সম্প্রতি পত্র–পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে যে ঢাকার কাপাসিয়ায় অবস্থিত শহীদ তাজউদ্দিন সরকারি কলেজের নাম পরিবর্তন করে কাপাসিয়া সরকারী কলেজ নামকরণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কান্ডারি এবং স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের প্রধানমন্ত্রী শহীদ তাজউদ্দিনের নামে যে কলেজের নামকরণ করা হয়েছিল সে কলেজের নাম স্বাধীন বাংলাদেশে পরিবর্তনের ঔদ্ধত্য বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কর্তাব্যক্তিদের মধ্যে কার্ মাথায় এসেছে? তাহলে কি স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির কুলাঙ্গাররাই অধিষ্ঠিত হয়েছে? সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ইউনূস এবং শিক্ষা উপদেষ্টা প্রফেসর সি আর আবরারকে বলছি ব্যাপারটি যদি আপনাদের অগোচরে হয়ে থাকে তাহলে ভুল স্বীকার করে অবিলম্বে কলেজের নাম আবার শহীদ তাজউদ্দিন সরকারী কলেজে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করুন। নইলে এই অপকর্মের দায় ইতিহাস আপনাদের কাঁধেও অর্পণ করবে।
স্বৈরশাসক হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট যে ঐতিহাসিক গণ–অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে তার সুবিধাভোগী হয়ে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে এই গণ–অভ্যুত্থানে যে ছাত্র–ছাত্রীরা অংশ গ্রহণ করেছে তাদের মধ্যে সুকৌশলে ইসলামী ছাত্র শিবিরের ক্যাডারদের বিশাল একটি অংশ ঢুকে পড়েছিল এবং নেতৃত্বে চলে এসেছিল। অনেকে এমনকি প্রকাশ্যে ছাত্রলীগের পরিচয়–ধারণ করে নিজেদের আসল ঠিকানা লুকাতে সমর্থ হয়েছিল। পরবর্তীতে তারা তাদের আসল পরিচয় প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছে, এবং বর্তমানে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নামের একটি নূতন দল গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। তাদের নেতৃস্থানীয় অনেকেই প্রথম প্রথম মুক্তিযুদ্ধকে খাটো করার অপপ্রয়াস চালালেও তাদের বুঝতে দেরি হয়নি যে দেশের জনগণ এই ধৃষ্টতাকে কখনোই মেনে নেবে না। এখন তারা মুক্তিযুদ্ধকে আর সরাসরি অস্বীকার করে না, কিন্তু তাদের কার্যকলাপে সুযোগ পেলেই তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অবমাননা করতে দ্বিধা করে না। গণ–অভ্যুত্থানের সময় এবং অব্যবহিত পরের দিনগুলোতে তারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে গণ–ভাঙচুর–অভিযান চালালেও শহীদ তাজউদ্দিনের বেশ কয়েকটি ভাস্কর্যে ফুলের মালা পড়িয়ে সম্মান জানিয়েছিল। কিন্তু, এখন শহীদ তাজউদ্দিনের নাম কলেজের নাম থেকে মুছে ফেলতে চাইছে কারা এবং কেন? ৪ জুনের পত্র–পত্রিকায় দেখলাম, বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দিনকে ‘মুক্তিযোদ্ধার’ তালিকা থেকে বাদ দিয়ে ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’র তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার নাকি সিদ্ধান্ত নিয়েছে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানীদের কারাগারে বন্দী থাকলেও তাঁর নামেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল। আর, শহীদ তাজউদ্দিন ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী। তিনি ছিলেন সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত মুক্তিযোদ্ধা—তিনি কেন ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’ হতে যাবেন? মুক্তিযুদ্ধের ‘প্রধান সেনাপতি’ জেনারেল ওসমানী সরাসরি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের কমান্ডে থেকে তাঁর কার্যালয় থেকেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছেন। তাহলে, জেনারেল ওসমানীও কি ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’? অবশ্য খবরটি প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে এটাকে মিথ্যা–গুজব আখ্যা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপদেষ্টা ফারুকে আজম মিডিয়ায় এসে বলেছেন,‘এরকম কোন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। বঙ্গবন্ধুসহ মুজিবনগর সরকারের সকল মন্ত্রীই মুক্তিযোদ্ধা। কোন একটি মহল ব্যাপারটার ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে সরকারকে জনগণের মুখোমুখি করতে চাইছে’। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল যে মুজিবনগরের আম্রকাননে বাংলাদেশের প্রথম সরকার শপথ গ্রহণ করেছিল সেখানকার স্মৃতিসৌধের বেশ কয়েকটি ভাস্কর্য ভেঙ্গে ফেলেছিল জামায়াত–শিবিরের ক্যাডাররা, ওগুলো আজো মেরামত করা হয়নি। ঐ স্মৃতিসৌধে বঙ্গবন্ধু কখনো যাননি, স্বৈরশাসক হাসিনাও কখনো যাননি। তাহলে, মুক্তিযুদ্ধের এই ঐতিহাসিক স্থানটির প্রতি আন্দোলনকারীদের বিরাগের কারণ কী?
আমরা পাঠকদেরকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, স্বৈরশাসক হাসিনা তাঁর শাসনামলে কখনোই শহীদ তাজউদ্দিনের প্রাপ্য মর্যাদা প্রদান করেননি। তাঁর অবদানকে খাটো করার সর্বাত্মক প্রয়াস হাসিনা অব্যাহত রেখেছেন ১৯৮১ সালের মে মাসে দেশে ফেরার পর থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হওয়া পর্যন্ত পুরো সময়টায়। বেগম জোহরা তাজউদ্দিন তাঁর জীবদ্দশায় বরাবরই হাসিনার অবজ্ঞার শিকার হলেও তিনি কখনোই আওয়ামী লীগের জন্য ক্ষতিকর হবে ভেবে এর প্রতিবাদ করেননি। ছেলেমেয়েদের প্রতিও বেগম জোহরা তাজউদ্দিনের কঠোর নির্দেশ ছিল বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে কোন বক্তব্য রাখা যাবে না। অথচ, এই জোহরা তাজউদ্দিন ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আওয়ামী লীগকে চরম দুর্দিনে নেতৃত্ব দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। ১৯৮১ সালে তাঁর স্থলেই আওয়ামী লীগের সভাপতি বানানো হয়েছিল শেখ হাসিনাকে, তিনি বিরোধিতা করেননি। তাঁর মৃত্যুর কিছুদিন আগে জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত তাজউদ্দিনের এক স্মরণসভায় আমি আলোচক হিসেবে তাজউদ্দিন যথাযথ স্বীকৃতি ও সম্মান না পাওয়ার বিষয়টি বিভিন্ন প্রমাণের মাধ্যমে তুলে ধরার পর যখন মিলনায়তনে তাঁর সান্নিধ্যে উপস্থিত হয়েছিলাম তখন মাথা নাড়িয়ে বিষয়টি মেনে নিয়ে আমাকে বলেছিলেন,‘আপনাকে এ–বিষয়ে পরে জানাবো’। দুঃখজনকভাবে সে সুযোগটি আর আসেনি। ২০১৪ সালে তাজউদ্দিনের কন্যা শারমীন আহমদের সাড়া জাগানো বই ‘তাজউদ্দিন—নেতা ও পিতা’ এর প্রকাশনা অনুষ্ঠানে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে যখন আমার বক্তব্যে তাজউদ্দিনের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ের অতুলনীয় আত্মত্যাগ ও অমানুষিক পরিশ্রমের কাহিনী বলতে গিয়ে আমি কেঁদে ফেলেছিলাম তখন মিলনায়তনের সব দর্শক–শ্রোতা দাঁড়িয়ে আমাকে সম্মান জানিয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধের কান্ডারি তাজউদ্দিনের প্রাপ্য সম্মান ও মর্যাদা প্রদানের ব্যাপারে হাসিনা সরকারের মত এখনো বিস্ময়কর কৃপণতা দেখানো হবে কেন? ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বিকেলে যখন ইয়াহিয়া খান ঢাকা ত্যাগ করলেন তখনই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বাঙালি জাতির ওপর সশস্ত্র আঘাত হানতে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বেরও এ–ব্যাপারে প্রস্তুতি ছিল। পরিকল্পনা মোতাবেক বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দিন আন্ডারগ্রাউন্ডে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করার কথা ছিল; বঙ্গবন্ধু এ–ব্যাপারে সম্মতি দিয়েছিলেন। ২৫ মার্চের ভয়াল রাতে আক্রমণের জন্যে সেনাবাহিনী ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে রওনা হওয়ার খবর পেয়েই তাজউদ্দিন বঙ্গবন্ধুর বাসায় গেলেন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যেতে, পুরানো ঢাকার একটি বাসাও ঠিক করে রাখা হয়েছিল আত্মগোপনের জন্যে। কিন্তু, ইতিহাসের ঐ যুগসন্ধিক্ষণে শেষ মুহূর্তের সিদ্ধান্তে বঙ্গবন্ধু কোথাও যেতে রাজী হলেন না। তাজউদ্দিনের তাবৎ কাকুতি–মিনতি বিফলে গেলো। বঙ্গবন্ধুর এক কথা, ‘তোমরা যা করার কর, আমি কোথাও যাবনা’। পূর্ব–পরিকল্পনা অনুযায়ী তাজউদ্দিন একটি স্বাধীনতার ঘোষণাও লিখে নিয়ে গিয়েছিলেন, এবং টেপরেকর্ডারও নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু, বঙ্গবন্ধু টেপে ঘোষণা দিতে বা স্বাধীনতার ঘোষণায় স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানালেন। বঙ্গবন্ধুর মন্তব্য,‘এটা আমার বিরুদ্ধে দলিল হয়ে থাকবে। এর জন্যে পাকিস্তানিরা আমাকে দেশদ্রোহের জন্যে বিচার করতে পারবে’। বঙ্গবন্ধুকে আত্মগোপনে যেতে কিংবা স্বাধীনতা ঘোষণায় রাজী করাতে না পেরে বিক্ষুব্ধ চিত্তে নিজ ঘরে ফিরে গিয়েছিলেন তাজউদ্দিন। এরপর কীভাবে ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম তাজউদ্দিনকে বাসা থেকে নিজের গাড়িতে তুলে নিয়ে লালমাটিয়ার এক বাড়িতে আত্মগোপন করেছিলেন এবং ২৭ মার্চ কারফিউ প্রত্যাহারের পর জীবন বাজী রেখে তিন দিন তিন রাতের কঠিন ও বিপদসঙ্কুল যাত্রা পার হয়ে ৩০ মার্চ কুষ্টিয়ার জীবননগর সীমান্তের টুঙ্গি নামক জায়গার একটি কালভার্টের ওপর পৌঁছে তওফিক ইলাহী চৌধুরী এবং মাহবুবউদ্দিন আহমদকে বিএসএফ এর ক্যাম্পে আলোচনার জন্যে পাঠিয়েছিলেন তার মনোমুগ্ধকর বর্ণনা শারমিন আহমদের বইটির ১০৬–১১০ পৃষ্ঠায় উল্লিখিত আছে। জনাব তাজউদ্দিন ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর এক সাক্ষাৎকারে জাতিকে জানিয়েছিলেন, টু্ঙ্গির ঐ কালভার্টের ওপর অপেক্ষা করার সময়েই তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে একটা স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করবেন, এবং তজ্জন্যে ভারতের সাহায্য কামনা করবেন। সফল আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে কিছুক্ষণের মধ্যেই তাজউদ্দিন এবং ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামকে বিএসএফ এর ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। খবর পেয়ে সেখানে ছুটে আসেন বিএসএফ এর পশ্চিমবঙ্গের আঞ্চলিক প্রধান গোলোক মজুমদার। তাঁর মাধ্যমে বিএসএফ মহাপরিচালক সুন্দরজি খবর পেয়ে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। মিসেস গান্ধী তাজউদ্দিন এবং ব্যারিস্টার আমিরুলকে সাক্ষাৎ দানে সম্মত হওয়ায় তাঁদেরকে নয়াদিল্লী নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। দিল্লী পৌঁছানোর পর এপ্রিলের ৩ তারিখে শ্রীমতি গান্ধীর সাথে তাঁদের সাক্ষাৎ ও আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। দিল্লীতে এরই মাঝে গিয়ে পৌঁছান বাংলাদেশের দুজন খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ প্রফেসর রেহমান সোবহান ও ডঃ আনিসুর রহমান। তাঁরাও আলোচনায় শরীক হতে শুরু করেন। একাধিক আলোচনা বৈঠকের পর ১০ এপ্রিল জনাব তাজউদ্দিন বেতার ভাষণে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের ঘোষণা প্রদান করেন, যাতে মার্চের অসহযোগ আন্দোলনের সময় বঙ্গবন্ধু কর্তৃক গঠিত হাই কমান্ডের সদস্যদেরকে মন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা করা হয়। স্বাধীনতা ঘোষণার ঐ ভাষণটির মুসাবিদা করেছিলেন জনাব তাজউদ্দিন, ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম এবং প্রফেসর রেহমান সোবহান। এই পরিপ্রেক্ষিতেই রচিত হয়েছিল ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিলের মুজিবনগর দিবসের ইতিহাস। ইতিহাসের অবিনশ্বর রায় হলো, জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠন আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে সারা বিশ্বের কাছে ‘অবিসংবাদিত বৈধতা’ দিয়েছিল। এই ইতিহাসের স্রষ্টাকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান দিতে অপারগতা কেন?
মুক্তিযুদ্ধের সময় তাজউদ্দিন থিয়েটার রোডের অফিসকক্ষের পাশের কক্ষে রাত কাটিয়েছেন। যদিও তাঁর স্ত্রী ও সন্তানরা পরবর্তীতে কোলকাতায় গিয়েছিলেন, কিন্তু তাজউদ্দিন একদিনও তাঁদের সাথে বাসায় থাকেননি। মাত্র দুটো শার্ট–প্যান্ট ছিল তাঁর পরিধেয়, গোসলের সময় নিজ হাতে কাপড়গুলো ধুয়ে পরদিন ওগুলো পড়ে তিনি অফিস করতেন। দিনে–রাতে প্রায় সতেরো–আঠারো ঘন্টা তিনি কর্মব্যস্ত থাকতেন। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক ক্রান্তিলগ্নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মুক্তির বিনিময়ে পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের কনফেডারেশন গঠনের মার্কিন প্রস্তাবে সায় দিয়ে খোন্দকার মোশতাকের গোপন ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করে ‘স্বাধীনতা, শুধুই বাংলাদেশের স্বাধীনতার’ সপক্ষে তাজউদ্দিনের আপসহীন অবস্থান গ্রহণকে সম্মান জানানো কি জাতির অবশ্য–কর্তব্য নয়? বিজয় অর্জনের পর ১৯৭১ সালের ২২ ডিসেম্বর তাজউদ্দিন ঢাকায় ফিরে এসে সরকারের হাল ধরেছিলেন। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে আসার পর যখন প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন তখন নিরবে ঐ সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছিলেন তাজউদ্দিন। ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি দেশের অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে সরকারে যোগ দিয়েছিলেন তাজউদ্দিন। কিন্তু, শেখ মনি ও খোন্দকার মোশতাক চক্রের ফাঁদে পড়ে (কিংবা পরিবারের অন্য কারো মাধ্যমে) তাজউদ্দিন সম্পর্কে উল্টা–পাল্টা ধারণা পেয়ে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। ফলে, বঙ্গবন্ধুর আস্থা হারিয়ে ফেলে তাজউদ্দিন ঐ সরকারের মেয়াদের প্রথম থেকেই মন্ত্রীসভায় কোনঠাসা হয়ে পড়েছিলেন। ১৯৭৪ সালের অক্টোবরে সরকার থেকে পদত্যাগ করতে আদিষ্ট হয়েছিলেন তিনি । কিন্তু স্বাধীনতা–উত্তর ঐ চরম দুর্দশার দিনগুলোতে মন্ত্রীসভার সবচেয়ে মেধাবী ও কর্তব্যপরায়ণ সদস্য হিসেবে সবার শ্রদ্ধার আসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন তাজউদ্দিন। যেদিন বঙ্গবন্ধু তাঁকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করলেন সেদিন এক বন্ধুর গাড়ি আনিয়ে তিনি অফিস থেকে বাসায় ফিরেছিলেন, অফিসিয়াল গাড়ি ব্যবহার করেননি। তাজউদ্দিন মন্ত্রী থাকার সময়ে তাঁর সন্তানরা স্কুলে যেতো রিকশায় চড়ে, অফিসিয়াল গাড়ি তাঁরা পায়নি। প্রচন্ড কৃচ্ছতাসাধন করতে বাধ্য করতেন পুরো পরিবারকে। ঐ সময়ের বাংলাদেশের চরম দুর্দশার কথা তিনি সবসময় মনে করিয়ে দিতেন সন্তানদেরকে। জাতির দুর্ভাগ্য যে তাজউদ্দিনের মত এত মেধাবী, কর্মনিষ্ঠ ও ত্যাগী নেতাকে আমরা হারিয়ে ফেলেছিলাম মনি–মোশতাক চক্রের কূটকৌশলে।
লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়