হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ২০ এপ্রিল, ২০২৪ at ৮:০৮ পূর্বাহ্ণ

এরা কারা যাদের লোভাতুর দৃষ্টি বারবার কেড়ে নিতে চায় চাটগাঁর ফুসফুস, নির্দয়ভাবে হত্যা করতে চায় বন্দর নগরীর সৌন্দর্য্যবর্ধনকারী শতবর্ষী গাছ। যে গাছ প্রাণের নগরী চট্টগ্রামের কেবল সৌন্দর্য্যবর্ধন করেনা, প্রতিনিয়ত দেয় মানুষের বাঁচার জন্যে অতি জরুরি প্রাকৃতিক অক্সিজেন। কিছুদিন আগে এই গাছখেকোরা ধ্বংস করতে চেয়েছিল সিআরবি সংলগ্ন শিরিষতলায় বহু বছর ধরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলি। সচতেন চাটগাঁবাসীর তীব্র প্রতিবাদের মুখে অর্থলোভী, স্বার্থানেষী গোষ্ঠীর সে প্রচেষ্টা সফল হয়নি। কিন্তু দিন যেতে না যেতে তেমনি আর এক গোষ্ঠীর লোলুপ দৃষ্টি পড়ে আর একদিকে। এবার লক্ষ্যস্থল শিরীষতলার অনতিদূরে টাইগার পাস মোড় হতে যে দৃষ্টিনন্দন সড়কটি এগিয়ে গেছে সিআরবির দিকে ঠিক সেখানে। চট্টগ্রাম শহরের বুকে প্রকৃতিঘেরা দ্বিতলসড়ক আর দ্বিতীয়টি আছে বলে আমার জানা নেই। পাকিস্তান আমলে এই রাস্তা দিয়ে রানী এলিজাবেথের গাড়ি বহর এগিয়ে গিয়েছিল সার্কিট হাউজের দিকে। তখন আমি ছোট। বাবার ঘাড়ে বসে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা অনেকের সাথে সে গাড়ি বহরের এগিয়ে যাবার দৃশ্য দেখেছিলাম। সে স্মৃতি এখনো স্পষ্ট মনে পড়ে। এই এলাকার অতি কাছাকাছি এক সভ্রান্ত সরকারি পাড়ায় আমার বেড়ে উঠা। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পেরিয়ে ঢাকা যাবার আগ পর্যন্ত বছর কয়েক চট্টগ্রামে সাংবাদিকতা করা পর্যন্ত ছিলাম এই এলাকায়। এই স্থানটির প্রতি অনেকের মত আমারও রয়েছে এক ধরনের ভালোবাসা, ভালোলাগা। পাড়ার বন্ধুরা মিলে একসাথে গল্প করতে করতে আমরা হেঁটে বেড়াতাম এই এলাকায়। এমনকী বৃষ্টিপড়া দিনে মাথায় ছাতা ধরে আমি, আমার চাইতে বয়সে কিছুটা বড় অতি ভালো গোছের ছেলে, মুহিত চানাচুর খেতে খেতে এগিয়ে যেতাম। তখন ওই এলাকায় আজকের মত যানবাহনের এতো ভিড় ছিলনা। কাছাকাছি এক এবড়োথেবড়ো, অগোছাল মাঠে ফুটবল খেলতাম স্কুল বয়সে। এই সমস্ত কারণে এই জায়গাটার প্রতি আমার রয়েছে এক ধরনের ‘ইমোশনাল ও নষ্টালজিক এটাচমেন্ট’। আর সেই চমৎকার, দৃষ্টিনন্দন জায়গাটার ওপর যখন কারো লোভাতুর দৃষ্টি পড়ে তখন মনে ক্ষোভ জাগে, ঘৃণা জন্মে তাদের ওপর যারা উন্নয়নের নামে পরিবেশনিধনে, বিশেষ করে যখন বিকল্প পথ থাকা সত্তেও স্রেফ হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্যে এই ধরনের জন ও প্রকৃতিবিরোধী পদক্ষেপ নেয়ায় উদ্যোগী হন।

সপ্তাহ কয়েক আগে বিশেষ কাজে পতেঙ্গা গিয়েছিলাম। সাথে ছিলেন দৈনিক আজাদীর চীফ রিপোর্টার লেখক হাসান আকবর ও বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রাক্তন পরিচালক বন্ধু শফিকুল আলম খান। ফেরার পথে পতেঙ্গা থেকে নতুন ফ্লাইওভার হয়ে শহরের দিকে আসছিলাম। ফ্লাইওভারের কাজ সম্পূর্ণ হয়নি বিধায় যানবাহন চলাচলের জন্যে এখনো তা উন্মুক্ত করে দেয়া হয়নি। পতেঙ্গায় কাজ শেষে আকবর ভাই বললেন, ‘এখানে এসে এই ফ্লাইওভার দিয়ে না গেলেই নয়।’ তিনি তার পেশাগতপ্রভাব কাজে লাগিয়ে আমাদের বাহনটিকে চমৎকার এই ফ্লাইওভারে ওঠার ব্যবস্থা করলেন। ভিডিও করবেন এই চিন্তা মাথায় নিয়ে সামনের আসনে বসলেন। পনের মিনিটেরও কম সময়ে আমাদের বাহনটি টাইগার পাস চত্বরের ‘লুপ’ দিয়ে নেমে গেল। কত সহজেই চলে এলাম। বিরাট স্বস্তি ও ভালোলাগা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মনে মনে অসংখ্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই এই চমৎকার কাজটির জন্যে। আকবর ভাইকেও ধন্যবাদ জানাই এই ফ্লাইওভার হয়ে শহরের দিকে যাবার সুযোগ করে দেবার জন্যে। বোধকরি এর আগে আমাদের মত ফ্লাইওভার নির্মাণের সাথে সংশ্লিষ্ট নন এমন আর কেউ এর ওপর দিয়ে শহরে যাননি। আমাদের বাহন এগিয়ে চলে টাইগারপাস মোড় ছাড়িয়ে সিআরবির দিকে। আকবর ভাইকে জিজ্ঞাসা করে জানতে চাই, এই দ্বিতল সড়কের ঠিক কোন স্থানটিতে সিডিএ কর্তৃপক্ষ ‘র‌্যাম্প’ নির্মাণ এবং শতবর্ষী গাছগুলি কাটতে চাইছে। গাড়ি চালক ইব্রাহিমকে বলি গতি মন্থর করতে। ধীর গতিতে এগিয়ে যাওয়া গাড়ি থেকেই যে স্থানটিতে একটি সিঁড়ি নিচেরসড়কের সাথে মিশে গেছে তা দেখিয়ে বললেন ‘এখানে করার পরিকল্পনা রয়েছে’। যেতে যেতে চোখে পড়লো সারিবদ্ধ বিশালদেহী শতবর্ষী গাছগুলি। দেখেই প্রথম যে কথাটি মাথায় এলো, যারা অনেক স্মৃতিবিজড়িত গাছগুলি কাটার চিন্তা করছেন বা করছিলেন তাদের মনে কি একবারের জন্যেও কোন দ্বিধা জাগেনি? এই বিশালাকৃতি বৃক্ষরাজির জন্যে এতটুকু করুণা হয়নি, মায়া জন্মেনি? দেখলাম অনেক গাছের গায়ে সাদা, লাল রং দিয়ে সংখ্যা লেখা। কোনটার কী উদ্দেশ্য সে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ভালো জানবেন। এক প্রশ্নের উত্তরে আকবর ভাই বলেন, বিকল্প ব্যবস্থা যে ছিল না তা নয়, বিকপ্ল পথ ছিল।

. বন্দর নগরীর লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত সাড়ে ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ দেশের সব চাইতে বড় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নানা পয়েন্টে সিডিএর প্ল্যানে ১৫টি ‘র‌্যাম্প’ বানানোর প্রস্তাবনা রয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠে টাইগারপাস এলাকায় র‌্যাম্প তৈরির প্রশ্ন নিয়ে। দেখা গেল তাতে প্রায় ৪৬টি সিডিএর ভাষায় ‘ছোট ও মাঝারি’ আকৃতির গাছ কাটা পড়বে। তাদের দাবি এর ফলে পাহাড় ও পরিবেশের কোন ক্ষতি হবেনা। শুনে অবাক হই। যে সহজ বিষয়টি সাধারণ জনগণ বুঝেন সেটি তারা কেন বুঝে উঠতে পারেন না। এতে কি তবে কোন বিশেষ স্বার্থ বা ভাগাভাগির ব্যাপারস্যাপার রয়েছে, প্রশ্ন জনগণের। সিডিএর এই পরিবেশবিরুদ্ধ অপপ্রয়াসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠেন নগরীর সুশীল সমাজ সহ বিভিন্ন পরিবেশবান্ধব সংগঠন ও সাধারণ জনগণ। তারা বলেন, যে ভাবে আন্দোলন করে শিরিষ তলাকে রক্ষা করেছি ঠিক সেইভাবে রক্ষা করবো চাটগাঁর অহংকার এই দ্বিতল সড়কের শতবর্ষী গাছগুলিকে। র‌্যাম্প নির্মাণের জন্য গাছ কাটার উদ্যোগের বিরোধিতা করে নগরপরিকল্পনাবিদ ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা বলেন, গাছ কেটে র‌্যাম্প নির্মাণ করা হলে সড়কের সৌন্দর্য নষ্ট হবে, গাছগুলি রক্ষায় এই দ্বিতল সড়কের কোন স্থানে র‌্যাম্প নির্মাণের প্রয়োজন নেই। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, গাছ কাটা নিয়ে চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের কর্মকর্তা তার ‘উদ্ভট’ যুক্তি দেখিয়ে বলেন, ‘র‌্যাম্প কি লাগবেন না? এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের র‌্যাম্প তো নির্মাণ করতে হবে। এটা সরকারি কাজ, জরুরি কাজ। তাই অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এটি ছোটখাটো জিনিস।’ তার দৃষ্টিতে ৪৬টি গাছ সে যত ছোটই হোক না কেন, ‘ছোটোখাটো জিনিস’। যিনি পরিবেশ ও বন রক্ষা করবেন তার কাছ থেকে যদি এই ধরনের পরিবেশবিরোধী বুলি শোনা যায় তবে হতাশ হওয়া ছাড়া আর কিছু থাকেনা। এও জানি বন বিভাগের এক শ্রেণী অসাধু কর্মকর্তা কী হারে এবং কীভাবে বন উজাড় করে দেশের তথা এই ধরিত্রীর বারোটা বাজিয়ে চলেছেন। বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের প্রধান ভূসম্পত্তি কর্মকর্তা সুজন চৌধুরী ঢাকা থেকে প্রকাশিত এক দৈনিককে বলেন, ‘সিডিএ আমাদের জায়গায়টি পরিদর্শনে নিয়ে গিয়েছিল। তখন পরিবেশের কথা চিন্তা করে আমি ব্যক্তিগতভাবে র‌্যাম্পটি এখানে না নামিয়ে অন্য কোথাও করার সুযোগ রয়েছে কি না, তা বিবেচনা করার অনুরোধ করি। তখন তাঁরা জানান, এ জায়গাকে কেন্দ্র করে নকশা করেছেন। অন্য কোনো জায়গায় নামানোর সুযোগ নেই। তারপরও নকশা সংশোধন করার অনুরোধ জানিয়েছিলাম।’

. সিডিএ শোনেনি সে কথা। তারা তাদের এই উদ্যোগ থেকে সরে আসেননি। তবে কিছুদিনের মধ্যে তারা একেবারে সরে না এলেও উদ্যোগটি স্থগিত করেছেন এবং বিকল্প পন্থা বের করার জন্যে উদ্যোগী হবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন। তবে সে উদ্যোগ এতো সহসা ও সহজে হয়তো হতো না যদি পররাষ্ট্র মন্ত্রী, চাটগাঁর কৃতী সন্তান ড. হাছান মাহমুদ তড়িৎ হস্তক্ষেপ না করতেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রী ফোন করে র‌্যাম্প নির্মাণ কাজ বন্ধ রাখতে বলেছেন। ঈদের আগে দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত এক সংবাদে জানতে পারি চিফ ইঞ্জিনিয়ারকে ফোন করে ড. হাছান মাহমুদ বলেন, ‘কোন গাছ কাটা যাবে না, বিকল্প চিন্তা করুন, নতুন ডিজাইন করুন, যাতে র‌্যাম্পও হয়, গাছও বাঁচে।’ পরিবেশের ক্ষতি করে কোনো কিছু করা যাবে না বলেও জানান ড. হাছান মাহমুদ। পাশাপাশি গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীও র‌্যাম্প নির্মাণের কার্যক্রম বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানা যায়। তাদের দুজনকে অশেষ ধন্যবাদ। বিশেষ করে ক্ষমতাধর পররাষ্ট্র মন্ত্রীকে। পরিবেশ রক্ষায় তার এই সময়োচিত নির্দেশে চাটগাঁবাসী কিছুটা হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন। তবে একেবারে উৎকণ্ঠাহীন এখনো নয়। কেননা এখনো এই পরিকল্পনা থেকে সিডিএ সরে আসেননি। তারপরও কেউ কেউ বলেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ যখন একবার নির্দেশ দিয়েছেন তখন তার এই নির্দেশকে পাশ কেটে যেতে সাহস পাবেনা সিডিএ কর্তৃপক্ষ। এদিকে গাছ কাটার এই উদ্যোগ পুরোপুরি বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত পরিবেশ রক্ষায় আন্দোলনরত সংগঠনগুলি ও চাটগাঁবাসী তাদের প্রতিবাদ কর্মসূচি থেকে সরে আসবেন না বলে জানিয়েছেন। আশা করছি, যেহেতু পররাষ্ট্র মন্ত্রী এই ব্যাপারে এগিয়ে এসে নির্দেশ দিয়েছেন শতবর্ষী গাছগুলি এবারের মত রক্ষা পাবে। রক্ষা পাবে পরিবেশ। পররাষ্ট্র মন্ত্রীকে অশেষ অশেষ ধন্যবাদ।

লেখক : সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধনাদেরা বানু : একজন অদম্য,সাহসী ও লড়াকু নারী
পরবর্তী নিবন্ধরেমিট্যান্স যোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করা অতি জরুরি