‘মাগো, ওরা বলে, সবার কথা কেড়ে নেবে/ তোমার কোলে শুয়ে/ গল্প শুনতে দেবে না/ বলো মা, তাই কি হয়?/ তাইতো আমার দেরী হচ্ছে।/ তোমার জন্য কথার ঝুড়ি নিয়ে/ তবেই না বাড়ি ফিরবো।’
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি অভিমানী মাকে দেওয়া সেই কথা প্রাণের বিনিময়ে রেখেছিল বীর সন্তানেরা। একুশে ফেব্রুয়ারি তাই বাঙালি জাতির জন্য শুধু একটি ঐতিহাসিক দিন নয়, আত্মপ্রকাশের মহাবিস্ফোরণ। আজ বুধবার অমর একুশে ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।
একুশ কেবল বর্ণমালার যূথবদ্ধ একটি শব্দের গাঁথুনি নয়, গভীর অনুভূতির নাম। শহীদের রক্তে রাঙানো শিমুল–পলাশের এই ফাগুনে দ্বিগুণ আগুন জ্বেলেই বীর বাঙালি প্রতিষ্ঠা করেছিল মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার। পৃথিবীর ইতিহাসে বাঙালিই একমাত্র জাতি, যারা নিজের ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিল। একুশ আমাদের প্রাণের গভীরের এক শক্তির নাম। এক অনির্বচনীয় বেদনায় যে ভালোবাসা লালন করি বুকের গহ্বরে, একুশ তারই অনন্ত প্রকাশ। একুশের অহংকার ধারণ করেই প্রতিদিন একটু একটু বেড়ে ওঠা।
একুশ মানে এগিয়ে চলা। একুশ মানে মাথা নত না করা। একুশ আমাদের চেতনার শেকড়, একুশ আমাদের গর্ব। একুশ আমাদের অহংকার। তাই প্রতি বছর আমরা একুশ পালন করি শোকের শক্তিকে শাণিত করতে। শুধু আবেগে দিনটি পালন নয়। দিনটিতে নয় কোনো আনন্দ উৎসব। এটি মহান শহীদ দিবস। এটা যেমন শোকের দিন, তেমনি শক্তি আর সাহসের অপরাজেয় বরাভয়। বাঙালি চেতনায় অনড় শপথের দিন। শুধু একদিন নয়, প্রতিদিন যাপনে একুশকে ধারণের দিন।
‘যারা আমার অসংখ্য ভাইবোনকে হত্যা করেছে,/ যারা আমার হাজার বছরের ঐতিহ্যময় ভাষায় অভ্যস্ত/ মাতৃসম্বোধনকে কেড়ে নিতে গিয়ে/ আমার এইসব ভাইবোনদের হত্যা করেছে,/ আমি তাদের ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি।’
শোকবিহ্বলতা, বেদনা আর আত্মত্যাগের অহংকারে দেদীপ্যমান এই দিনটির প্রতিজ্ঞা কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী রচিত একুশের প্রথম কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’–তে ফুটে উঠেছে। সামরিক জান্তার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে একুশের প্রথম প্রহরে এই কবিতা ছাপিয়ে দৈনিক আজাদী এবং কোহিনূর প্রেস আজ ইতিহাসের অংশ। কবিতাটি ছাপানো হয়েছিল আজাদীর প্রতিষ্ঠাতা ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেকের তত্ত্বাবধানে কোহিনূর প্রেস থেকে। এই কাজের জন্য মূল্য দিতে হয় তাদের। গ্রেপ্তার করা হয় প্রেসের ম্যানেজারকে। ছয় বছরের সাজা হয় তার। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসার পর মুক্তি পান তিনি। তাই বাংলা ভাষা, বাংলা সংস্কৃতি, বাঙালির সাথে আছে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র দৈনিক আজাদী।
অমর কেন একুশ? এ দেশ ছিল আগে পাকিস্তানের শাসনে। পশ্চিমা শাসকরা তাদের উর্দু ভাষায় কথা বলাতে চেয়েছিল আমাদের। বাঙালির প্রাণের ভাষা বাংলার টুঁটি চেপে ধরতে চেয়েছিল তারা। প্রতিবাদে বাঙালির ভাষা–বিক্ষোভ শুরু হয় ১৯৪৭ সালের নভেম্বর–ডিসেম্বরে। তারপর চরম প্রকাশ। সেদিন ১৯৫২ সাল। একুশে ফেব্রুয়ারির সকালবেলা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভেঙে ফেলে। আন্দোলনে নেমে পড়ে রাজপথে। পুলিশ গুলি চালায় তাদের ওপর। রক্তে রঞ্জিত হয় রাজপথ। শহীদ হন অনেকেই। ক্ষুব্ধ ঢাকা। উত্তাল সারা দেশ। পরদিন আবার রাজপথে বিক্ষুব্ধ আন্দোলন। এবার ছাত্রদের পাশে নামেন সাধারণ মানুষ। শহীদদের জন্য অনুষ্ঠিত হয় গায়েবানা জানাজা। ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে এক রাতেই গড়ে ওঠে স্মৃতিস্তম্ভ ‘শহীদ মিনার’। ২৬ ফেব্রুয়ারি তা গুঁড়িয়ে দেয় সরকার। তারপরও ভাষা আন্দোলন আরও বেগবান হয়। অবশেষে ১৯৫৪ সালের ৭ মে গণপরিষদের অধিবেশনে এ দেশের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি পায় বাংলা। সেই থেকে একুশে ফেব্রুয়ারি জাতীয় শোক দিবস।
বাঙালির মাতৃভাষাকে ভালোবাসার চেতনা আজ ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে। একুশ এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এই অর্জন বাঙালির, বাংলাদেশের। ১৯৯৮ সাল। জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের কাছে আবেদন করা হয় একুশকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করার জন্য। এর প্রাথমিক উদ্যোক্তা কানাডা প্রবাসী দুই বাঙালি রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম। পরের বছর ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে সেই স্বীকৃতি মিলল। একুশে ফেব্রুয়ারিকে ঘোষণা করা হলো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। ২০০০ সাল থেকে দিবসটি জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোতে পালিত হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও অমর একুশে উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। বাণীতে তাঁরা বায়ান্নের ভাষা শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছেন। পৃথক বাণীতে তাঁরা বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় দেশবাসীকে শহীদের চেতনায় সমৃদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান।
একুশ উপলক্ষে চট্টগ্রামসহ সারা দেশে আছে কর্মসূচি। পুষ্পস্তবক অর্পণ, স্মৃতিচারণ, আলোচনা, সঙ্গীত, চিত্রাঙ্কন, প্রভাতফেরীসহ নানা আনুষ্ঠানিকতায় স্মরণ করা হবে সেই শ্রেষ্ঠ সন্তানদের।