকারি বন এবং ব্যক্তিমালিকানাধীন বনাঞ্চল থেকে কাঠ সংগ্রহ করেই কাঠ পোড়ানো হয়। পুড়ছে ম্যানগ্রোভ বন। ৬ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি ইট ভাটায় ইট পোড়ানোর কাজে জ্বালানি হিসেবে কোনো জ্বালানি কাঠ ব্যবহার করতে পারবে না। কিন্তু দেশের কয়টি কারখানায় এ বিধান মেনে ইট তৈরি হয়। যদি কোনো আইন লংঘন করে জেলা প্রশাসকের অনুমতি ছাড়া ইটভাটায় ইট প্রস্তুত করেন তাহলে তিনি সর্বোচ্চ ১ বছরের কারাদণ্ড বা ১ লক্ষ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। এছাড়া আইনে অননুমোদিত স্থানে ইট ভাটা স্থাপন করলে দুই লক্ষ টাকা জরিমানা ও দুই বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড পেতে পারেন। আইনের দুর্বলতা ও ফাঁকফোকর দিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে প্রকৃত অপরাধিরা। অনেকের প্রশ্ন ইটভাটা বন্ধ হয়ে গেলে দেশের উন্নয়ন কাজ, নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়ে যাবে। তাই এর বিকল্প নিয়ে চিন্তা ভাবনা শুরু না করলে অবৈধ ইট ভাটা বিরোধী সকল অভিযান ও কর্মকাণ্ড ব্যর্থতায় পর্যবের্শিত হবে। প্রচলিত ইটের এর বিকল্প পরিবেশবান্ধব কংক্রিট ব্লক:- ইটভাটা জনিত বায়ু দূষণ পরিবেশ দূষণ বন্ধ করে ইটের বিকল্প ব্লক বা অটো ব্রিক্স ব্যবহার করতে ডেভেলপার কোম্পানি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশ দিতে হবে। সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসহ পর্যায়ক্রমে ব্যক্তিগত পর্যায়েও তা কার্যকর করতে হবে। এজন্যে সরকার কর্তৃক উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি পরিবেশ ও জীববৈচিত্র সংরক্ষণ ও উন্নয়নের স্বার্থে ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপনের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের লক্ষ্যে ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০১৩ জারি করা হয় যেটি ২০১৪ সালের পহেলা জুলাই থেকে কার্যকর হয়েছে। কিন্তু আইনের কিছু ধারায় কিছু বিধিনিষেধ ও শর্ত থাকায় আইনটি প্রয়োগে সমস্যা দেখা দিয়েছে। আমাদের পরিবেশ আইনও অকার্যকর হয়ে পড়েছে, এছাড়া দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত কল্পে ফসলি জমির মাটি ব্যবহার বন্ধের লক্ষ্যে ইটের বিকল্প হিসেবে ব্লক ব্যবহার উৎসাহিত করতে বর্তমান আইনে কিছু ধারায় পরিবর্তন আনা দরকার। এটি হলে কৃষির জন্য অত্যন্ত দরকারি টপ সয়েল রক্ষা ছাড়াও ইটভাটাজনিত পরিবেশ দূষণ কমবে। সরকারের একটি অঙ্গীকার ছিল ২০২০ সালের মধ্যে পোড়া ইট শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা, কিন্তু সেটি প্রশাসন তা পারেনি। সভ্য দেশগুলোতে নির্মাণ কাজে এমন পোড়া ইট ব্যবহার করা হয় না পরিবেশ ও জনস্বাস্থের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই। রাস্তাঘাট বা ভবনের দেয়ালে পোড়া ইট ব্যবহারের আর কোনো প্রয়োজন নেই সব কাজে ব্লক দিয়ে করা সম্ভব। ইট হলো মাটি পুড়িয়ে তৈরি করা আর আগুনে না পুড়িয়ে মাটি বালি বা সিমেন্ট বা অন্য কোনো ম্যাটারিয়াল দিয়ে হবে ব্লক। ইট তৈরির স্থান ইটভাটা আর ব্লক তৈরি হবে কারখানায়। প্রতিবছর নদীতে পলি আসে, তা ড্রেজিং করতে হয় প্রতিবছর। এগুলো নদীর তীরে রাখে। এই মাটি কাজে লাগিয়ে ব্লক তৈরি হবে। পর্যাপ্ত না হলে তখন সরকার বের করবে নদীর কোন জায়গার মাটি নেয়া যাবে আর কোন জায়গার মাটি নেয়া যাবে না। দেয়ালে ইটের বদলে অনেক বিকল্প আছে রাস্তায় যেমন অনেক ইট লাগে কিন্তু সেটিও দরকার হবে না মাটির সাথে সিমেন্ট মিশিয়ে কমপ্যাক্ট করে আরো ভালো ও টেকসই জিনিস করা যায়। আগেই বলেছি কোনো উন্নত দেশে পোড়া মাটি ব্যবহার হয় না। তাই আমরাও পারবো না কেন? আমাদের মানুষ বেশি ও কৃষি জমি কম তাই কৃষি জমি যেন নষ্ট না হয় সেজন্য আমাদের এই নীতিতে (পোড়া ইটের বদলে ব্লক) যাওয়া উচিত ছিল বহু আগে। ইটের বিকল্প পরিবেশবান্ধব কংক্রিট ব্লক সাশ্রয়ী ও তুলনামূলক ভূমিকম্প সহনীয় হওয়ায় দেশের নির্মাণ খাতে বাড়ছে ব্লকের চাহিদা। উদ্ভাবিত এই ব্লক ব্যবহার করলে ভবনের নির্মাণ ব্যয় ২৫ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমানো সম্ভব, তবে এখনও পর্যন্ত এই প্রযুক্তি সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়া যায়নি বলে দেশবাসী এর সুফল এখনো পাচ্ছে না। ইটের বিকল্প পরিবেশবান্ধব কংক্রিট ব্লকে ঘর বানানোর চর্চা বাড়ায় দেশে ইট ভাটার কারণে পরিবেশের ক্ষতি বন্ধে নতুন আশা সৃষ্টি করেছে। কৃষি জমির উপরিভাগের মাটি দিয়ে বানানো ইট পোড়াতে কয়লা ও গাছ ব্যবহার করায় পরিবেশের ভয়াবহ ক্ষতি হচ্ছে। এ পর্যন্ত বিকল্প নির্মাণ সামগ্রী হিসেবে ৩০ ধরনের কংক্রিট ব্লক উদ্ভাবন করা হয়েছে। এগুলো পরিবেশবান্ধব, মূল্যসাশ্রয়ী, ওজনে হালকা, ভূমিকম্প, আগুন ও লবণাক্ততা প্রতিরোধী, অতি উষ্ণ বা অতি শীতল আবহাওয়ার বিপরীতে নাতিশীতোষ্ণ পরিবেশ দেয়। এগুলো দীর্ঘস্থায়ী ও ব্যয়সাশ্রয়ী। এসব ব্লক তৈরিতে কৃষি জমির উপরিভাগের মাটি ব্যবহারের পরিবর্তে নদীর তলদেশের মোটা বালি ও সিমেন্ট ব্যবহার করা হয়। কখনো ফ্লাই অ্যাশ, পাথরের ধুলো বা অন্যান্য সামগ্রীও ব্যবহার করা হয়। এ ধরনের ব্লকের মধ্যে রয়েছে কম্প্রেসড স্ট্যাবিলাইসড আর্থ ব্লক (সিএসআইবি), ইন্টার লিংকিং সিএসইবি, কংক্রিট হলো ব্লক, থার্মাল ব্লক (টিবি), ফেরো সিমেন্ট স্যান্ডউইচ প্যানেল, সেলুলার ব্লক, ফ্লাই অ্যাশ ব্রিক ও অন্যান্য। পরিবেশ বান্ধব ইকো ব্লকের নানান সুবিধা ও প্রচলিত ইটভাটা থেকে সৃষ্ট পরিবেশের ক্ষতি রোধের দায়বদ্ধতা থেকে মানুষ ক্রমশ পরিবেশবান্ধব ঘর তৈরিতে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। তবে তার গতি আরো বাড়াতে প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিকস মিডিয়াকে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে হবে, শহরনগর গ্রামেগঞ্জে জন সচেতনতা সৃষ্টিতে সরকার ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোকে যুগোপযোগী কাজ করতে হবে। গত ২০১৯ সালের ২৪ নভেম্বর সরকার গেজেট বিজ্ঞপ্তিতে ২০২৫ সালের মধ্যে পর্যায়ক্রমে সব সরকারি নির্মাণ কাজে প্রচলিত ইটের পরিবর্তে শতভাগ পরিবেশ বান্ধব ব্লক ব্যবহারে নির্দেশনা দিয়েছে।

ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান পরিবেশবান্ধব ব্লকের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করেছে। এ ধরনের ব্লক নির্মাণে ৭০ শতাংশ নদীর তলদেশ থেকে নেওয়া মোটা বালি, ১০ শতাংশ সিমেন্ট ও ২০ শতাংশ শুকনো মাটি মিশিয়ে মেশিনে উচ্চমাত্রায় চাপ দেওয়া হয়। গাঁথুনির জন্য সিমেন্ট, বালু ও পানি কম লাগে। রাজমিস্ত্রির খরচও কম। দেয়ালে প্লাস্টারের প্রয়োজন না হওয়ায় সরাসরি রং করা যায়। পরিবেশবান্ধব উপকরণ নিয়ে নির্মাণ কাজের দক্ষ জনশক্তি তৈরীর জন্য তারা প্রতি মাসে ৫০ নির্মাণ কর্মী ও অন্যদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। পরিবেশ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, দেশে প্রচলিত ইটভাটা সংখ্যা সাড়ে ৬ হাজার থেকে ১০ হাজারের মতো। এসব ভাটায় বছরে প্রায় ২২.৭১ বিলিয়ন পোড়া ইট হয়। এজন্য ২৫ বিলিয়ন কিউবিক ফুট টপ সয়েল পোড়াতে সাড়ে ৩ মিলিয়ন টন কয়লা ও ১.৯ মিলিয়ন টন জ্বালানি কাঠ পোড়ানো হয়। যা থেকে মারাত্মক ক্ষতিকর ৯.৮ মিলিয়ন টন গ্রিন হাউস গ্যাস হয়। এসব বিষয় বিবেচনা করে এখনই সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে এবং অবৈধ ইট ভাটা সম্পূর্ণ বন্ধ করে এর বিকল্প পরিবেশবান্ধব কংক্রিট ব্লক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা, নইলে ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের দিকে এগুচ্ছে দেশ।

লেখক: আইনজীবী, মানবাধিকার ও সুশাসন কর্মী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপরিবেশ সুরক্ষায় ধূলিদূষণ নিয়ন্ত্রণ জরুরি
পরবর্তী নিবন্ধপরিবেশ দূষণরোধে সচেতনতা বাড়াতে হবে