আলহাজ্ব নূর মোহাম্মদ আলকাদেরী

বহুমুখী প্রতিভা ও গুণের ধারক

মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মান্নান | শুক্রবার , ১৯ আগস্ট, ২০২২ at ৮:১৩ পূর্বাহ্ণ

আলহাজ নূর মোহাম্মদ আলকাদেরী (র.)এক ক্ষণজন্মা মহান ব্যক্তিত্ব। জন্মসূত্রে তাঁর মধ্যে ছিলো অসাধারণ মেধা ও প্রতিভা। তিনি তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনের অগণিত অবদানের মাঝে অমর, স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে আছেন ও থাকবেন।
১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে আলহাজ নূর মোহাম্মদ আলক্বাদেরী বাকলিয়ার এক মধ্যবিত্ত সম্ভ্রান্ত ও ধার্মিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে তিনি পৈত্রিক ব্যবসাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে প্রয়াসী হন। অল্প সময়ে তিনি পুরো চট্টগ্রামে এক সফল ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তিনি বক্সিরহাট মার্চেন্ট ডিফেন্স কমিটির সভাপতি, চট্টগ্রাম শিল্প ও বণিক সমিতির সম্মানিত সদস্য, চট্টগ্রামের ভোজ্য তৈল ও তুলা আমদানিকারক সমিতির সভাপতি, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের ট্রাস্ট সদস্য হিসেবে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের ব্যবসায়ী পরিমণ্ডলে খ্যাত হন। এমনকি তিনি পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট থেকে পূর্ব পাকিস্তানের ব্যবসায়ীদের দাবী-দাওয়া আদায়ে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, রাজনীতির অঙ্গনেও তিনি এক বিশেষ পদমর্যাদায় আসীন হন। তিনি ছিলেন জনদরদী, প্রসিদ্ধ সমাজ সেবকও। তিনি জমিয়াতুল ফালাহ্‌ জাতীয় মসজিদের বোর্ড অফ গভর্নস এর সদস্য ও হজ্ব কমিটির সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। আলহাজ নূর মোহাম্মদ আলকাদেরী নিজে যেমন জ্ঞানপিপাসু ছিলেন, তেমনি সমাজে জ্ঞান ও শিক্ষার প্রসারের গুরুত্বকে যথাযথভাবে অনুভব করেছেন। তিনি লামাবাজার, চরচাক্তাই বালক উচ্চ বিদ্যালয়, গুল-এজার বেগম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় এবং বাকলিয়ার প্রসিদ্ধ ফোরক্বানিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মূল ও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। সর্বোপরি এশিয়ার বিখ্যাত দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া (চট্টগ্রাম), জামেয়া ক্বাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া আলিয়া (ঢাকা) এবং হালিশহর ও চন্দ্রঘোনা মাদ্রাসাসহ বহু দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কায়েমের ক্ষেত্রে সর্বাধিক অবদান রাখেন। আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়ার আজীবন সহ-সভাপতি ছিলেন আলহাজ নূর মোহাম্মদ আলক্বাদেরী।
তিনি উপমহাদেশের সুপ্রসিদ্ধ মুর্শিদে বরহক্ব আওলাদ-ই রসুল হযরতুল আল্লামা হাফেয ক্বারী সৈয়দ আহমদ শাহ্‌ সিরিকোটি আলায়হির রাহমাহর হাতে বায়’আত গ্রহণ করেন এবং তাঁর সান্নিধ্যে অতি অল্প সময়ে ‘ফানাফিশ্‌ শায়খের’ মর্যাদায় উন্নীত হন। সিলসিলাহ্‌-ই আলিয়া ক্বাদেরিয়া সিরিকোটিয়ার জন্য তিনি যে অসাধারণ অবদান রাখেন, তা চিরদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এরই অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যায় এতে যে, তাঁর মহান মুর্শিদের সুযোগ্য উত্তরসূরী মুর্শিদে বরহক্ব সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্‌ (রাহ.) তাঁকে খিলাফতের মহা মর্যাদায় আসীন করেছিলেন। তাছাড়া তাঁর নামের সাথে ‘সওদাগর’ -এর স্থলে ‘আলক্বাদেরী’ও শোভা পেতে থাকে। আলহাজ নূর মুহাম্মদ আলকাদেরী আপন মুর্শিদে বরহক্বের আনুগত্য তথা ত্বরীকত জগতের এক অনন্য উদাহরণ। মুরীদ আপন মুর্শিদের আনুগত্য কীভাবে করতে হয় এবং এ ক্ষেত্রে কত নিষ্ঠার সাথে অনুশীলন করলে আপন কামিল মুর্শিদের কৃপাদৃষ্টি লাভ করা যায়, একজন মুরীদ আল্লাহ ও তাঁর রসূলের নিকট কিভাবে প্রিয় হতে পারে তার সমুজ্জ্বল উদাহরণ হলেন আলহাজ নূর মোহাম্মদ আলকাদেরী। একটি পুণ্যময় মিশনকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য মজবুত সংস্থা-সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। শাহেনশাহে সিরিকোটের সুদূরপ্রসারী ও যুগান্তকারী দ্বীনী মিশন ছিলো শরীয়ত ও ত্বরীকতের আলোয় গণ-মানুষের অন্তরাত্মাকে ব্যাপকভাবে আলোকিত করা। এ গুরুত্বপূর্ণ ধারার সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য শাহেনশাহে সিরিকোট ‘আনজুমান-ই- শূরা-ই রহমানিয়া (পরবর্তীতে আন্‌জুমান -ই রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট) প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি আন্‌জুমানের সর্বপ্রথম সহ-সভাপতি নিযুক্ত হন। তিনি বলুয়ারদিঘি পাড়স্থ নিজ বাসভবনের পূর্ণ এক তলা খানক্বাহ্‌ শরীফের জন্য ওয়াক্বফ করে দেন। জামেয়া প্রতিষ্ঠার সময়ও তিনি বিশেষ অবদান রাখেন। তিনি আজীবন জামেয়া-আন্‌জুমানের সর্বোচ্চ খিদমত আঞ্জাম দিয়ে যান। হুযূর কেবলার শরীয়ত ও ত্বরীকত সমন্বিত অনন্য সুন্দর এ মিশনকে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যান এ নিষ্ঠাবান ব্যক্তিত্ব। তাছাড়া হুযূর ক্বেবলা সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্‌ (রহ.) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত জামেয়া কাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া (ঢাকা)’র প্রতিষ্ঠা এবং মুসলিম বিশ্বের বৃহত্তর জশনে জুলুসের প্রবর্তনের গোড়ায়ও আলহাজ নূর মোহাম্মদ আলকাদেরীর ভূমিকা চির ভাস্বর হয়ে থাকবে। ১৯৭৪ খ্রিসটাব্দ থেকে প্রবর্তিত বিশাল জশনে জুলুসের প্রথম দু’ বছর তিনিই নেতৃত্ব দেন। রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও তিনি অকৃত্রিম দেশ প্রেমের পরিচয় দেন। তদানীন্তনকালীন দেশে যেই রাজনৈতিক মোর্চারই তিনি সমর্থক থাকুন না কেন, কল্যাণমুখী রাজনীতি সমাজসেবা ও দেশপ্রেমই তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় সুস্পষ্টরূপে প্রকাশ পেয়েছিলো।
ত্বরীকতের ক্ষেত্রে আলহাজ নূর মোহাম্মদ আলকাদেরী তো সমস্ত পীর ভাইদের নয়নমণি ছিলেন। সকলের হৃদয়ে তিনি অকৃত্রিম ভালোবাসার স্থান করে নিয়েছিলেন। যা তাঁর হৃদয় বিদারক ইন্তিকালের সময় প্রকাশ পেয়েছিলো। তিনি ১৯৭৯ খিস্টাব্দ মোতাবেক ১৪০০ হিজরির ১৯ মহররম ইহজগতের মায়া ত্যাগ করে পরপারে পাড়ি জমান। তাঁর ইন্তেকালের সাথে সাথে অগণিত পীরভাই-বোন, সর্বস্তরের জন সাধারণ ও জামেয়ার ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে।
তিনি আজীবন আন্‌জুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট এর সহ-সভাপতি ছিলেন। তাঁর ইন্তেকালের পর তাঁর সুযোগ্য সন্তান আলহাজ মুহাম্মদ মহসিন সাহেবকে হুযূর ক্বেবলা সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্‌ (রহ.) আলহাজ নূর মোহাম্মদ আলকাদেরীরই পদে সিনিয়র সহ-সভাপতি হিসেবে নিয়োগ দান করেন।
অগণিত অসাধারণ অবদানের কারণে আলহাজ্ব নুর মোহাম্মদ আলক্বাদেরী ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক বিশ্বে অবস্থানরত অগণিত মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায়ও অতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসাপূর্ণ বিশেষ স্থান করে নিয়েছিলেন। বিশেষ করে শাহেনশাহে সিরিকোট ও তাঁর বরকতমণ্ডিত উত্তরসূরী হুযূর ক্বেবলাগণের অদ্বিতীয় প্রিয়ভাজন ছিলেন এ পরম সৌভাগ্যবান ব্যক্তিত্ব। মোটকথা, এসব কটি অঙ্গনে ও বিষয়ে স্মরণীয় ও বরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে চির অমর হয়ে আছেন ধর্মপ্রাণ ও দেশপ্রেমী জনসাধারণের এ পরম শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি। আল্লাহ্‌ তাকে জান্নাতুল ফিরদাউস নসীব করুন। আমিন।
লেখক: মহাপরিচালক-আনজুমান রিসার্চ সেন্টার, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅঙ্ক ক্লাস
পরবর্তী নিবন্ধজুম্ আর খুতবা