হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ১১ জানুয়ারি, ২০২৫ at ৪:৫৯ পূর্বাহ্ণ

বাড়ির কাছে আরশিনগর / সেথা পড়শি বসত করে / একঘর পড়শি বসত করে / আমি একদিনও না দেখিলাম তারে।’ আমার দশা এ গানের গ্রষ্টার চাইতে ভিন্ন নয়। হল্যান্ড থেকে সুইডেনের দূরত্ব খুব একটা বেশি নয়। তারপরও তেত্রিশ বছর লেগে গেল সমুদ্রে প্রথমযাত্রায় ডুবে যাওয়া সুইডেনের বিশালকৃতির যুদ্ধজাহাজ ‘ভাসা’ দেখতে যেতে। বিশ্বে যে ১০টি সেরা মিউজিয়াম রয়েছে তার মধ্যে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমের ‘ভাসা মিউজিয়াম’ (vasa Museet) অন্যতম। এতে রাখা আছে দৈত্যাকার বিশাল এক যুদ্ধ জাহাজ। যখন ভাগ্নি জামাই জুয়েল প্রস্তাব রাখলো এটি দেখার জন্যে, তখন মনে মনে ভেবেছিলাম এ আর এমন কী হবে। কিন্তু না। সেখানে গিয়ে মনে হলো এটি দেখতে না এলে সুইডেন দেখা অপূর্ণ থেকে যেত। রাজধানী স্টকহোমের দিউরগরদেন দ্বীপে (Djurgarden) এটি একটি ম্যারিটাইম বা সামুদ্রিক মিউজিয়াম, যেখানে সযত্নে রাখা আছে সতের শতকে নির্মিত কাঠের বিশাল এক যুদ্ধ জাহাজ, যা টাইটানিক‘-এর মত প্রথম সমুদ্রযাত্রায় ডুবে যায়। সমুদ্র সঙ্গম আর করা হয়ে উঠেনি দুর্ভাগা এই জাহাজটির। প্রমোদতরী টাইটনিকের সাথে এই যুদ্ধ জাহাজের পার্থক্য এইবিশাল প্রমোদ তরী ‘টাইটানিক’ ডুবেছিল তার সমুদ্র যাত্রার চারদিন পর। অন্যদিকে যুদ্ধ জাহাজ ‘ভাসা’ ডুবেছিল প্রথম দিন সমুদ্রের পানিতে ভাসিয়ে দেবার ঘন্টা কয়েক পর। টাইটানিক যখন ডুবেছিল তখন আশপাশে কোন লোকজন ছিলনা, সেটি ডুবেছিল মধ্য সাগরে বরফের পাহাড়ের সাথে ধাক্কা লেগে। ধাক্কা লাগার তিন ঘন্টার মধ্যে গোটা জাহাজ সমুদ্রের তলে চলে যায়। ‘ভাসা’ যখন ধীরে ধীরে গভীর পানির নিচে ডুবে যায়, তখন হাজারো জনতা এই করুন ও অবিশ্বাস্য দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেছিলেন। বন্দরের তীরে দাঁড়িয়ে তারা ‘ভাসা’কে সমুদ্রে ভাসিয়ে দেবার দৃশ্য উপভোগ করতে এসেছিলেন। ভাসার এই দুর্ঘটনায় ৩০ জন মারা যান। টাইটনিক ডুবে মারা যান ১৫১৭ জন। এই তথ্য আমেরিকার দুর্ঘটনা তদন্তকারী কমিটির। তবে বৃটিশ তদন্তকারী দলের হিসাবে, টাইটনিকদুর্ঘটনায় মারা যান ১৫০৩ জন। এদের বেশির ভাগ ছিলেন জাহাজের তৃতীয় শ্রেণীর যাত্রী। এছাড়া জাহাজের প্রায় ৭০০ নাবিক ও কর্মচারী মারা যান। টাইটনিকে ছিলেন মোট ৭১০ যাত্রী। বেচেঁ যান কেবল ১৭৪ জন। সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে বড় আকারের এক ভবনে সমুদ্রের গভীর তলদেশ থেকে উদ্ধার করা যুদ্ধ জাহাজ ‘ভাসা’ এখন ঠাঁই পেয়েছে মিউজিয়ামে।

যে ক’দিন স্টকহোম ছিলাম কণিকাজুয়েলের বাসায়, মনে হচ্ছিল যেন ভিনদেশে এসেছি, পিকনিকে। হল্যান্ডে দুপুরে ভাত খাওয়া হয়না কখনো, উইকেন্ডেও না। কিন্তু এখানে দুবেলা ভাত, সাথে বাংলাদেশি তরকারি, ইলিশ, কৈ মাছ (যদিও বা কোন এক দুর্ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মাস ছয়েক ধরে কৈ মাছ খাওয়া বন্ধ করেছি, সে গল্প কোন এক অন্য সময় বলা যাবে), চিতল পিঠা থেকে শুরু করে সীম, শুঁটকি কোনটাই বাদ নেই। বাইরে বেরিয়ে ঘরে ফিরে এসে সুমনা, কণিকা, জুয়েল তিনজনই রান্নাঘরে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মাঝে মধ্যে সেখানে পেতে রাখা ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে বসে তাদের সাথে খেঁজুরে আলাপে যোগ দেই। ভাবি এমন করে দিন কাটিয়ে দিতে পারলে মন্দ হতোনা। এখন অফুরন্ত অবসর। ঠিক করেছি দেশে কম গিয়ে ইউরোপ, ইউরোপের বাইরের দেশগুলিতে ঘুরে বেড়াবো। বাইরের এই জগৎটাকে একটু দেখি, যতটুকু সম্ভব। ক’দিনের এই জীবন। যাই হোক, ব্রেকফাস্ট সেরে বের হলাম বৈরী আবহাওয়াকে উপেক্ষা করে। মেঘলা দিন। প্রচন্ড ঠান্ডা। তবে সুইডেনের জন্যে বছরের এই সময়টায় এ নতুন কোন ব্যাপার নয়। গাড়ি পার্ক করে আমরা হেঁটে এগিয়ে যাই মিউজিয়ামের দিকে। বড়সড় একটি ভবন, আহামরি তেমন কিছু নয়। বাইরে থেকে তেমনটিই মনে হয়েছিল। ধরে নিয়েছিলাম সমুদ্রে ডুবেযাওয়া যুদ্ধ জাহাজটি উদ্ধার করে অংশবিশেষ হয়তো দাঁড় করানো হয়েছে দর্শকদের জন্যে। তেমন কোন লোকজন মিউজিয়ামের বাইরে চোখে পড়লো না। কিন্তু ভেতরে গিয়ে দেখি ঠিক তার উল্টো। বেশ দর্শক ও পর্যটকের ভিড়। টিকেট কেটে ভেতরে প্রবেশ করে টের পেলাম কেন এই যুদ্ধ জাহাজকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এই মিউজিয়াম বিশ্বের ১০টি সেরা মিউজিয়ামের তালিকায় স্থান পেয়েছে। বিশাল ব্যাপার। আট তলা ভবন উঁচু এই জাহাজ। এর নির্মাণ শৈলী, শক্ত গাঁথুনি, জাহাজের প্রতি তলায় এর গায়ে সুক্ষ কারুকাজ, আকাশছোঁয়া মাস্তুল, কামানের নল বাইরের দিকে তাক করে রাখার জন্যে ছোট খুপরি আকারের জানালা, বিশাল পাল চোখ সরানো মুশকিল। জাহাজটি যে আট তলা সমান উঁচু তা টের পেলাম মিউজিয়ামের লিফট ব্যবহার করতে গিয়ে। সমুদ্রপৃষ্ট থেকে উদ্ধারকৃত পুরো জাহাজটি রাখা হয়েছে এই ভবনের ভেতর। তাকে ঘিরে একতলা, দোতলা এমনি করে আটতলা পর্যন্ত তৈরি করা হয়েছে এই ভবন, বিশাল এক হলে। প্রতিটি তলায় চক্রাকারে দেখা যায় জাহাজের বিভিন্ন দিক। সতের শতকে এই জাহাজটা তৈরি করা হয়েছিল ওক ও পাইন গাছ দিয়ে। সমুদ্রপথে সুইডেনের আধিপত্য ছিল উল্লেখ করার মত। জানা যায় ১৬১১ থেকে ১৭২১ পর্যন্ত ইউরোপের মধ্যে সুইডেন ছিল একটি পরাশক্তি। বাল্টিক সাগর নিয়ন্ত্রণে সুইস বাহিনী প্রচন্ড শক্তিশালী সামরিক শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। পাঠকের বুঝার সুবিধার্থে এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, বাল্টিক সাগর হলো অতলান্তিক মহাসাগরের একটি বাহু, যা ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, জার্মানি, লাতভিয়া, লিথুনিয়া, পোল্যান্ড, রাশিয়া, সুইডেন এবং উত্তর ও মধ্য ইউরোপীয় সমভূমি দ্বারা ঘেরা।

ফিরে আসি যুদ্ধ জাহাজ ‘ভাসা’কে সমুদ্রে ভাসানোর মুহূর্তে। দিনটি ছিল ১৬২৮ সালের ১০ আগস্ট। বেলা মধ্যদুপুর। সে সময়কার বিশ্বের সবচাইতে বড় যুদ্ধ জাহাজ সমুদ্রবক্ষে যাত্রা করবে, নতুন দেশ জয় কিংবা দখল করতে। এই নিয়ে গোটা দেশে উত্তেজনা ও উৎসাহের শেষ নেই। খোদ সুইডেনের রাজা গুস্তাভাস এডলফাসের নির্দেশে এই যুদ্ধ জাহাজ তৈরী করা হয়েছে। পোল্যান্ডলিথুনিয়ার সাথে যুদ্ধে (১৬২১১৬২৯) তিনি যে সামরিক সমপ্রসারণ শুরু করেছিলেন, তারই অংশ হিসাবে রাজা এই নির্দেশ দিয়েছিলেন। রাজা গুস্তাভকে বলা হতো ‘দি লায়ন অব দি নর্থ’ অর্থাৎ ‘উত্তরের সিংহ’। তিনি চেয়েছিলেন সুইডেনকে ইউরোপের অন্যতম ভয়ংকর শক্তিতে পরিণত করতে। আর এই বিশাল ও ভয়ংকর যুদ্ধ জাহাজ তৈরি করতে তিনি চুক্তি করেন ডাচ জাহাজ প্রস্তুতকারী, হেনরিক হাইবার্টসন ও তার বিজনেস পার্টনার, আরেন্ট ডি খরোতের সাথে। ঠিক হলো তারা চারটি যুদ্ধ জাহাজ তৈরি করবেন। তার মধ্যে একটি ‘ভাসা’, যা বিশ্বের না হলেও বাল্টিক অঞ্চলের সব চাইতে শক্তিশালী যুদ্ধজাহাজ হতে হবে। জাহাজে ভরা হলো তাবৎ সমরাস্ত্র, কামান, গোলাবারুদ ইত্যাদি। সৈন্যসামন্ত, নাবিক, জাহাজের ক্যাপ্টেন সবাই প্রস্তুত। তাদের পরিবারের সদস্যরা তাদের বিদায় দিতে তীরে অপেক্ষা করছেন। কেউ কেউ ছোট ছোট ডিঙি নৌকা নিয়ে জাহাজের কাছাকাছি গিয়ে বিদায় জানাচ্ছেন। একটা সময় সামরিক সংগীত বেজে উঠে। কিন্তু কথায় আছে ‘ম্যান প্রোপোজেস, গড ডিস্পোজেস’। সৃষ্টিকর্তা যে লিখে রেখেছিলেন ভিন্ন কিছু। কিছুদূর যেতেই প্রচন্ড বাতাস বইতে শুরু করে। জাহাজের পাল তা সামাল দিতে ব্যর্থ হয়। জাহাজের নিচের যে অংশে যুদ্ধ কামান বসানো ছিল, তারই ফাঁক গলে সমুদ্রের পানি হু হু করে জাহাজে প্রবেশ করতে লাগলো। বিশাল যুদ্ধ জাহাজ ভাসাতীরে দাঁড়িয়ে থাকা হাজারো দর্শকের চোখের সামনে সমুদ্রের গভীরে তলিয়ে গেলো। মারা গেলেন নাবিক ও কয়েক অতিথি সহ মোট ৩০ জন। মারা গেলেন জাহাজের ক্যাপ্টেন হ্যান্স জনসনও। অনেকে ১২০ মিটার সাঁতার কেটে তীরে এলো। ডুবন্ত জাহাজের দিকে ছুটে যাওয়া ছোট নৌকায় উঠে অনেকে প্রাণ বাঁচালেন। ‘ভাসা’র সমুদ্রবক্ষে তলিয়ে যাবার মধ্য দিয়ে সুইডিশ ইতিহাসে লেখা হলো একটি দর্শনীয় ব্যর্থতার সূচনা। তদন্ত শুরু হলো রাজার নির্দেশে। জাহাজের নাবিকরা নিজেদের নির্দোষ প্রমান করতে চাইলেন। তারা দাবি করলেন তাদের দিক থেকে কোন গাফিলতি নেই। জাহাজ প্রস্তুতকারীরা বললেন, রাজার সম্মতি নিয়েই জাহাজের ডিজাইন বানানো হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, জাহাজের পেটের অংশ ছোট ছিল এবং নকশায় ভুল ছিল। তবে যিনি নকশা করেছিলেন (হেনরিক হাইবার্টসন), বছরের মাথায় মারা যান বিধায় তিনি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার সুযোগ পাননি এবং ফলত কোন শাস্তিও ভোগ করেননি।

জাহাজ তো ডুবলো। এখন এটিকে সমুদ্র তলদেশ থেকে ডাঙায় তুলে আনা ছিল বিশাল এক যজ্ঞ, যা মিউজিয়ামে প্রদর্শিত এই উদ্ধার প্রক্রিয়ার প্রতিটি পদক্ষেপের ছবি, বর্ণনা না দেখলে ভাবা যায়না। প্রথম দফায় বেশ কয়েকটি প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। একটি কোম্পানি জাহাজ তোলার জন্যে আবেদন করলো। তারা চাইলেন জাহাজটিকে উপরে তুলে এর ব্যবহৃত ওক ও পাইন গাছের কাঠ বিক্রি করে মুনাফা করবে। শেষ পর্যন্ত তা হলো না, যদি হতো তাহলে আজকের এই মিউজিয়ামের কোন অস্তিত্ব থাকতো না, আর আমাদেরও দেখা হতোনা। জাহাজটি ডুবে যাবার দীর্ঘ ৩৩৩ বছর পর ১৯৬১ সালের ২৪ এপ্রিল অগণিত উৎসাহী ও কৌতূহলী দর্শক, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে মিডিয়ার লোকজন জড়ো কাস্তেলহোলমেন নামক স্থানে, যেখানে জাহাজটিকে তোলা হয়। সতের শতকের ডুবে যাওয়া যুদ্ধ জাহাজ স্থান করে নিলো বিশ্বের পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশনের চ্যানেলে। সমস্ত প্রচেষ্টা ছিল যাতে উদ্ধার করতে গিয়ে জাহাজটি তার মূল অবয়ব না হারায়। উদ্ধার কর্মটি ছিলেন অনেক কঠিন ও ঘটনাবহুল। ‘ভাসা’ পেল নতুন ঠিকানা। ১৯৯০ সালের ১৫ জুন অফিসিয়ালি খোলা হলো ভাসা মিউজিয়াম।

(২৫১২২০২৪)

লেখক

সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধযুব অনুপ্রেরণাদায়ী স্বামী বিবেকানন্দ ও মাস্টারদা সূর্যসেন
পরবর্তী নিবন্ধপরিবেশ-শব্দ দূষণে অট্টালিকা নির্মাণের দায়