বাবাকে নিয়ে লিখিনি অনেক দিন। অনেক দিন বলছি কেন। লিখিনি অনেক বছর। কিন্তু এমন কোন দিন যায়নি যেদিন কেবল বাবাকে নয়, মা–বাবা দুজনকে স্মরণ করিনি। বাবা–মা দুজনেই গত হয়েছেন অনেক আগে। চিরদিনের তরে বাবা যখন গেছেন তখন বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে সাংবাদিকতায় ঢুকেছি। যে–বেতন দিয়ে শুরু তা অফিস–বাসা রিক্সা ভাড়া আর মাঝে মধ্যে বন্ধু, সহকর্মীদের নিয়ে গলির মোড়ে বা রাস্তার ধারে সাধারণ মানের রেস্তোরাঁয় চা–সিঙ্গারা–সমুচা বড়জোর পরোটা কাঁটলেট খেয়ে ফুরিয়ে যেত। ভাগ্যিস বাবার ফ্রি–হোটেল ছিল, ছিল মাথার উপর ছাদ। উপার্জনের কানাকড়ি কোনদিন বাবাকে দেইনি। এমন না যে বাবার দরকার ছিলনা। খুব ছিল। কিন্তু ছিল না যা তা হলো, ‘দেয়া যে দরকার’ সেটি বুঝে উঠার মত ‘বোধ’। বাবা কোনদিন চাননি, আমিও কোনদিন দেইনি। বাবার ছিল বড় সংসার। ছিলেন আপাদমস্তক একজন সৎ সরকারি চাকুরে। বাবার বড়সড় বাসাটা ছিল অঘোষিত ‘সরাইখানা’। তাতে স্থায়ীভাবে থাকতেন গোটা দুই নিকট–আত্মীয়, আর একজন ভিন এক গ্রাম থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসা (থাকা) এক গরিব ছেলে। সে মাকে রান্নাঘরে সাহায্য করতো। গ্রাম থেকে আসতেন আত্মীয়, অনাত্মীয় অনেকেই। প্রায় প্রতিদিন। কেউ চাকরির আশায় বাবার কাছে, কেউবা জমি–জমার মামলায় কোর্টে হাজিরা দিতে। তার মধ্যে প্রায় সময় আসতেন দাদু, মায়ের বাবা। দাদু হলেও তিনি কখনো আমাদের আদর করে কাছে টেনে নেননি। তাকে কখনো হাসিমুখে কথা বলতে দেখেছি বলে মনে পড়েনা। সব সময় তার মেজাজ যেন তিরিক্ষি হয়ে থাকতো। তিনি ছিলেন পটিয়ার হাবিলাসদ্বীপ স্কুলের পালি শিক্ষক। ছিলেন লম্বা চওড়া সুদর্শন। তিনি এলে তার বড় মেয়ে অর্থাৎ আমার মা এবং তার স্বামী অর্থাৎ বাবা, দাদু ও তার সাথে আসা সঙ্গীদের আদর যত্নের যেন কোন কমতি না হয় সেদিকে ব্যস্ত থাকতেন। তাদের যে আধা–ডজনের বেশি স্কুল–কলেজ পড়ুয়া ছেলে–মেয়ে আছে সে সময় সেদিকে নজর দেবার খুব একটা সময় তাদের থাকতো না। অবশ্য তাতে ছেলে–মেয়েদের বিশেষ করে তাদের তৃতীয় পুত্র সন্তানের খুব একটা সমস্যা হতো বলে মনে হয়না। কেননা তৃতীয় পুত্র সন্তান মনে করতো লেখাপড়া নামক বিষয়টিকে ফাঁকি দেয়ার এই সুবর্ন সুযোগ। পাঠক মাত্রেই বুঝতে পারছেন সেই সন্তানটি আর কেউ নয়, আমি।
বাবার সাথে আমাদের সম্পর্ক ছিল যেন কেবল লেখাপড়ার। সারাটা জীবন, বিশ্ববিদ্যালয় তক দেখেছি তিনটি বিষয় তার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তা হলো– এক : লেখাপড়া, দুই : লেখাপড়া এবং তিন : লেখাপড়া। স্কুল, এমন কী কলেজ–জীবনেও পরীক্ষা শেষে বাসায় ফেরার আগে আর এক বড় পরীক্ষা দেবার প্রস্তুতি নিতে হতো। হাতে প্রশ্নপত্র নিয়ে বাবা কী লিখেছি জানতে চাইতেন। তারপর প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি কিনা, কী লিখেছি তা বলতে হতো। উত্তর ঠিক না হলে বকা ছিল অবধারিত। কিন্তু খুব কমই বকা খেতে হয়েছে। কেননা হল থেকে বের হয়ে প্রশ্নের উত্তরগুলি বই দেখে আওড়ে নিতাম। তবেই না বাসায় ফেরা এবং বাবার সামনে যাওয়া। বিষয়টা ছিল আমার কাছে ভয়ংকর ও বিরক্তিকর। কিন্তু বাবার মুখের উপর কিছু বলার সাহস ছিল না। বাবার বদ্ধ মূল ধারণা ছিল তার তৃতীয় পুত্র সন্তানের মেধা ভালো। বাইরের কেউ এলে বাবাকে বলতে শুনেছি, ওর মেধা ভালো কিন্তু পড়াশুনা একদম করেনা। দুটো কারণে বাবার বকুনি ছিল আমার প্রাত্যহিক পাওনা। এক, নিয়মিত লেখাপড়ায় মনোযোগ না দেবার জন্যে; দুই, সকালে ঘুম থেকে দেরিতে উঠার জন্যে। আমার এই জীবনে অনেক কিছুই ‘অধরা’ থেকে গেলো। তার মধ্যে অন্যতম, ঘুম। যদি বলা হয় হিমালয়ে উঠো। সে চেষ্টা করতে রাজি, কিন্তু সকালে ঘুম থেকে উঠা সে যেন আমার কাছে হিমালয়ে উঠার চাইতেও কঠিন কাজ। এই দেরিতে ঘুম থেকে উঠার কারণে বাবা প্রায় সময় বলতেন, ‘ও জীবনে মানুষ হবে না।’ বাবার এই বকা খেতে খেতে স্কুল–কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয় পার হলাম। সাংবাদিকতায় প্রবেশ করার পরও এই শব্দগুলি ‘সুধার‘ মত না লাগলেও প্রতিদিন সকালে হজম করতে হতো।
বাবার সরকারি বাসার সামনে যে বড়সর মাঠ তাতে আমরা বিকেলে খেলতাম। কখনো ফুটবল, কখনো ক্রিকেট। মুখোমুখি ১৮টি বাংলো টাইপের বাসা। মাঝখানে কংক্রিটের রাস্তা। তার এক মুখ চলে গেছে সিআরবি–র দিকে, আর এক মুখ স্টেশন রোডে গিয়ে মিশেছে। পাড়ার ভেতর যে–রাস্তা তাতে বাইরের কোন গাড়ি চলাচল করতো না। প্রতিটি বাসার সামনের মাঠে ল্যাম্পপোস্ট। সন্ধ্যা নামতেই নিয়নবাতিগুলি জ্বলে উঠতো। বাতি জ্বলার সাথে সাথে পড়ার টেবিলে হাজির হওয়া চাই– এ ছিল বাবার অলিখিত নিয়ম। সন্ধ্যার দিকে প্রায় সময় বাবা বসতেন বারান্দায় বেত ও কাঠের তৈরি দুটি আরামদায়ক চেয়ার বা সোফার একটিতে। নিচু গলায় বা শব্দ করে না পড়লে বাবা বকা দিতেন। মাঝে মধ্যে ইংরেজি শব্দের উচ্চারণ শুধরে দিতেন। বাংলা ও ইংরেজি– দুটোতেই বাবা ছিলেন দক্ষ। তার হাতের লেখা ছিল আক্ষরিক অর্থে মুক্তোর মতো। ইংরেজির প্রতি বাবার ছিল বিশেষ পক্ষপাতিত্ব। বাংলা পড়তে দেখলে বিরক্তি প্রকাশ করে বলতেন, ‘শুধু বাংলা বাংলা, ইংরেজি পড়।’ অগত্যা বাংলা রেখে ইংরেজি পড়তে হতো এবং শব্দ করে, যাতে বাবার কান তক পৌঁছায়। আজ ভাবি, বাবা যদি সে–সময় ইংরেজি পড়ার জন্যে প্রতিনিয়ত তাগিদ না দিতেন তাহলে আমার যে কী হতো তা একমাত্র উপরওয়ালাই জানেন। হয়তো কিছু একটা হতো, তবে আজ আমার যে অবস্থান সেখানে হয়তো পৌঁছা হতো না। ক্লাস সেভেন পর্যন্ত বাসার অনতিদূরে রেলওয়ে হাই স্কুলে পড়ার পর বাবা ভাবলেন, এবার ভালো কোন স্কুলে দেয়া চাই। ভর্তি হলাম কলেজিয়েট স্কুলে। শুরু হলো জীবনের নতুন অধ্যায়। ভালো স্কুলে পড়াশুনা যে ফাঁকিবাজদের জন্যে কঠিন স্থান সেটি টের পেলাম কলেজিয়েট স্কুলে গিয়ে। আমার জন্যে বাবার উদ্বেগের শেষ নেই। ম্যাট্রিক পরীক্ষার মাস কয়েক আগে একদিন বাসায় ডাকলেন কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক বিমল কান্তি বড়ুয়াকে। তিনি ছিলেন বাবার স্নেহধন্য। থাকতেন আলকরণের দিকে। প্রায় সময় বিকেলে আসতেন আমাদের বাসায়। বাবার সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা দিতেন। লক্ষ্য করেছি যারা লেখাপড়ায় ভালো তাদের প্রতি বাবার ছিল বিশেষ পক্ষপাতিত্ব, বাবা তাদের খুব স্নেহ করতেন। স্কুলে শিক্ষকদের মধ্যে বিমল কান্তি বড়ুয়া ছিলেন ভীষণ কড়া। ছাত্ররা তাকে খুব ভয় পেতো। বাবা তাকে বললেন, ‘সামনে তো ম্যাট্রিক পরীক্ষা, তুমি বিকাশের বাংলা ও ইংরেজিটা একটু দেখে দিও।’ মাস দুয়েক তার কাছে দুপুরে যেতাম প্রাইভেট পড়তে। অবশ্য কোন টাকা দিতে হয়নি। বাবার কাছে বিমল স্যার আজীবনের ঋণী। বাবা তাকে হাত ধরে শহরে এনে কলেজে ভর্তি করিয়েছিলেন এবং থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন ইত্যাদি ইত্যাদি। সে–কাহিনী বিমল স্যার তার লেখা বইয়ে উল্লেখ করেছেন। আমাকেও পরবর্তীতে তিনি অনেকবার বলেছিলেন। যাই হোক, সেই যে আমার বাংলা ও ইংরেজি, বিশেষ করে ব্যাকরণ শেখা বিমল স্যারের কাছে, সেই বিদ্যা নিয়ে আজ অবধি চলছি। ম্যাট্রিক ও ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় বাংলা ও ইংরেজি পরীক্ষায় ব্যাকরণে ফুল মার্কস পেয়েছিলাম।
পাশ তো দিলাম। এবার কলেজে ভর্তির পালা। ধরেই নিয়েছি চট্টগ্রাম কলেজে পড়বো। বাবাও পড়েছেন সেই কলেজে, আমাদের সবার বড়, সমরদা উনিও, পরবর্তীতে সহোদর সঞ্জয়। ভর্তি পরীক্ষা দিলাম। দেখা গেল উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের নামের তালিকায় আমার নাম নেই। আমার চাইতে উৎকণ্ঠা বেড়ে গেলো বাবার বেশি। এদিকে আমিও আর অন্য কোন কলেজে ভর্তি পরীক্ষার জন্যে আবেদন করিনি। ধরেই নিয়েছিলাম টিকে যাবো। ছাত্র হিসাবে তেমন মন্দ তো ছিলাম না। সেই ভাবনা থেকে। বাবা ডেকে পাঠালেন তার আর এক অতি স্নেহভাজন, বসুদাকে, পুরো নাম দিবাকর বড়ুয়া। সুদর্শন বসুদা তখন চট্টগ্রাম কলেজে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্সে পড়ছেন, খুব সম্ভবত সেকেন্ড কিংবা লাস্ট ইয়ারে। ছাত্র ভালো বিধায় কলেজ শিক্ষকের কাছে তিনি ছিলেন স্নেহভাজন। বসুদা বাবাকে আস্বস্ত করে বললেন, ‘দেখি স্যারের সাথে কথা বলে।’ ব্যবস্থা একটা হয়ে গেলো। আমার পৃথক ইন্টারভিউ নেয়া হলো একেবারে কলেজ প্রিন্সিপালের কামরায়। যেন ‘পড়বি তো পড় একেবারে মালির ঘাড়ে।’ ইন্টারভিউতে খুব ভালোভাবে উৎরে গেলাম। ইতিহাস বিভাগের এক শিক্ষক নিয়েছিলেন সেই ইন্টারভিউ। বললেন, ‘ভালোই তো করলে, তবে আগে এমন কেন হলো।’ তারপর যোগ করলেন এই বলে, ‘আমরা সাধারণত কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্রদের বাদ দেইনা। তারা দুষ্ট বটে, তবে লেখাপড়ায় ভালো।’ ভর্তি হলাম চট্টগ্রাম কলেজে। বাবা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। আমার চাইতেও বেশি উদ্বিগ্নে ছিলেন তিনি। বাবা লেগেই আছেন আমার পেছনে। আর লেগে আছে তার নিত্য বকাঝকা। কারণ সেই একটাই– লেখাপড়ায় মনোযোগ নেই। কলেজ পেরিয়ে অনার্সে ভর্তির পালা। পরীক্ষা দিলাম তিন বিভাগে– বাংলা, ইংরেজি ও অর্থনীতি। টিকে গেলাম ইংরেজি ও বাংলায়। পড়তে চাইলাম বাংলা। বাংলা ঝেঝিয়ে উঠে বলেন, ‘বাংলা দিয়ে কী হবে, ইংরেজি নিয়ে পড়।’
বাবা যখন পেনশনে গেলেন তখন বড় জন ছাড়া আমরা সব কটি ভাই বোন স্কুল–কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি। খরচ কুলিয়ে উঠতে না পেরে বাবা চাকরি নিলেন এক প্রাইভেট কোম্পানিতে। সন্ধ্যার দিকে ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরতেন। আমরা তখন লেখাপড়ার টেবিলে। ক্ষণিক বাদে হাতে থলে নিয়ে তিনি যেতেন রেয়াজউদ্দিন বাজার। কোনদিন বলেননি, তুই বা তোদের কেউ একজন বাজার নিয়ে আয়, পাছে লেখাপড়ার ক্ষতি হয়। আজ জীবনের অনেকটা পথ পেরিয়ে এসে ভাবি, কী হতো যদি বাবা অমন করে আমার লেখাপড়ার পেছনে লেগে না থাকলে। শেষের দিকে বাবার শরীরে যখন রোগ বাসা বাঁধলো, তখনও কাউকে বলেননি তার কী রোগ, কী কষ্ট। সবকিছু নিজের মাঝে গুটিয়ে রেখেছিলেন। কেবল আমাদের লেখাপড়ার জন্যে, সন্তানদের ‘মানুষ’ করার জন্যে নিজের ‘সকল’ উজাড় করে দিয়েছেন বাবা, নিজেকে নিঃশেষ করে। কিন্তু তাকে কিছুই ফিরিয়ে দেয়া হয়নি, দিতে পারিনি। এই দিতে না–পারার ব্যর্থতা, গ্লানি এই–জীবনে দূর হবার নয়। ফি–বছর ফেইস–বুক খুললে দেখি পরিচিত–অপরিচিত অনেকের তাদের বাবাকে নিয়ে ভালোবাসার কথা। আমার লেখা হয় না। এই ভেবে আর দশজনকে ‘জানান’ দিয়ে বাবা কিংবা মায়ের প্রতি ভালোবাসার কথা লিখতে হবে কেন? তাছাড়া যে কথা জীবদ্দশায় বলা হয়নি– ‘বাবা তোমাকে ভালোবাসি’, সে কথা এখন বলি কী করে। সে–কথা ঘটা করে বলা হয়নি মাকেও। তবে কি ধরে নিতে হবে বাবার প্রতি ভালোবাসা ছিল না, মায়ের প্রতি ভালোবাসা ছিল না? তা নয়। কিছুতেই নয়। ভালোবাসা বলে–কয়ে বেড়ানো বা লোক–দেখানোর বিষয় নয়। ভালোবাসা থাক মনের গহীনে। ভালোবাসা থাক বাবা–মা–সন্তানের মাঝে। চিরস্থায়ী হয়ে। গাঢ় হয়ে।
লেখক
সাংবাদিক, সাহিত্যিক, কলামিস্ট