উৎপাদন খরচ ৩০০, বিক্রি ২২০ টাকা

লবণ নিয়ে হতাশ চাষি

শাহেদ মিজান, কক্সবাজার | বুধবার , ২৯ জানুয়ারি, ২০২৫ at ৮:৪২ পূর্বাহ্ণ

মহেশখালীর হোয়ানকের চাষি মোহাম্মদ সাকের ৬ কানি জমি ইজারা নিয়ে লবণ চাষ করছেন। নিজে তো সকালসন্ধ্যা খাটছেনই, প্রয়োজন পড়ছে দৈনিক ভিত্তিতে মজুরি দিয়ে আরও একজন শ্রমিক রাখার। মৌসুমের এখন মধ্য সময়। আবহাওয়া অনুকূল থাকায় প্রত্যাশানুসারে লবণ উৎপাদন হচ্ছে। এতে খুশি হওয়ার কথা থাকলেও বেশ দুশ্চিন্তায় আছেন এই লবণ চাষি। কারণ ভালো উৎপাদন হলেও দাম চলে গেছে তলানিতে! বর্তমানে এক মণ লবণ বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ২২০ টাকায়। কিন্তু মণপ্রতি উৎপাদন খরচ পড়ছে ৩০০ টাকার বেশি।

শুধু মো. সাকের নয়; কক্সবাজার উপকূলের কুতুবদিয়া, মহেশখালী, চকরিয়া, পেকুয়া, টেকনাফ, কঙবাজার সদরের এবং পার্শ্ববর্তী বাঁশখালীর প্রায় ৬৫ হাজার চাষি একই দুশ্চিন্তায় ভুগছেন। মো. সাকের বলেন, বর্তমানে যে দাম রয়েছে তাতে জমির দাম, শ্রমিকের মজুরি ও অন্যান্য খরচ উঠবে না। আমার নিজেরও মজুরি রয়েছে। একমাত্র পেশা হিসেবে এটি দিয়ে সংসার চলে। কিন্তু বর্তমানে আমি কোনো কূলকিনারা দেখতে পাচ্ছি না। আমার পরিবারপরিজনের অন্ন কোথা থেকে জোগাড় হবে?

কক্সবাজার লবণ চাষি কল্যাণ সমিতির সূত্রে জানা গেছে, গত বর্ষা মৌসুমে সর্বোচ্চ মণ ৫৫০ টাকায় সংরক্ষিত লবণ বিক্রি হয়েছে। অগ্রহায়ণ মাসে চলতি উৎপাদন মৌসুম শুরু হওয়ার সাথে সাথে হঠাৎ দরপতন শুরু হয়েছে। ৫৫০ টাকা থেকে এক লাফে ২২০ টাকায় নেমে আসে। ক্ষেত্র বিশেষ আরো কম দামেও বিক্রি করতে হচ্ছে। কিন্তু গত মৌসুমে ঠিক এই সময়ে দাম ছিল ৪৪০ টাকার উপরে।

কক্সবাজার লবণচাষি কল্যাণ সমিতির সভাপতি এডভোকেট সাহাব উদ্দীন জানান, তিন কানি জমি ১ লাখ ২০ হাজার থেকে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকায় ইজারা নিতে হয়েছে। মাঠ তৈরি করতে খরচ পড়েছে পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা, পানি সেচ খরচ ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা, পলিথিন খরচ ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা এবং উৎপাদনের শ্রমিক প্রায় দেড়লাখ টাকাসব মিলিয়ে কানি প্রতি প্রায় এক লাখ ২০ হাজার টাকা খরচ পড়বে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে লবণ উৎপাদিত হবে ৩০০ থেকে ৩৫০ মণ। এতে প্রতি মণ লবণ উৎপাদন খরচ পড়বে ৩৫০ টাকা। প্রতি মণ লবণের বর্তমান বিক্রয় মূল্য ২০০ টাকা। এই হিসাবে তিন কানিতে লোকসান হবে এক লাখ টাকার বেশি। গত বছর লবণ উৎপাদনে চাষিরা ভালো টাকা পাওয়ায় জমির ইজারা মূল্য এবার আরও বেড়েছে। সাহাব উদ্দীন বলেন, সম্প্রতি কালোবাজারির সিন্ডিকেট একটি বড় চালান আমদানির চেষ্টা করেছিল। খবর পেয়ে আমরা সরকারকে জানালে তা আটকে দেয়। কিন্তু এরপর রহস্যজনক কারণে আরো দাম কমেছে।

সরেজমিনে কথা হলে কক্সবাজার সদরের চৌফলদন্ডীর লবণচাষি মো. হোসেন প্রশ্ন রেখে বলেন, এভাবে লবণের দরপতন হলে আমরা কোথায় যাব? আমাদের তো আর কোনো উপায় নেই। এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে পরিবারপরিজন নিয়ে উপোস থাকতে হবে।

আরেক চাষি আবদুল হামিদ কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, বর্ষা মৌসুমে মোটামুটি দাম থাকলেও বর্তমান উৎপাদন মৌসুমে অর্ধেকের বেশি দাম কমেছে। এভাবে দরপতন হওয়ায় চোখে অন্ধকার দেখছি। সরকারে উচিত চাষিদের কথা মাথা রেখে লবণের দাম ঠিক করে দেয়া।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র কুটির শিল্প (বিসিক) সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজার উপকূলের লবণ উৎপাদনের ৬২ বছরের ইতিহাসে গেল মৌসুমে রেকর্ড পরিমাণ ২৪ লাখ ৩৮ হাজার মেট্রিক টন লবণ উৎপাদিত হয়েছিল। এর মধ্যে উৎপাদিত চার লাখ মেট্রিক টন লবণ মজুদ ছিল চাষিদের কাছে। চলতি মৌসুমে অপরিশোধিত লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ২৬ লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টন।

বিসিকের তথ্য মতে, গত বছর ঠিক এই সময়ে লবণ উৎপাদন হয়েছিল এক লাখ ৬৩ হাজার ৪৭২ মেট্রিক টন। আর চলতি উৎপাদন দাঁড়িয়েছে এক লাখ ১৯ হাজার ২১৪ মেট্রিক টন। বিসিক কক্সবাজার কার্যালয়ের সহকারী মহাব্যবস্থাপক মুহাম্মদ রিদওয়ানুর রশীদ বলেন, দেশে চাহিদা রয়েছে প্রায় ২৫ লাখ মেট্রিক টন। কক্সবাজারের মহেশখালী, কুতুবদিয়া, পেকুয়া, চকরিয়া, কক্সবাজার সদর, ঈদগাঁও ও টেকনাফ উপজেলা এবং বাঁশখালী উপজেলার অন্তত ৬৫ হাজার একর জমিতে লবণ উৎপাদন করা হয়ে থাকে। চাষির সংখ্যা প্রায় ৬৫ হাজার। এভাবে লবণের দরপতন হওয়ায় চরম হতাশ হয়ে গেছেন চাষিরা। চাষে উৎসাহ হারিয়ে দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন তারা। অভিযোগ রয়েছে, বিদেশ থেকে লবণ আমদানিকারী সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট কারসাজি করে লবণের দরপতন ঘটিয়েছেন।

এ ব্যাপারে কক্সবাজার লবণ চাষি ও ব্যবসায়ী সংগ্রাম পরিষদের সদস্য সচিব মিজানুর রহমান চৌধুরী খোকন মিয়া বলেন, প্রতিবছর একই সাথে সক্রিয় হয়ে উঠে লবণ শিল্পের দুশমন আমদানিকারী সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেটটি। তারা সরকারের উচ্চ পর্যায়ে ভুল বুঝিয়ে লবণ আমদানির পাঁয়তারা করেন। এবারও একই কারসাজি করেছে। তাদের নগ্ন কারসাজিতে লবণের দরপতন হয়েছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনিলামে উঠল ফেব্রিক্সসহ ৮৩ লট পণ্য
পরবর্তী নিবন্ধমানবিক চরিত্র গঠন করতে পারলে উন্নত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব