ক্যান্সার গবেষণার পথিকৃৎ হয়ে উঠুক

আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতাল ক্যান্সার ইনস্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার

মোহাম্মদ মোমিনুর রহমান | মঙ্গলবার , ২৮ জানুয়ারি, ২০২৫ at ৬:৪৫ পূর্বাহ্ণ

ছোট্ট একটা শব্দ ক্যান্সার কিন্তু এর ব্যাপ্তি যে কত বৃহৎ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটির ফ্ল্যাগশিপ জার্নাল ২০২২ এ প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী বর্তমান বিশ্বে প্রায় ২০ মিলিয়ন মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত এবং আগামী বিশ বছরে এই সংখ্যা হবে প্রায় ৩৫ মিলিয়ন। ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যানসারের (আইএআরসি) একটি সমীক্ষার ওপর ভিত্তি করে বলছে, প্রায় পাঁচজনের মধ্যে একজন তাদের জীবদ্দশায় ক্যানসারে আক্রান্ত হয়। তাছাড়া প্রতি নয়জন পুরুষের মধ্যে একজন এবং ১২ জন নারীর মধ্যে একজন ক্যানসার রোগের ভুক্তভুগী।

সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগী আছে প্রায় ২২ লাখ। বছরে প্রায় দুই লাখ নতুন রোগী বাড়ছে। দেশে দৈনিক গড়ে ৪৫৮ জন ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। জাতীয় ক্যান্সার ইনস্টিটিউট হাসপাতাল ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় অনকোলজি বিভাগের হিসেবে মতে, বাংলাদেশে ৩০ থেকে ৬৫ বছর বয়সী প্রায় ৬৬ শতাংশ মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে বাংলাদেশে ৩২ ধরণের ক্যান্সার বিদ্যমান।

জীবন যাত্রায় বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দেওয়া ক্যান্সার নামক ঘাতক ব্যধির বিভিন্ন ধরণ, ক্যান্সার শরীরে ছড়িয়ে পড়ার আনুষাঙ্গিক উপাদান, ক্যান্সার চিকিৎসার নিত্যনতুন মলিকুল/ওষুধ আবিষ্কারে ব্যস্ত সময় পার করছেন গবেষকরা। নেচার জার্নাল এর প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে বিশ্ব গবেষণার বড় একটি অংশ ক্যান্সার গবেষণাকে প্রতিনিধিত্ব করে।

এই কথা সত্যি যে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে, গবেষণা বা রিসার্চ সেন্টারে ক্যান্সার নিয়ে গবেষণা হচ্ছে কিন্তু এই কথা অনস্বীকার্য যে ক্যানসারের জন্য দরকার সমন্বিত চিকিৎসাকেন্দ্র। কোন ধরণের ক্যান্সার এর প্রকোপ বেশি, তার টাইপ কী, শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে কিংবা টিস্যু অভ্যন্তরে ক্যান্সারটির আচরণ কী, ওষুধের কী প্রতিক্রিয়া, কেমোথেরাপি, সার্জারি ও রেডিওথেরাপির পর রোগীর অবস্থা কী কিংবা বিশ্বে সমসাময়িক কোন ওষুধ বা কোন প্রযুক্তি আপডেট হচ্ছে এই নিয়ে ব্যাপক গবেষণা, এবং হাসপাতাল সহ তার সাথে সমন্বিত ক্যান্সার গবেষণা কেন্দ্র এখন সময়ের দাবী।

আশার আলো এই যে, ঠিক এই সময়ে কিছু স্বপ্নবাজ মানুষ অক্লান্ত পরিশ্রম এবং মেধা দিয়ে গড়ে তুলেছেন আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতাল ক্যান্সার ইনস্টিটিউট এবং রিসার্চ সেন্টার। এটা অবশ্যই প্রশংসার দাবীদার। নামের সাথে মিল রেখে গবেষণার বিষয়টি পর্যালোচনা করা যাক।

প্রত্যেকটা গবেষণার জন্য দরকার উন্নত এবং মানসম্পন্ন ল্যাবরেটরি। যেখানে বিভিন্ন ক্যান্সার নিয়ে বিভিন্ন গ্রুপ বা গবেষকরা গবেষণা করবে। ব্যাপারটা এমন নয় যে একসাথে সব ল্যাব বা গবেষণাগার চালু করতে হবে। আমাদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এই রিসার্চ ইনস্টিটিউট এখন উদ্যোগ নিয়ে ধীরে ধীরে বিভিন্ন ক্যান্সার টাইপ নিয়ে এক একটা রিসার্চ ল্যাব বা গবেষণাগার গড়ে তুলতে পারে।

দেশী বিদেশী পরামর্শক এবং উদ্যেক্তাদের আন্তরিক সহায়তায় এই ইনস্টিটিউটে যেভাবে অনকো ক্রিটিক্যাল কেয়ার, পেলিয়েটিভ কেয়ার, হেমাটোলজি কিংবা চাইল্ড অন্‌কলোজি গড়ে উঠেছে তদ্রুপ দেশ বিদেশের গবেষকদের কাজে লাগিয়ে এক একটি ল্যাব এর রুম সাজাতে পারে। যেখানে ক্যান্সার সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন আন্যালাইটিক্যাল যন্ত্র, প্যাথলজিক্যাল উপাদান যেগুলো বায়োমার্কার, টিউমার মার্কার, সাইটোজেনিক এনালাইসিস কিংবা ক্যান্সার ইমেজিং টেস্ট এর সুবিধা থাকবে। সেই সাথে ক্যান্সার গবেষণায় প্রাণী বা এনিম্যাল (ইঁদুর বা গিনিপিগ) ব্যবহার করা হয় যা আমাদেরকে টিউমারের বৃদ্ধি এবং বিস্তার, রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা এবং প্রতিরোধের নতুন উপায় বুঝতে সাহায্য করে। সেই বিবেচনায় দরকার একটা সেন্ট্রাল এনিম্যাল হাউস। এরপর এক একটা ল্যাব শুরু করবে ক্যান্সার নিয়ে বিভিন্ন ধরণের গবেষণা।

কথা প্রসঙ্গে বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে উল্লেখ করতে চাই যেআমার বর্তমান কর্মস্থলের পাশে অস্ট্রেলিয়ার নামকরা প্রিন্সেস আলেঙান্দ্রা হাসপাতাল অবস্থিত। হাসপাতাল এর বিভিন্ন বিভাগের সংশ্লিষ্টদের দেখি তারা তাদের টীম নিয়ে বিভিন্ন ল্যাবরেটরি বা এনিম্যাল হাউসে টিস্যু কালচার, কিংবা জিন সিকোয়েন্স, মাইক্রো আরনএ, অর্গানোইডস, পেশেন্ট জেনোগ্রাফট, প্রোটিওমিঙ, স্মল মলিকুল, ক্যান্সার সেল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে গবেষণা, অর্থাৎ ল্যাব, চিকিৎসক এবং ল্যাবের কর্মীদের কর্মচাঞ্চল্য চেষ্টা করছে রোগীকে বাঁচানোর বা স্বস্তি দেওয়ার আর তাই ক্যান্সার চিকিৎসায় অস্ট্রেলিয়া উঠে এসেছে প্রথম সারিতে।

অনস্বীকার্য যে, মা ও শিশু হাসপাতাল ক্যান্সার ইনস্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার এর অবকাঠামো দাঁড়িয়ে গেছে। এখন সময়ের দাবী বিভিন্ন রিসার্চ ল্যাব চালু করা। তার পাশাপাশী অভ্যন্তরীণ এবং দেশের বিভিন্ন শিক্ষাঙ্গনে বা রিসার্চ সেন্টারগুলোতে আমাদের মেধাবী শিক্ষক, গবেষকদের সমন্বয়ে রিসার্চ টীম গঠন করা। ডিজিটাল প্রযুক্তির অ্যাঙেস নিয়ে বেড়ে উঠা আমাদের মেডিকেল, বিশ্ববিদ্যালয়ের অদম্য তরুণ শিক্ষার্ত্রীদের গবেষণায় সংযুক্ত করা। এছাড়া আমরা বায়োটেক, ফার্মা কোম্পানি কিংবা সংশ্লিষ্টদের নিয়ে ইন্ডাস্ট্রি এনগেজমেন্ট করতে পারি যেটা এখন বিশ্বে খুব জনপ্রিয়।

ক্যান্সার চিকিৎসায় বিশ্ব এখন অনেকদূর এগিয়েছে। সার্জারি কিংবা কেমোথেরাপি এর পাশাপাশি জিন এডিটিং, ইমুনোথেরাপি, ন্যানোটেকনোলজি, ডিজিটাল ম্যামোগ্রাফি, মেশিন লার্নিং অব সেল, আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্ট ফর ডিজিটাল টুইন বা ইমেজ এনালাইসিস, ইনফিনিয়াম অ্যাসে, অথবা রোবোটিক সার্জারির এই যুগে ক্যান্সার গবেষণায় মনোনিবেশ করা আমাদের এখন অতীব জরুরি। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গবেষণার ব্যাপারে তাগিদ দিয়েছেন।

সেদিন হয়তো আর বেশি দূরে নয় যখন মা ও শিশু হাসপাতাল ক্যান্সার ইনস্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার, ক্যান্সার চিকিৎসা এবং গবেষণায় একটা আলোচিত নাম হবে। নিত্য নতুন প্রযুক্তি কিংবা মলিকুল/ওষুধ নিয়ে ক্যান্সার রোগী বা পরিবারের আস্থার জায়গা হবে। বিশ্বের নামী দামী জার্নালে গবেষণা পত্র প্রকাশিত হবে। মানুষ জানবে বাংলাদেশও অনেক উন্নতমানের ক্যান্সার চিকিৎসা ও গবেষণা হয়। দেশী বিদেশী গবেষকদের সভা, সেমিনার, সিম্পোসিয়ামে মুখরিত হয়ে উঠবে এই প্রাঙ্গন সেদিন গর্ব করে বলবোদেখিস একদিন আমরাও। সেই স্বপ্ন নিয়ে, স্বপ্ন যাত্রীদের সাফল্য কামনা করছি।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক (শিক্ষা ছুটি), ফার্মেসী বিভাগ, আই আই ইউ সি। পিএইচডি গবেষক, অস্ট্রেলিয়া প্রোস্টেট ক্যান্সার রিসার্চ সেন্টার, ট্রান্সলেশনাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট, অস্ট্রেলিয়া

পূর্ববর্তী নিবন্ধসময় ও পরিস্থিতি
পরবর্তী নিবন্ধদেশে ফেরত আসা প্রবাসীদের স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অধিকার সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে