(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
দারুণ ঘুম হলো রাতে। দিনভর পাহাড় এবং গুহায় ঘোরাঘুরি করতে গিয়ে শরীর যে কী পরিমান কাহিল হয়েছিল তা ঘুম ভাঙ্গার পর টের পেলাম। শরীরে ব্যাথা টের পেলেও ফুরফুর করছিল মেজাজ। লায়ন ফজলে করিম ভাই ফোন করে ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিলেও রাগ হচ্ছিলো না। ফুরফুরে মেজাজে বেশ মজা করে কথা বলছিলাম। তিনি আমার মজা কতটুকু বুঝলেন কে জানে, তবে তাড়া দিলেন। বললেন, গাড়ি চলে এসেছে। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিন। নাস্তা সেরেই গাড়িতে উঠতে হবে। নাহয় বিমান মিস করবেন।
আজ আমরা কুনমিং থেকে দেশে ফিরবো। করিম ভাইয়ের কথা শুনে দেশে ফেরার একটি উত্তেজনাও অন্তরে টের পেলাম। রাতেই লাগেজ গুছিয়ে রেখেছি। এখন টুকটাক জিনিসপত্র ব্যাগে ঢুকিয়ে বেরিয়ে পড়লেই হলো। আমি টুকটাক জিনিসগুলো ব্যাগে ঢুকিয়ে লাগেজ নিয়েই একেবারেই রুম থেকে বের হয়ে এলাম। সচেতনভাবে দরোজা লক করে চাবিটি হাতে নিলাম। রুম থেকে বের হওয়ার সময় মনে হলো, চীনের কুনমিং শহরের প্রতিটি অলিগলি যেন হৃদয়ে গেঁথে গেছে। পাহাড়, গুহা, পাথরের বন আর রাতের শহরের আলো–আঁধারি। সবকিছু মিলিয়ে এক অপূর্ব অনুভবের বন্ধন তৈরি করে ফেলেছে কুনমিং। সেই শহর ছেড়ে যাওয়ার সময় আসবে জানতাম, কিন্তু বিদায় বেলার মুহূর্তটা যে এমন হৃদয়ে মোছড় দেবে, সেটা আগে বুঝিনি।
হোটেলের লবির পাশেই রেস্টুরেন্ট। তেমন বড় রেস্টুরেন্ট নয়, মোটামুটি। আমরা এই রেস্টুরেন্টে ব্রেকফাস্ট করেই গাড়িতে চড়বো। আমাদের ড্রাইভার বিল ইতোমধ্যে চলে এসেছে। সে আমাদেরকে এয়ারপোর্ট পৌঁছে দেবে। রেস্টুরেন্টে যাওয়ার আগে আমি রিসিপশনে গিয়ে চেকআউট করলাম। যথারীতি ক্লিয়ারেন্সও নিয়ে নিলাম। ডেস্কে বসা চ্যাপ্টা নাকের চীনা মেয়েটি বেশ ত্বরিৎকর্মা। ইন্টারকমে আমার রুমের ফ্লোরে ফোন করে কি কি সব জানতে চাইলো। ফোনে কথা বলতে বলতে সে কম্পিউটারে টাইপ করছিল। ফোন রেখেই আমাকে ক্লিয়ারেন্স পেপার সাইন করে দিয়ে দিলো। মেয়েটির দক্ষতা আমাকে মুগ্ধ করলো। দুনিয়ার বহু ফাইভস্টার হোটেলেও এমন ত্বরিৎকর্মা মেয়ে আমি দেখেছি বলে মনে করতে পারলাম না।
রেস্টুরেন্টে নাস্তার আয়োজন অনেক। পাঁচতারকা হোটেলের মতো না হলেও এরাও খুব একটা কম যায় না। আমাদের হোটেলটি তিন তারকা মানের। রেস্টুরেন্টে নানা ধরনের স্থানীয় খাবারের সাথে পূর্ব এবং পশ্চিমের রকমারি খাবার থরে থরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। রাখা হয়েছে মৌসুমী নানা ফল–ফলাদিও। আমরা ব্রেট–বাটার, ডিম, কমলা, আপেল এবং কলা দিয়ে ব্রেকফাস্ট সারলাম। নাস্তা শেষে মগভর্তি কফি নিলাম, করিম ভাই এবং ডালিয়া ভাবী গ্রিন টি। নিজেদেরকেই এসব বানিয়ে নিতে হলো। আমাদের ফ্লাইটের সময় এখনো দেরি আছে, তবে করিম ভাইয়ের ব্যস্ততা দেখে মনে হচ্ছিলো বিমান উড়াল দিয়েছে।
ব্রেকফাস্ট শেষে আমরা নিচে নেমে আসলাম। বিল আমাদের লাগেজগুলো সুন্দর করে গাড়িতে তুলে নিলো। আমরা রওনা হলাম কুনমিং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উদ্দেশে। আমাদের হোটেল থেকে বিমানবন্দর প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে। ট্রাফিকের তেমন ঝামেলা ছিল না, তবে শহরের সুশৃঙ্খল রাস্তাঘাট এবং মনোরম সব দৃশ্য আমাকে বিমোহিত করছিল। এটা সেই শহর, যেখানে পুরোবছরই বসন্ত খেলা করে।
রাস্তার দুই ধারে ছিল পরিচ্ছন্ন ফুটপাথ, গাছগাছালী। মাঝে মাঝেই চোখে পড়লো চায়নিজ লণ্ঠন ও ফুলে ফুলে সাজানো মেডিয়ান। ওয়ান–ওয়ে সড়কটির স্পিডলিমিট কত জানি না, তবে গাড়িগুলো তীব্র বেগে ছুটছিল। প্রচুর গাড়ি ছুটছে, মনে হয় সবাই বিমানবন্দরেই যাবে। চীনের অন্যতম ব্যস্ত বিমানবন্দর কুনমিং। স্বাভাবিকভাবেই গাড়ির চাপ বেশি থাকবে। শহর থেকে কিছুদূর আসার পর আমাদের গাড়ি এক্সপ্রেসওয়েতে উঠে পড়লো। গাড়ি যেন নতুন গতি পেলো। সবুজ পাহাড়ের মাঝে দিয়ে বয়ে যাওয়া আধুনিক সড়কটি যেন প্রকৃতির বুক চিরে গড়ে তোলা এক অনন্য নিদর্শন। আমি গাড়ির কাচ নামিয়ে দিলাম। বিদায়বেলায় কুনমিংকে একটু ভালো করে দেখে যেতে চাই। গাড়ির জানালায় চোখ রেখে শেষবারের মতো দেখছিলাম সেই শহর, যেটা গত কয়েকদিনে আমার আপন হয়ে উঠেছিল। বাতাসে হালকা ঠাণ্ডা, কোন ধুলোবালি নেই। নির্মল বাতাসে শ্বাস নেয়ার সুখ হৃদয় দিয়ে অনুভব করছিলাম।
গাড়ি ছুটছিল। ক্রমে এগিয়ে আসছিল বিমানবন্দর, ক্রমে এগিয়ে আসছিল বিদায়ের ঘন্টা। দিনকয়েকে আপন হয়ে উঠা চেনা একটি শহরকে পেছনে ফেলে চলে যাচ্ছি। গত ক’দিনে খুব বেশি না চিনলেও এই শহরের অলি–গলি– রাজপথ প্রচুর মাড়িয়েছি। দেখেছি নানাকিছু। সত্যি বলতে কি, ভালো লাগার এক জনপদে পরিণত হয়েছিল শহরটি।
আধঘণ্টার মধ্যেই আমরা পৌঁছে গেলাম কুনমিং চাংশুই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। পাহাড় সেঁটে মাটি সমতল করে বিশাল বিমান বন্দরটি বানানো হয়েছে, যা দূর থেকে দেখতে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা এক দুর্দান্ত স্থাপত্যকীর্তির মতো লাগছিলো।
গাড়ি থেকে নামার পর বিল আমাদের লাগেজগুলো নামিয়ে ট্রলিতে তুলে দিল। আমাদেরকে কোন লাগেজে হাত লাগাতে দিলো না। সে আমাদের বিদায় জানালো সেই চেনা হাসি দিয়ে। বাংলায় বললো, আবার আসবেন। আসলে আমাকে ডেকে নিয়েন। আরো বহু জায়গা আছে, আপনাদের নিয়ে যাবো। বিলকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম, কিছু ট্রিপসও গুছে দিলাম হাতে। কিছু মানুষ খুব অল্প সময়েই মন ছুঁয়ে দেয়, নিজের জায়গা করে নেয় অন্তরে, বিল ঠিক তেমনি একজন মানুষ। ওর মুখটা দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, বিদায়ের এই ছবিটুকু অনেকদিন মনে রাখতে চাই। আবারো যদি কখনো দেখা হয়ে যায় তাহলে বিলকে যেনো প্রথম দেখাতেই চিনতে পারি!
ট্রলি ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করতে যাওয়ার সময়ই নিরাপত্তা তল্লাশীতে পড়লাম। বিমানবন্দরের প্রবেশপথের নিরাপত্তা খুবই কড়া। আমাদের পাসপোর্ট এবং টিকিট স্ক্যান করা হলো। সবকিছু মিলিয়ে দেখেই আমাদের ভিতরে ঢুকতে দিলো। শুধু চীন নয়, বিশ্বের প্রায় সব বিমানবন্দরেই প্রবেশের সময়েই সিকিউরিটি স্ক্যান হয়, যেখানে লাগেজ এবং শরীর দুটিই পরীক্ষা করা হয়। নাইন ইলেভেনের বহুল আলোচিত ঘটনার পর বিশ্বব্যাপী তল্লাশি জোরদার করা হয়েছে।
বিমানবন্দরে প্রবেশ করে প্রথমেই চোখে পড়লো বিশাল লবি। উঁচু ছাদ, ঝকঝকে টাইলস, আর আধুনিক ডিজাইনের বাতি–সব মিলিয়ে সত্যিকারের একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আবহ চারদিকে। মানুষে মানুষে গিজগিজ করছে। চেক–ইন কাউন্টারে বিশাল লম্বা লাইন। অনেকগুলো ফ্লাইটের একইসাথে চেকইন করছিল। ধীরলয়ে এগিয়ে কাউন্টারের তরুণীর হাতে পাসপোর্ট এবং টিকিট দিলাম। তিনি কম্পিউটারে টেপাটেপি করলেন। আমি আস্তে করে বললাম,উইন্ডো প্লিজ। তরুণী মুখে কিছু না বলে আমাদের লাগেজের ওজন নিলো। অতঃপর বোর্ডিং পাস দিলো। সিট নম্বর দেখে বুঝতে পারলাম যে, বেচারি পটেছে, আমাকে উইন্ডো সিটই দেয়া হয়েছে। এয়ারলাইন্সের কর্মীদের যথেষ্ট হেল্পফুল এবং পেশাদার মনে হলো।
লাগেজ দিয়ে দেয়ার পর শুধু কেবিন ব্যাগ হাতে নিয়ে সামনে এগুলাম। ইমিগ্রেশন করতে হবে। ওখানে পৌঁছেও বেশ কয়েকটি লাইনের দেখা পেলাম। পৃথক পৃথক লাইনে বিভক্ত হয়ে যাত্রীরা ইমিগ্রেশন করছেন। ইমিগ্রেশনের তরুণী অফিসার আমাদের পাসপোর্ট স্ক্যান করে মুখমণ্ডল মিলিয়ে দেখলেন। কোন দেশে প্রবেশ করার সময় ইমিগ্রেশনে নানা প্রশ্ন করা হয়, বের হওয়ার সময় কোন প্রশ্ন থাকে না। শুধু পাসপোর্টে একটি সিল দিয়ে হাতের ইশারায় সামনের পথ দেখিয়ে দেন। ভাবখানা এমন যে, দেশ ছাড়লেই বাঁচি!
ইমিগ্রেশন শেষে আমরা পৌঁছালাম ডিপারচার লাউঞ্জে। এখানেই সময় কাটানোর জন্য রয়েছে আধুনিক সব সুবিধা। ক্যাফে, দোকানপাট, স্যুভেনির শপ, এমনকি বইয়ের স্টলও। আমি এবং করিম ভাই একটি ক্যাফেতে বসে কফি খেলাম। ডালিয়া ভাবি দোকানে দোকানে হাঁটছিলেন। হাত দেখে বুঝতে পারলাম যে, তিনি এখানেও কিছু কেনাকাটা করেছেন। কাছে এসে দেখালেন, তিনি গিফট দেয়ার জন্য কিছু স্যুভেনির কিনেছেন।
বিমান উড্ডয়নের সময় ঘনিয়ে এলো। নির্দিষ্ট সময়ে গেট খুলে গেল, আমরা একে একে বোর্ডিং করলাম। বিমানে ওঠার সময় আমাদের বোর্ডিং পাস ও পাসপোর্ট আবারো চেক করা হলো। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী