আমদানি নিষিদ্ধ ‘মিট অ্যান্ড বোন মিল’ এবং ট্যানারি বর্জ্যের পাশাপাশি কাস্টমসের পুঁতে ফেলা পচা পণ্যও ব্যবহৃত হচ্ছে পোল্ট্রি ফিড এবং মাছের খাদ্য তৈরিতে। চট্টগ্রামে গড়ে ওঠা সংঘবদ্ধ একটি চক্র প্রতিদিন নানা ভেজাল দিয়ে কোটি কোটি টাকার পণ্য উৎপাদন এবং বাজারজাত করছে। মানুষ ও পশু–পাখির স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর এসব পোল্ট্রি ফিড এবং মাছের খাদ্যে বাজার সয়লাব হয়ে উঠেছে। জেলা প্রশাসন ও পুলিশের অভিযানের পর দিন কয়েক থেমে থাকলেও নতুন করে অপতৎপরতা শুরু হয়েছে।
সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম অঞ্চলে ত্রিশ হাজারেরও বেশি মুরগি এবং মাছের খামার রয়েছে। এসব খামারে প্রতিদিন হাজার হাজার বস্তা খাবারের প্রয়োজন হয়। খাবারের এই বিশাল বাজারের যোগান দেয়া হয় নগরীর চিহ্নিত কয়েকটি স্থানে গড়ে উঠা কারখানা থেকে। চট্টগ্রাম অঞ্চলে দুই ধরনের মুরগীর খামার রয়েছে। বাসা বাড়ির ছাদ থেকে শুরু করে ঘরের আঙ্গিনা পর্যন্ত নানা স্থানে গড়ে তোলা খামারগুলোতে হ্যাচারি থেকে একদিন বয়সী কিনে আনা বাচ্চা লালন পালন করে এক থেকে দেড় কেজি ওজন হলে বিক্রি করে দেয়া হয়। এরা মাংস উৎপাদন এবং বাজারজাত করে। আবার কিছু কিছু খামারে ডিমের জন্যও মুরগী লালন পালন করা হয়। এসব খামারে মুরগী অনেকদিন ধরে রাখতে হয়। যেভাবেই করা হোক না কেন প্রতিটি খামারেই শত শত বস্তা খাবার লাগে।একটি একদিনের বাচ্চাকে এক থেকে দেড় কেজি ওজন করতে দুই থেকে তিন কেজি খাবার খাওয়ানো হয়। প্রচুর দাম খাবারের। ৫০ কেজি ওজনের এক বস্তা খাবারের গতকালের বাজার দর ছিল প্রায় সাড়ে ৩ হাজার টাকা। অর্থাৎ প্রতি কেজি খাবারের দাম ৭০ টাকা। মুরগীর এই খাবারই খামার শিল্পের সবচেয়ে বড় খরচ বলেও একাধিক খামারি উল্লেখ করেছেন। একইভাবে চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় শত শত মৎস্য খামার রয়েছে। যেখানে প্রতিমাসে কোটি কোটি টাকার মাছের খাবার বিক্রি হয়।
চট্টগ্রামে মুরগী এবং মাছের খাবারের বিশাল বাজার বলে উল্লেখ করে সূত্র বলেছে, পোল্ট্রি এবং মাছের খামারকে টার্গেট করে সংঘবদ্ধ একটি চক্র কোটি কোটি টাকার বেসাতি করছে।
মুরগী এবং মাছের খাদ্য হিসেবে জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর পণ্য খাওয়ানো হচ্ছে মাছ এবং মুরগীর বাচ্চাকে। খাবারের চড়া মূল্যের সুযোগে নানা ধরণের ক্ষতিকর পণ্যের ব্যবহার বাড়ছে। বাড়ছে ভেজাল দিয়ে মাছ ও মুরগীর খাবার উৎপাদনের প্রবণতা। বিভিন্ন খামারে লালিত পালিত মুরগী বড় হচ্ছে আমদানি নিষিদ্ধ ‘মিট অ্যান্ড বোন মিল’ এবং ট্যানারির বর্জ্য মেশানো খাবার খেয়ে। এর সাথে যুক্ত হচ্ছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষের পুঁতে ফেলা পঁচা পণ্যও মুরগী এবং মাছের খাবার উৎপাদনের অন্যতম উপকরণ হয়ে উঠেছে। আমদানি নিষিদ্ধ এবং মানুষের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর ‘মিট অ্যান্ড বোন মিল’ এর সাথে পঁচা পণ্য মিশিয়ে তৈরি খাবারই বিভিন্ন খামারে ব্যবহার করা হচ্ছে।
সূত্র বলেছে, চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে আমদানিকৃত বিভিন্ন পণ্য নানা সময় আমদানিকারকেরা খালাস করেন না। নানা আইনি জটিলতায়ও বহু পণ্য আটকা পড়ে। মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এবং আমদানি নিষিদ্ধ বহু পণ্যও কাস্টমস আটক করে। এসব পণ্য দিনের পর দিন আটকে থাকার পর নষ্ট হয়ে যায়। কোন কোন পণ্য ভয়ানক দুর্গন্ধ ছড়ায়। কাস্টমস কর্তৃপক্ষ নানা প্রক্রিয়া শেষ করে পণ্যগুলো মাটিতে পুঁতে ফেলার ব্যবস্থা করে। কিন্তু দিনের বেলা পুঁতে ফেলা এসব পণ্য রাতের আঁধারে আবার ট্রাক বোঝাই হয়। বিভিন্ন সময় হালিশহর এলাকায় এই ধরনের একাধিক ট্রাক পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে। পঁচা পণ্যবোঝাই ট্রাকগুলো মুরগী এবং মাছের খাবার উৎপাদনকারী কারখানায় চলে যায়। সেখানে এসব পঁচা পণ্য অন্যান্য পণ্যের সাথে মিশিয়ে তৈরি করা হয় মাছের খাবার। মুরগীর খাবার। যা বস্তা ভর্তি করে প্রতি কেজি ৬৫ থেকে ৭০ টাকা দরে বিক্রি করা হয়। মাস কয়েক আগে পুলিশ ছয়টি স্কেভেটর, ১৪টি ড্রাম ট্রাক এবং একটি পে লোডারসহ বিপুল পরিমান পঁচা পণ্য জব্দ করেছিল। হালিশহর এলাকায় দিনের বেলায় পুঁতে রাখা পণ্যগুলো রাতের আঁধারে তুলতে গিয়ে উপরোক্ত ট্রাক, পে লোডার এবং স্কেভেটর ধরা পড়ে। পরবর্তীতে আরো কয়েক দফায় কাস্টমস পঁচা পণ্য পুঁতেছে। অভিযোগ রয়েছে যে, ওসব পণ্যও রাতের আঁধারে ফিড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানে পৌঁছেছে। কিন্তু আর কোন ট্রাক ধরা পড়েনি। কাস্টমসের পুঁতে ফেলা পঁচা পণ্য বাজারজাতকরণে বিশাল একটি সিন্ডিকেট সক্রিয় বলেও সূত্র জানিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলেছে যে, চাক্তাই, রাজাখালী, বাস্তুহারাসহ নগরীর বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠা কারখানাগুলোতে নানা ধরণের পণ্য মিশিয়ে ভেজাল এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর মাছ এবং মুরগীর খাদ্য উৎপাদন এবং বাজারজাত করা হয়। বিষয়টি নিয়ে বাকলিয়া থানা পুলিশের সাথে ফোনে যোগাযোগ করা হলে বলা হয় যে, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে পুলিশ অভিযান চালাবে। ইতোপূর্বেও অভিযান চালিয়ে ভেজাল খাবার আটক এবং জরিমানা করা হয়েছে। সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণ থাকলে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও পুলিশ জানায়।