অপার বেদনার পথে

আহমেদ মুনির | শুক্রবার , ২৪ জুন, ২০২২ at ৬:৩৯ পূর্বাহ্ণ

এই লেখা শুরু করছি আমার প্রিয় একটা নাটকের কথা দিয়ে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর দ্বিতীয় নাটক ‘তরঙ্গভঙ্গ’। প্রকাশকাল ১৯৬২। নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র আমেনা তার অসুস্থ দরিদ্র স্বামী কুতুবকে ধুতরা পাতার রস খাইয়ে হত্যা করে। স্বামীকে হত্যার পর নিজের আর সন্তানের জন্য আমেনা কাজে নামে। কিন্তু কোনো অবস্থায় কাজ জোটাতে না পেরে, নিজের কোলের শিশুকে গলা টিপে হত্যা করে সে । নাটকে আমেনার কোনো সংলাপ নেই। বরং দুটি হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত আমেনার বিচারকে ঘিরে যে কুশীলবেরা দৃশ্যে হাজির হন, আমরা তাদের চিন্তা-ভাবনা জানতে পারি। বিশেষত বিচারক বা জজ সাহেব কিছুতেই স্থির করতে পারেন না আসলে এই খুনের জন্য প্রকৃতপক্ষে কাকে দায়ী করা যাবে। তিনি কোনোভাবেই দরিদ্র আমেনার দোষ খুঁজে পান না। যে সমাজ আমেনাকে খাবার দেয়নি সেই সমাজকে দণ্ড না দিয়ে কী করে আমেনাকে সাজা দেবেন তিনি। বিচারকের কালক্ষেপণের মাঝেই জনতার হাতে খুন হয় আমেনা। আর নিজের দ্বন্দ্বে জর্জরিত বিচারকও আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।

চারটি মৃত্যু নিয়ে তরঙ্গভঙ্গ যেন পাপ-পুণ্য আর অপরাধী-নিরপরাধের সংজ্ঞা পাল্টে দিল। বলতে চাওয়া হলো, সাদা আর কালোর মাঝে যে ধূসর অঞ্চল থাকে সেখানে মানবিকতার আলো পৌঁছাতে হলে সমাজের প্রচলিত ভাবনার তরঙ্গটা ভাঙতে হবে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ যে ধূসর অঞ্চলটুকু আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছেন, সেখানে কিন্তু প্রথম আলো ফেলেছিলেন রুশ সাহিত্যিক ফিওদর দস্তয়েভস্কি। দ্বিশততম জন্মজয়ন্তী ঘিরে বিশ্বসাহিত্য ও দর্শনে তার সর্বব্যাপী প্রভাব নিয়ে আলোচনা চলছে এখন। বাংলা সাহিত্যে কেবল ওয়ালীউল্লাহ নন; জগদীশ গুপ্ত, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী, হুমায়ূন আহমেদসহ অনেকের মাঝে কিছু না কিছু মাত্রায় তাকে খুঁজে পাওয়া যাবে।

শতবর্ষ পর একজন সাহিত্যিক টিকে থাকলেও তিনি অনেকটা ফসিলে পরিণত হন। লোকে তার রেফারেন্স টানে, কখনো লেখাপত্র নিয়ে প্রবন্ধ-নিবন্ধ লেখে। পড়লেও একটা যুগের অভিজ্ঞতা লাভের আকাঙ্ক্ষা থাকে পাঠকের। কিন্তু জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে তাকে সঙ্গী করে চলে না হয়তো আগের মতো। জন্মের দুইশত বছর পরেও দস্তয়েভস্কি আশ্চর্যরকমের ব্যতিক্রম। এ যুগের পাঠকের কাছেও দস্তয়েভস্কি সমানভাবে আদৃত। গত শতকের শরৎচন্দ্রের কথাই ধরুন। তার শ্রীকান্ত উপন্যাসের সুবিশাল প্রেক্ষাপট আর জীবনপ্রবাহ আপনাকে ভাসিয়ে নেবে। কিন্তু জীবনের দ্বন্দ্বমুখর বাস্তবতার ব্যাখ্যা সেখানে পাবেন না। কোনটা ঠিক আর নৈতিক, জীবনে দুঃখ-কষ্টের পরিণাম কী আর মানুষ কী করেই বা তাকে গ্রহণ করবে, আপনি এমন সব প্রশ্নের মুখোমুখি হবেন না সেখানে। কিন্তু দস্তয়েভস্কি পড়তে পড়তে আপনি নিজেরই অজান্তে এসবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যাবেন। হয়তো আপনার জীবনের বাঁকও বদল হয়ে যাবে।

আমার এক বন্ধুর কথা জানি, চাকরির সূত্রে যে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। সন্তান ও স্ত্রীর সান্নিধ্য নিয়ে খুব মাথাব্যথা তার নেই। একবার এ প্রসঙ্গে তার সঙ্গে কথা হয়েছিল। জীবনের একটা সময় দস্তয়েভস্কি পড়েছে সে প্রবলভাবে। মানুষের স্বাধীনতা যে অতি পবিত্র, আর নিজের স্বাধীনতা যে নিজেকেই রক্ষা করতে হয় সযত্নে, বন্ধুটি সে বিষয়টি দস্তয়েভস্কির কাছ থেকে শিখেছে। জুয়াড়ি উপন্যাসের অ্যালেক্সেইয়ের মতো পকেটের শেষ পয়সা নিয়েও সে নিজের জন্য বাজি ধরতে রাজি।
বন্ধুটির দস্তয়েভস্কি পড়ায় কিছু কি ভুল ছিল? সে প্রশ্ন তাকে আর করা হয়নি। তবে মনে পড়ে, কিছুদিন আগে বাখতিনের একটা লেখায় পড়েছিলাম, দস্তয়েভস্কির রাস্কলনিকভ, সোনিয়া, ইভান কিংবা জোসিমার দর্শনকে আমাদের অনুসরণ করা উচিত নয়। এরা লেখকের মুখের কথা নিয়ে চলছেন না। বরং নিজেরাই স্বাধীন সত্তা, এদের প্রত্যকেরই নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি আছে। আমাদের বরং উচিত দস্তয়েভস্কি কী বলতে চান তাকে অনুসরণ করা।

আমার স্বাধীনচেতা বন্ধুটি যে ঢাকা শহরের জান্তব জঙ্গম আর কোলাহলমুখর অথচ ভীষণ বিষণ্ন এক পরিবেশে বেঁচে থেকে নিজের মুক্তির পথ খুঁজছে তার পক্ষে কোনো দিশা পাওয়া আদৌ সম্ভব কিনা জানি না। তবে দস্তয়েভস্কির অপরাধ ও শাস্তি, ডেমন, কারামাজভ ভাইয়েরা, জুয়াড়ি এসব উপন্যাসে স্বাধীনতা বা লিবার্টির যে ধারণা হাজির করা হয়েছে তার সঙ্গে বন্ধুটির ভাবনার কিছু পার্থক্য রয়েছে। এসব উপন্যাসে আমরা দেখতে পাই, দস্তয়েভস্কির চরিত্রগুলো সমাজের নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে নিজেকে স্বাধীন ভাবতে শুরু করে এক সময়। নিজের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন রাখতে গিয়ে যা কিছু করা সম্ভব তা করাকেই নৈতিক ভাবতে থাকে তারা। কিন্তু এই স্বেচ্ছাচারিতা শেষ পর্যন্ত বিপর্যয় তৈরি করে। আর এর মধ্যমে ব্যক্তিগত স্বাধীনতার সীমাও ছোট হয়ে আসে। আসলে ঈশ্বরের প্রতিভূ হয়ে ওঠা বা পরম স্বাধীনতা অর্জন কখনোই সম্ভব নয়। দুঃখ আর বিপর্যয়কে মেনে নিয়ে তার মধ্যে নিজেকে সঁপে দেওয়ার মধ্য দিয়েই শেষ পর্যন্ত মুক্তি খুঁজে পায় তারা। এটি আমি বুঝেছিলাম প্রায় কিশোর বয়সে, প্রথমবার দস্তয়েভস্কি পড়তে গিয়ে। বুঝেছিলাম, অন্তহীন বেদনা আর মানবিকতার অবনমনের মধ্য দিয়েই মানুষ প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠে।

ষোলো বছর বয়সে জুয়াড়ি উপন্যাসের মধ্য দিয়ে দস্তয়েভস্কির সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে। ক্ষীণকায় এই উপন্যাসের নায়ক অ্যালেক্সেই ইভানোভিচ নামের এক যুবক। যে অভিজাত তরুণী পলিনার প্রেমে পড়ে। পলিনার ধার শোধ করতে নেমে জুয়া খেলা শুরু অ্যালেক্সেইয়ের। এক সময় পলিনা নয়, অ্যালেক্সেই নিজের জন্যই জুয়া খেলা শুরু করে। এই জুয়ার নেশা যেন এক চক্রব্যূহ। ঢোকার রাস্তা জানা আছে, কিন্তু কী করে বের হতে হবে তা জানা নেই। যে প্রেমের সার্থকতার খোঁজে অ্যালেক্সেই ছুটেছিল এক সময়, সেই প্রেম অবশেষে ধরাও দিল। কিন্তু নিজের জীবন নিয়ে পতনের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়ানো অ্যালেক্সেই আর ফিরতে রাজি ছিল না। পকেটের শেষ পয়সাটুকু দিয়েও বাজি ধরে সে। উপন্যাসের নায়ক কেন স্বেচ্ছায় এমন যন্ত্রণার জীবন বেছে নিল, সেটা ওই বয়সে আমি বুঝতে পারিনি। ষোলো বছর বয়সে ওই উপন্যাস পড়ে আমি এক কথায় দুমড়ে মুচড়ে গিয়েছি। কেন স্বেচ্ছায় একজন মানুষ যন্ত্রণার পথ বেছে নেবে, এই উত্তর জানা না থাকলেও মনে মনে প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছিল অ্যালেক্সেইর প্রতি।

পরবর্তী সময়ে পুওর ফোক বা অভাজন উপন্যাসের মাকার দেভুশকিন, ইডিয়টের প্রিন্স মিশকিন, বঞ্চিত লাঞ্ছিত উপন্যাসের নেল্লি, অপরাধ ও শাস্তির রাসকোলনিকভ, মারমালাদভ কিংবা নাতাশার মধ্যেও দেখতে পাই যন্ত্রণাকাতর এক জীবনকে সঙ্গী করেছে তারা। কোথাও জীবন স্বাভাবিক নয়। সবার মাঝেই যেন অহেতুক দুঃখ আর যন্ত্রণাকে টেনে নেওয়ার একটা প্রবণতা।

সব মিলিয়ে আমাকে যদি কেউ দস্তয়েভস্কির দর্শন এক বাক্যে বলতে বলেন, তবে আমি বলব, জীবন অনিঃশেষ এক যন্ত্রণার নাম। একে আমন্ত্রণ জানিয়ে ধারণ করে তবে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব।

কার্ল গুস্তাভ ইয়ুং যাকে বলেছেন, কালেকটিভ আনকনশাসনেস বা যৌথ অবচেতন, সেই যৌথ অবচেতনের মধ্য দিয়ে মানুষের জীবনে বেদনা বা ট্রমা আসে ঘুরেফিরে। তলস্তয়ের ফাদার সিয়ের্গি অভিজাত জীবনের অন্তঃসারশূন্য বাস্তবতা এড়াতে সাধুসন্তের জীবন বেছে নেয়। কিন্তু দস্তয়েভস্কির চরিত্রগুলো দুঃখকে মেনে নেয় এবং দুঃখ যাপন করেই পরিত্রাণ পায়। এ ভিন্ন মুক্তির আর অন্য কোনো উপায় তিনি দেখাননি।

‘নোটস ফ্রম দা আন্ডারগ্রাউন্ডে’ উত্তম পুরুষের বয়ানে আমরা পাচ্ছি, ‘সবকিছুই তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। কেন কী হচ্ছে তা বলা অসম্ভব। আর অসম্ভব বলেই এটি আপনাকে আঘাত করে, এবং আপনি যত কম বোঝেন, তত বেশি যন্ত্রণা হয়।’

দস্তয়েভস্কি এই ধারণার প্রতি সন্দিহান ছিলেন যে, দুঃখ এড়ানোর মাধ্যমেই সুখ অর্জন করা যায়। আবার তিনি বলছেন, কেউ যদি সঠিক কারণে কষ্ট পায়, তাহলে তার জন্য রয়েছে পুরস্কার। এই পুরস্কার হলো সত্যকে আবিষ্কার করা। আর সত্যই হলো মুক্তির একমাত্র পথ।

বুদ্ধও তাই বলেছেন, জন্মের কারণেই দুঃখের উৎপত্তি। আর অজ্ঞানতাই দুঃখের মূল কারণ। দুঃখ এড়িয়ে নির্বাণ পাওয়া সম্ভব নয়।

ইয়ুং যাকে অর্থহীন দুঃখ বলেছেন আমরা প্রায়শ দস্তয়েভস্কির চরিত্রগুলোর মধ্যে তার ইশারা দেখতে পাব। ‘অপরাধ ও শাস্তি’ উপন্যাসের মারমালাদভ সংসার চালাতে অক্ষম বলে নিজেকে দায়ী করে। এ সত্য অনুধাবন করেও সে জীবনের মুখোমুখি হতে নারাজ। বরং সত্যকে এড়াতে মদ্যপান বেছে নেয় সে। মারমালদভের যুক্তি, মদ্যপানের মধ্য দিয়ে নিজের অক্ষমতার প্রায়শ্চিত্ত করছে সে। সে বলে, ‘আমি মদ খাই নিজেকে দ্বিগুণ কষ্ট দেবার জন্য।’ চরিত্রের দিক থেকে পুরোপুরি বিপরীত হলেও স্‌িভদরিগাইলোভও প্রকারান্তরে এই ট্র্যাজেডি এড়াতে পারেনি। ভোগে আচ্ছন্ন স্‌িভদরিগাইলোভ শেষ পর্যন্ত আবিষ্কার করে, প্রকৃত প্রেম তার জন্য নয়, পরম সুন্দর থেকে সে বঞ্চিত। আর এই কারণে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় সে। অর্থহীন বেদনা কেবল নয়, মেনে নিতে হবে অবনমন বা ডিগ্রেডেশনকেও। কারণ এর মধ্য দিয়েই প্রায় সব মানুষকে যেতে হবে। এই অবনমনকে অভিশাপ বিবেচনা করে ভেঙে পড়লে চলবে না। তার ভেতর থেকেই নতুন করে বাঁচার রসদ খুঁজতে হবে।

কেন বলছি এ কথা, কারণ জীবনের একটা সময় আসে, যখন মনে হয় প্রচণ্ড বিরক্তিকর আর নিঃসঙ্গ একজন মানুষ আমি। কিছুটা বিকারগ্রস্তও। বন্ধু বা পরিজনের ভিড়ে তার উপস্থিতি স্বস্তিদায়ক নয়। যেমন দেখি আমরা নোটস ফ্রম আন্ডারগ্রাউন্ড উপন্যাসে। একটা অস্থিরতা তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। ইংরেজিতে যাকে বলে রিডিকুলাস, তেমন দশায় পড়ে যাচ্ছি। অবস্থার অবনমন এড়ানো যাচ্ছে না।

বলে রাখছি, জীবনের একটা সময় আমিও এমন অবনমন বা ডিগ্রেডেশনের অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়েছিলাম। তখন প্রায় স্বপ্ন দেখতাম আমি খালি পায়ে, বা পোশাক ছাড়াই কোনো সভাস্থলে হাজির হয়েছি। ‘দা হাউস অব ডেড’ উপন্যাসের আলেক্সান্ডার পেত্রভিচের সঙ্গে কয়েদিদের কিউতে দাঁড়ানো অবস্থায় নিজেকে আবিষ্কার করতাম আমি। দেখতে পেতাম, প্রচণ্ড শীতে একটি মাত্র পানির পাত্র থেকে পানি নিয়ে কুলি করে সবাই সেখানে ফেলছে, পরের জন এসেও সেই পানিই ব্যবহার করছে। এ ভিন্ন আর কোনো ব্যবস্থা নেই। বন্দী শিবিরে এটাই নিয়ম। এই অবনমনে প্রথমে ধাক্কা লাগে বটে, পরে অভ্যস্ত হলে এটাই ভালো লাগতে শুরু করে।
তেমন একটা সময়ে হঠাৎ করে হাতে আসে, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর ‘বারো ঘর এক উঠান’ উপন্যাসটি। ব্যাংকার শিবনাথ আর শিক্ষিকা রুচি আমাদেরই মতো মধ্যবিত্ত। তাদের উচ্চাশার সঙ্গে জীবনযাপনের রুচির সঙ্গে আমাদের ফারাক নেই এতটুকু। তাই উপন্যাসের শিবনাথ আর রুচিকে যখন অভিজাত এলাকা ছেড়ে বস্তিতে উঠতে হয়, তখন ভেতরে-ভেতরে আমারও ধস শুরু হয়। আভিজাত্য যে খোলস, শিক্ষা আর সংস্কৃতি যে কত ঠুনকো! এ দিয়ে আর যা হোক, সম্মান রক্ষা হয় না, পেট ভরে না। অন্যের কাছে হাত পাতবার বেলায়ও কোনো কাজে আসে না। বস্তির খিস্তি খেউড় আর শেক্‌সপিয়ারের সংলাপ এক কাতারে এসে নামে। এই উপন্যাস আমাকে ‘দা হাউস অব ডেড’ পড়বার অনুভূতিই দিয়েছিল। কী অবলীলায় মানুষের পতন হয়! সে নামতে থাকে একেবারে আবর্জনার গাদার ভেতর, কী অবলীলায়!

তবু এই পতনই শেষ কথা নয়। নানা স্তরে সজ্জিত দস্তয়েভস্কির উপন্যাসগুলো যেন বলতে চাইছে, দুঃখযন্ত্রণা আর বিপর্যয়কে অর্থপূর্ণভাবে গ্রহণ করার পুরস্কারও রয়েছে। যার উদাহরণ দস্তয়েভস্কি নিজেই। পেত্রাশেভস্কি পাঠচক্রে যোগ দেওয়ার অপরাধে ১৮৪৯ সালে দস্তয়েভস্কিকে পাঠানো হয় সাইবেরিয়ার বন্দী শিবিরে। পাঁচ বছরের বন্দীদশার পর আরও পাঁচ বছর সেখানে বাধ্যতামূলক শ্রম দিতে হয় তাকে। এরপর ফিরে এসে তিনি লিখেছেন তার সেরা উপন্যাসগুলো। যার মধ্য ‘দা হাউস অব ডেড’, ‘অপরাধ ও শাস্তি’, ‘ইডিয়ট’ আর ‘কারামাজভ ভাইয়েরা’ অন্যতম।

দুঃখ দুর্দশার প্রতি দস্তয়েভস্কির এই দুর্বলতা কেন, তার ব্যাখ্যা অনেক সমালোচক নানাভাবে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। দস্তয়েভস্কি হয়তো বলতে চেয়েছেন, শেষ পর্যন্ত মানুষকে ঈশ্বরের কাছেই যেতে হবে, সব হারিয়ে, সব বিসর্জন দিয়ে নিপীড়িত আর লাঞ্ছিত অবস্থায়। তবে তার প্রণতি তো শেষ পর্যন্ত মানুষের প্রতিই। অপরাধ ও শাস্তি উপন্যাসে ২৪ বছরের যুবক রাসকোলনিকভের মুখে শোনা যাক সে কথা। রাসকোলনিকভ খুনের দায় স্বীকার করতে সোনিয়ার কাছে যায়। সে বলে, আমার এই প্রণতি তো তোমাকে নয়, মানুষের এই যে দুঃখ-যন্ত্রণা তার প্রতিই।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিভিন্ন পর্যায়ের নারী নেটওয়াকের্র সাথে সভা
পরবর্তী নিবন্ধগুপ্ত জনম