বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) বহরে প্রায় সাড়ে ৯শ কোটি টাকা ব্যয়ে দুইটি নতুন জাহাজ যুক্ত হচ্ছে। দেশের ইতিহাসে এই প্রথম বিএসসি নিজস্ব অর্থায়নে জাহাজ কিনতে যাচ্ছে। জাহাজ কেনার ব্যাপারে ইতোমধ্যে বিএসসি আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করেছে। গতকাল সম্পন্ন হয়েছে প্রি–বিড মিটিং। আগামী বছরের শুরুতেই এই দুইটি জাহাজ বহরে যুক্ত হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে তিনটি জাহাজ কেনার ছয় বছর পর আবারো বিএসসি দুইটি জাহাজ কিনছে। এর আগে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত দুইটি অয়েল ট্যাংকার স্ক্র্যাপ হিসেবে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। এখন নতুন করে যে দুইটি জাহাজ কেনা হচ্ছে সেগুলো বাল্ক ক্যারিয়ার বলেও বিএসসি জানিয়েছে। বিএসসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কমোডর মাহমুদুল মালেক গতকাল দৈনিক আজাদীকে জানান, আমরা নিজস্ব অর্থায়নে দুটি জাহাজ কিনছি। নানাভাবে জাহাজ কেনার অর্থায়নের হিসেব নিকেশ করেছি। দেখলাম, ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট রাখার চেয়ে জাহাজ কেনা ভালো। তাই বিএসরি ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নিজস্ব অর্থায়নে জাহাজ কেনার জন্য আমরা গত ৪ জুন থেকে দরপত্র বিক্রি শুরু করেছি। ১৫ জুলাই পর্যন্ত দরপত্র গ্রহণ করা হবে, ১৬ জুলাই দরপত্র খোলা হবে। এরপরই মূল্যায়ন করে আমরা অগাস্টের মধ্যে ওয়ার্ক অর্ডার দিয়ে দেয়ার চেষ্টা করবো। ইতোমধ্যে আমরা প্রি–বিড মিটিং করেছি। আশা করছি ১৮টির মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান এতে অংশ নেবে।
কমোডর মাহমুদুল মালেক বলেন, দরপত্রে আমরা শর্ত দিয়েছি যারা কার্যাদেশ পাবেন, তাদেরকে চুক্তি স্বাক্ষরের ছয় মাসের মধ্যে বিএসসির কাছে জাহাজ হস্তান্তর করতে হবে। আশা করছি আগামী বছরের শুরুর দিকে আমাদের বহরে দুইটি নতুন জাহাজ যুক্ত হবে।
সূত্র জানিয়েছে, গত ৩০ অক্টোবর অনুষ্ঠিত বিএসসির বোর্ড সভায় নিজেদের বহর নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়। রাষ্ট্রীয় একটি ফ্লিটে মাত্র পাঁচটি জাহাজ থাকা মেনে নেয়া যায় না বলেও অনেকেই মন্তব্য করেন। পরবর্তীতে সর্বসম্মতভাবে দুটি জাহাজ কেনার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বোর্ড সভায় জাহাজ কেনার সিদ্ধান্ত নেয়ার পর কি ধরণের জাহাজ কেনা হবে তা নিয়েও আলোচনা হয়। তিন ধরণের অপশন রাখা হয়। প্রথমতঃ অর্ডার দিয়ে নতুন জাহাজ বানানো, দ্বিতীয়তঃ কোন ইয়ার্ডে নির্মাণাধীন থাকা জাহাজ পছন্দ করে কেনা এবং তৃতীয়তঃ পাঁচ বছরের কম পুরানো জাহাজ কেনা। তবে তিনটি অপশনের মধ্যে নির্মাণাধীন থাকা জাহাজ কেনার ব্যাপারে বোর্ডের সদস্যরা আগ্রহ প্রকাশ করে বলেন, তাহলে দ্রুততম সময়ের মধ্যে জাহাজ বহরে যুক্ত করা সম্ভব হবে। নতুন করে অর্ডার দিতে গেলে সময় বেশি লাগবে, আর পুরানো জাহাজে ঝুঁকি থাকে। দরপত্রের শর্তানুযায়ী, ৫৫ হাজার থেকে ৬৬ হাজার টন ধারণক্ষমতার খোলা পণ্যবাহী জাহাজ কিনছে বিএসসি। উন্মুক্ত এই দরপত্রে বিএসসির তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানের বাইরের যে কোন প্রতিষ্ঠানও অংশ নিতে পারবে। দরপত্র যাছাই বাছাই করে যোগ্য প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেয়া হবে।
উল্লেখ্য, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি যাত্রা শুরু করে বিএসসি। দেশের একমাত্র রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী সমুদ্রগামী জাহাজ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে যাত্রা শুরুর চার মাসের মাথায় ১৯৭২ সালের ১০ জুন এমভি বাংলার দূত নামের একটি জাহাজ দিয়ে সংস্থার বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু হয়। বিভিন্ন সময় এই সংস্থার বহরে যুক্ত হয় ৪৪টি জাহাজ। এক সময় এই সংস্থার বহরে একইসাথে ২৫টি জাহাজ চলাচল করতো। কিন্তু নানামুখি অনিয়ম এবং অব্যবস্থাপনায় বিএসসি লোকসান দিতে দিতে একেবারে দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম হয়। এক সময় এমন কথাও সংস্থায় প্রচলিত ছিল যে, জাহাজ বিক্রি করে সংস্থার কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতন ভাতার যোগান দিতে হয়। বয়সের কারণে একের পর এক স্ক্র্যাপ হওয়া জাহাজ বিক্রি করতে করতে ২০১৮ সালে এসে সংস্থার বহরে জাহাজের সংখ্যা মাত্র দুইটিতে নেমে আসে।
একপর্যায়ে ২০১৮ সালে দুটিতে নেমে আসে। এরপর চীন সরকারের আর্থিক সহায়তায় ১ হাজার ৮৪৩ কোটি টাকা ব্যয়ে বিএসসি’র বহরে ছয়টি জাহাজ কেনা হয়। ২০১৮ সালে তিনটি এবং ২০১৯ সালে তিনটি মিলে ওই ছয়টি জাহাজ নিয়ে বিএসসির বহর উন্নীত হয় ৮টি জাহাজে। ২০২২ সালের ২ মার্চ ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দরে রকেট হামলায় ‘এমভি বাংলার সমৃদ্ধি’ জাহাজটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। ২০২২ সালে বিএসসির বহর আবার ৭টি জাহাজে নেমে আসে। গত বছরের অক্টোবরে মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে ৩৭ বছরের পুরনো এমটি বাংলার সৌরভ ও এমটি বাংলার জ্যোতি জাহাজ দুটি অগ্নিকাণ্ডে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই দুইটি জাহাজ স্ক্র্যাপ হিসেবে পরবর্তীতে ৫৫ কোটি টাকায় বিক্রি করে দেয়া হলে বিএসসিতে জাহাজের বহর নেমে আসে মাত্র ৫টিতে। সমুদ্রগামী জাহাজ পরিচালনার রাষ্ট্রায়াত্ত্ব একমাত্র সংস্থার বহরে মাত্র ৫টি জাহাজের ‘কষ্টকর’ অবস্থা থেকে বের হতেই এবার নিজস্ব অর্থায়নে দুইটি নতুন জাহাজ কেনা হচ্ছে বলে জানিয়ে সূত্র বলেছে যে, আগামী বছরের শুরুতে এই দুইটি জাহাজ বহরে যুক্ত হলে বিএসসিতে জাহাজের সংখ্যা ৭টিতে উন্নীত হবে। এই সংখ্যাকে ক্রমাগত বাড়ানোর জন্য নিরলস চেষ্টা চলছে বলে মন্তব্য করে বিএসসির এমডি কমোডর মাহমুদুল মালেক গতকাল দৈনিক আজাদীকে বলেন, আমরা এবারও বেশ ভালো মুনাফা করবো। গতবছরও মুনাফা করেছি। মুনাফার এই ধারা অব্যাহত রেখে আমরা আমাদের বহরকে আরো সমৃদ্ধ করবো ইনশাআল্লাহ।