কোনো ঈশ্বর কিংবা ধর্মে বিশ্বাসী নই। অলৌকিক ঘটনার বর্ণনা শুনলে তার পেছনে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা খোঁজার এক ধরনের প্রবণতা আমার মধ্যে কাজ করে। কিন্তু এই বিষয়ে নিজের অবস্থান স্পষ্টভাবে বলার ইচ্ছে বা সাহস আমার কখনো হয়নি।
২০১৯–এর শেষদিকে কোনও একদিন বিশ্বরোড থেকে বিআরটিসির দোতলা বাসে যখন চড়ে বসি আমার সাথে সঙ্গী করে নিয়েছিলাম হ্যারমান হ্যাসের সিদ্ধার্থ (Siddhartha by Hermann Hesse)। গন্তব্যে পৌঁছাতে অন্তত ঘন্টা দুয়েক লেগে যাবে যদি ঢাকা শহরের বিখ্যাত জ্যামে নাও পড়ি। একটা স্টপেজ পরে এক মাঝবয়সী লোক যখন পাশে এসে বসলেন আমি তখন সিদ্ধার্থে ডুব। খুব অস্থির সময়ে একদিন চট্টগ্রাম বাতিঘরে এই বইয়ের পকেট সাইজ পেয়ে যাই খুব কম মূল্যে। আমার মানসিক অস্থিরতা কমাতে মেডিটেশনের অনেক চেষ্টা করলেও তা পেরে উঠিনি কখনো, কিন্তু এই বই পড়ার সময় মনে হয়েছিল ধ্যান করলে হয়তো এমন অনুভূতিই হয়।
বাসে তখন আমার এক হাতে বই আর আরেক হাতে পেন্সিল ছিলো অচেনা শব্দ কিংবা পছন্দের লাইন দাগিয়ে নেওয়ার জন্য। কয়েক স্টপেজ পরে যখন বইটা বন্ধ করে লোকেশন বোঝার জন্য বাইরে তাকালাম তখন পাশেরজন জিজ্ঞেস করে বসলেন,
‘আপনি কী বৌদ্ধ?’
সিদ্ধার্থের ঘোর কাটিয়ে ওঠার আগেই এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়ায় আমার কয়েক সেকেন্ড লাগলো কী হচ্ছে তা বুঝতে। মুচকি হেসে বললাম,
* ‘না, আমার বাবা–মা মুসলিম। কিন্তু আমি কিছু না।’
অন্যসময় হলে হয়তো শুধুমাত্র ‘না’ বলেই চুপ হয়ে যেতাম, কিন্তু ওইদিন আর ইচ্ছে হলো না।
‘আপনার বাবা–মা মুসলিম কিন্তু আপনি মুসলিম না?’
* ‘না, আমি মুসলিম না।’
উনি খুব অবাক হয়ে আরও দুই–তিনবার একই প্রশ্ন করলেন এবং আমিও হেসে একই উত্তর দিলাম। বারবার প্রশ্ন করায় শেষ পর্যন্ত বুঝতে পারলাম ওনাকে বিষয়টা ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন।
* ‘আসলে আমার মা–বাবা ইসলাম ধর্ম পালন করেন। তবে আমি ইসলাম বা অন্য কোনো ধর্ম পালন করি না এবং আমি কোনও ধর্মে বিশ্বাসী নই তাই আমি মুসলিমও না, হিন্দুও না, কিছুই না। আমার কোনও ধর্ম নেই।’
কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে আবারও জিজ্ঞেস করলেন,
‘কিছু মনে করবেন না, আপনি কোনও ধর্মের না হইলে বৌদ্ধের (গৌতম বুদ্ধ) বই পড়তেসেন দেখতেসি! আপনার বইয়ের উপরে দেখলাম বৌদ্ধের মাথা।’
নির্লিপ্ত কন্ঠে বললাম,
‘আমি আসলে কয়েকটা ধর্মের বই–ই পড়েছি। এর সাথে ধর্ম পালনের তো কোনও সম্পর্ক নেই। এই বইটাও পড়ছি আমার জানার জন্য। আপনার আগ্রহ থাকলে আপনি পড়তে পারেন, এতে কোনও ক্ষতি হয় না। আর আমি যত দূর জানি গৌতম বুদ্ধ কোনও ধর্ম প্রচার করেননি, উনি একটা দর্শন প্রচার করতে চেয়েছিলেন, একজন দার্শনিকের মতো। সেই হিসেবে বৌদ্ধমত আসলে কোনও ধর্ম নয়। আপনার ধর্মের কোনও সমস্যা না হলে এবং উনার মতাদর্শ পছন্দ হলে আপনিও উনার কিছু ফিলোসফি ফলো করতে পারেন।’
‘অহ আচ্ছা। বিরক্ত করলাম আপনাকে। আসলে এইটা আমাকে কেউ কখনো বলে নাই।’
‘না, আমি বিরক্ত হইনি।’
এর কিছুক্ষণ পরেই উনি বাস থেকে নামার জন্য সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়ান এবং যাওয়ার আগে বললেন,
‘থ্যাংকু, আপনি অনেক সাহসী।’
উনার বলা শেষ বাক্যের কারণে নাকি এই প্রথম খুব কাছের বন্ধুদের বাইরে কারও কাছে নিজের বিশ্বাস এমন দ্বিধাহীনভাবে প্রকাশ করতে পারায় একটা ভার মাথা থেকে নেমে যায়। অনেকদিন পর নিজেকে খুব হালকা লাগে আর তখনই আমি সিদ্ধান্ত নিই নিজের ধর্মীয় বিশ্বাস বা অন্য যে–কোনও বিশ্বাস নিয়ে আর রাখঢাক করবো না। এরপর অনেকবারই আমাকে একই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে, ‘তুমি/আপনি কোন ধর্মের?’
যখনই বলি ‘আমার মা–বাবা মুসলিম, কিন্তু আমি কোনও ধর্মের নই।’ তখন প্রায় সবাই আগ্রহ নিয়ে আবার পালটা প্রশ্ন করেন, ‘এটা কেমন কথা! আপনার মা বাবা মুসলিম হলে আপনি মুসলিম হবেন না কেন?’
তখন আমার জন্য আলোচনা করাটা সহজ হয়ে যায়। অনেকের কাছেই খুব নতুন একটা বিষয় এটা, কারো কাছে বোধগম্য, কারো কাছে নয়। সবাই যে খুব ভালোভাবে নেয় বা বোঝে তা নয়, কেউ কেউ ক্ষেপেও যায়। তবুও আমি বলতে থাকি, লুকিয়ে রাখার চাইতে বলে ফেলাটাই আমার কাছে সহজতর মনে হয় এখন। আবার নতুন উপলব্ধিও হয় আমার যে সামাজিক–অর্থনৈতিক অবস্থান সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে এই বিষয়গুলো নিয়ে আমি সহজেই কথা বলতে পারি। অন্তত এখনও পর্যন্ত সরাসরি কারো কটূক্তি কিংবা অত্যাচার আমাকে সহ্য করতে হয়নি যা এই দেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে। আমার মতো সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা মানুষের জন্য তাই কথা বলাটা আরও বেশি প্রয়োজন সেইসব মানুষের জন্য যাদেরকে সব হারানোর ভয়ে একজন অন্য মানুষ হয়ে বাঁচতে হয়।
আমি প্রায়ই খেয়াল করে দেখেছি আমার আশেপাশের পুরুষেরা ধর্মে বিশ্বাসী হলেও বিশ্বাসী নারীদের চাইতে ধর্মীয় রীতিনীতি পালনে তাদের সংযুক্তি কম। বেশিরভাগ পুরুষের ধর্মানুভূতি জেগে উঠতে দেখেছি শুধুমাত্র নারীদের কোন কোন কাজ করার ব্যাপারে বিধি–নিষেধ আছে তা নিয়ে সরব হওয়ার ক্ষেত্রে। এই বিষয়ে ঘাটতে গিয়ে দেখি একই চিত্র পুরো পৃথিবী জুড়ে। পৃথিবীর বিভিন্ন ভৌগলিক অঞ্চলে বিভিন্ন রকমের বৈষম্য দেখা গেলেও, সকল জায়গায় একটা বৈষম্য সমানভাবে বিরাজমান আর তা হলো নারী পুরুষের বৈষম্য। আমার কাছে মনে হয়েছে সামাজিক–অর্থনৈতিক সকল দিক থেকে নারীদেরকে যে vulnerable জীবন এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ উপহার দিয়েছে সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে শেষ আশ্রয় হিসেবে হয়তো তারা ধর্মটাকেই বেছে নিচ্ছেন। সেখানে একজন নারী হয়ে আমি যখন কথাগুলো বলি তখন মানুষ হয়তো একটু বেশিই ধাক্কা খায়। কিন্তু মানুষের সাথে নিজের আসল সত্তা নিয়ে দাঁড়াতে পারার সহজ আনন্দ থেকে আর বঞ্চিত করতে চাই না নিজেকে।