পরিবেশ সুরক্ষায় ধূলিদূষণ নিয়ন্ত্রণ জরুরি

মিনহাজুর রহমান শিহাব | সোমবার , ৫ জুন, ২০২৩ at ৬:০৪ পূর্বাহ্ণ

বৃষ্টির সময় বাদে শুষ্ক মৌসুমে বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামে ধূলি দূষণের মাত্রা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। ধূলি দূষণে পর্যুদস্ত হচ্ছে নগরবাসী। বিড়ম্বনা বাড়ছে সকল শ্রেণি, পেশার, বয়সের মানুষের। ধূলিকণার পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধিতে মাস্কছাড়া চলাফেরা অসম্ভব হয়ে উঠেছে।

ধূলি দূষণের মূলে রয়েছে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের অপরিকল্পিত বাস্তবায়ন, ভবন নির্মাণ, পুরাতন ভবন ভাঙা, রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, দিনেরবেলা সেবকদের পানি না ছিটিয়ে সড়ক ঝাড়ু দেওয়া, নিয়মিত রাস্তা পরিষ্কার না করা ও ধূলিবালি নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা, রাস্তার মাঝের আইল্যান্ড নিয়মিত পরিচর্যার অভাব, রাস্তার উপর যত্রতত্র উন্মুক্তভাবে রাখা নির্মাণ সামগ্রী, পুরাতন যন্ত্রাংশ ও জিনিসপত্রে স্তুপীকৃত ধূলিকণা, ময়লার গাড়ি থেকে ছিটকে পড়া আবর্জনা, সড়কে কার্পেটিং এর সময় দেওয়া অতিরিক্ত বালু প্রভৃতি। এছাড়া শহরের কালুরঘাট, নাসিরাবাদ, বায়েজিদ, অক্সিজেন, ভাটিয়ারী, সীতাকুন্ড শিল্প এলাকায় অত্যন্ত দূষণকারী কলকারখানা রয়েছে যেখানে শত শত ছোট ও মাঝারি কলকারখানার তেলমবিল পোড়া ধোঁয়া আর লৌহজাত কণিকা চট্টগ্রামের বাতাস ভারি ও বিষাক্ত করে তুলছে প্রতিনিয়ত।

নগরীর চারপাশে গড়ে উঠা অসংখ্য ইটভাটার গনগনে আগুন থেকে বিষাক্ত কার্বন মিশছে বাতাসে। ফিটনেসবিহীন যানবাহন কালো ধুঁয়া ছড়াচ্ছে। ফলে শুধু বাতাস নয়, কোনও কোনও এলাকার গাছপালা প্রাণহীন হয়ে মারা যাচ্ছে। পথে তো বটেই বহুতল ভবনের সর্বোচ্চ ফ্ল্যাটেও ধূলা দূষণ থেকে রক্ষা পাওয়া যাচ্ছে না। বিশেষত সন্ধ্যার পর শিল্প কারখানা থেকে নির্গত কালো ধোঁয়ায় আশেপাশের এলাকার বায়ু বিষবাষ্পে রূপ নেয়। দূষণ নিয়ন্ত্রণে আইন অনুযায়ী কাজের আগে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেয়া, নিয়মিত পানি ছিটানো ইত্যাদি বাধ্যবাধকতা থাকলেও অনেকক্ষেত্রে মানা হয় না। অথচ উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়টি প্রকল্প গ্রহণের শুরুতেই প্রাধান্য দেওয়া হয়। চট্টগ্রাম শহরের বাতাসে ভাসমান ধূলিকণা বা পার্টিকুলেট ম্যাটারের উপস্থিতির উপর চালানো গবেষণায় উঠে আসে বার্ষিক গড় পিএম১০ WHOএর মান থেকে বহুগুণ বেশি। চট্টগ্রাম শহরের জন্য বায়ু দূষণের অন্যতম কারণ নগর সেবকদের প্রতিদিন দিনের বেলা রাস্তাঘাট ঝাড়ু দেয়া, ফলস্বরূপ ধূলিকণা উড়ে গিয়ে বা ঝাড়ুতে ড্রেনে গিয়ে জমা হয়। এতে ড্রেনের তলদেশ ভরাট হওয়াও ধূলি দূষণের আরেকটি নেতিবাচক রূপ হিসেবে দেখা দিচ্ছে।

ধূলিকণার হাত থেকে রক্ষার জন্য কেবল ঝাড়ু দিয়ে বালু অপসারণ যথেষ্ট নয়। বরং প্রতিবার ঝাড়ু দেওয়ার আগে পানি ছিটানো হলে কিংবা ভোরবেলা জনকোলাহল শূন্য অবস্থায় ঝাড়ু দেওয়া হলে ধূলিকণা বাতাসে আর উড়তে পারে না, সাথে ঝাড়ু দিয়ে ধূলাবালি স্তুপীকৃত করে অপসারণ সহজতর হয়। দিনের বেলায় ধূলাবালির প্রকোপ খালি চোখে ধরা পড়ায় প্রায় এলাকায় নাক মুখ না ঢেকে চলাচল করা খুবই ভয়াবহ। ফলে যানবাহনে চলতে গেলে সহজেই এসব ক্ষতিকর ধূলিকণা চোখে মুখে ঢুকছে। নগরের পথেপ্রান্তরে ধূলিকণা অস্বাভাবিক হারে শ্বাস গ্রহণের কারণে অনেক মানুষ যক্ষ্মা, হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট, ব্রঙ্কাইটিস, চোখের নানারকম রোগ, চর্মরোগসহ অসংখ্য জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। হাসপাতালগুলোতে ইতোমধ্যে এ ধরনের রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে অন্যান্য পদার্থের মধ্যে ভাসমান ধূলিকণাও বায়ুর একটি অন্যতম উপাদান। ধূলিকণার আকার ১০ মাইক্রোগ্রামের (পিএম১০) বেশি হলে তা বায়ুতে ভেসে বেড়াতে পারে না। ছোট আকারের ধূলিকণাই (পিএম ২.) বাতাসে ভেসে বেড়ায় এবং দূষণ ঘটায়। বাতাসের গুণগত মান নির্ভর করে বায়ুতে ভাসমান এই সূক্ষ্ম ধূলিকণার পরিমাণ (পিএম১০) এবং অতি সূক্ষ্ম ধূলিকণার পরিমাণের (পিএম ২.) ওপর, যা পরিমাপ করা হয় প্রতি ঘনমিটারে মাইক্রোগ্রাম (পার্টস পার মিলিয়নপিপিএম) এককে। পিএম ২., পিএম ১০ ছাড়াও সালফার ডাই অঙাইড, কার্বন মনোঅক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইড ও গ্রাউন্ড লেভেল ওজোনে সৃষ্ট বায়ুদূষণ বিবেচনা করে এয়ার কোয়ালিটি ইনডেঙ (একিউআই) তৈরি হয়। একিউআই মান যত বাড়তে থাকে, বায়ুমান তত ঝুঁকিপূর্ণ হয়। প্রতি ঘনমিটার বাতাসে এরকম ২০০ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত ধূলিকণা স্বাভাবিক বলে ধরা হয়, তার বেশি হলেই ধূলিদূষণ হয়। নগরীতে শুষ্ক মৌসুমে একিউআই মান গড়ে প্রায় ৩০০ মাইক্রোগ্রামের বেশি থাকে।

বিভিন্ন গবেষণা রিপোর্টে দেখা যায় প্রায় সব ক্ষেত্রেই পিএম.৫ হল একিউআই এর জন্য দায়ী দূষণকারী। সাধারণত পিএম ১০ আকারের ধূলিকণা ফুসফুসের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয়, পিএম ২.৫ চক্ষু ও চর্মরোগের কারণ, পিএম ১.০ এর নিচের আকারের ধূলিকণা মানবদেহে টিউমার সৃষ্টির কারণ এবং পিএম ০.১ আকারের ধূলিকণা হৃদরোগের কারণ। পিএম ২.৫ ব্যাসের কয়েক ঘণ্টা থেকে কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত সরাসরি সংস্পর্শ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ঝুঁকি বৃদ্ধি করতে পারে।

এছাড়া চুল পড়া, মাথার ত্বকে খুশকিসহ নানান জটিলতা দেখা দেয়। ধূলি দূষণ নিয়ন্ত্রণে ভ্যাকিয়ুম সুইপার যন্ত্র দ্বারা সড়কের ধূলাবালি অপসারণের বিকল্প নেই। ভ্যাকিয়ুম সুইপার দ্বারা অপসারিত বালি পুনঃব্যবহার করাও সম্ভব। ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য সুরক্ষার নিমিত্তে বাইরে শুষ্ক মৌসুমে মাস্ক, ক্যাপ ও চশমা ব্যবহার অপরিহার্য। নিয়মিত আবহাওয়ার পূর্বাভাস তথ্যের সাথে বাতাসে ভাসমান বিভিন্ন ক্ষতিকর ধূলিকণার মাত্রা সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে ধারণা দেওয়া ও সতর্কীকরণ জরুরি। এছাড়া অ্যালার্জির উপসর্গগুলির দৈনিক পর্যবেক্ষণের জন্য একটি দৈনিক ডিজিটাল রেকর্ডটাইপ মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার প্রাসঙ্গিক যা বায়ু দূষণের মাত্রা শনাক্ত করে মানুষকে সতর্কতার সঙ্গে পথ চলতে সাহায্য করতে পারে। সুপরিকল্পিত পরিকল্পনা ও আধুনিক প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে ধূলি দূষণের মাত্রা রোধে এখনই সমন্বিত ও যথোপযুক্ত প্রয়াস চালানো অপরিহার্য।

লেখক: শিক্ষার্থী, বন ও পরিবেশবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএ যেন প্লাস্টিকের সাথেই আমাদের বসবাস
পরবর্তী নিবন্ধইটের বিকল্প পরিবেশবান্ধব সাশ্রয়ী কংক্রিট ব্লক ব্যবহার প্রসঙ্গে