‘আনন্দ’ নামের জাপানি ভ্রমণকারী

শরণার্থী, নারীবাদ এবং একজন নারী ভ্রমণকারীর গল্প

রূপা দত্ত | শনিবার , ৭ মে, ২০২২ at ৭:১৭ পূর্বাহ্ণ

ষাটোর্ধ্ব জাপানী নারী ইটসুকো কামাদা নিজের ইংরেজি নাম রাখেন ‘জয়’ নামে ‘আনন্দ’। সকালে হোস্টেলের চায়ের টেবিলে পরিচয় হয় জয়ের সাথে। সকালে ফ্রি নাস্তা দেয় যেসব হোস্টেলে, সেখানে থাকার দুইটা সুবিধাপ্রথমত নাস্তার টাকা বেঁচে যায়, যারা মাসের পর মাস ভ্রমণ করছে তাদের জন্য প্রতিটি পাইপয়সা বাঁচিয়ে চলা খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং দ্বিতীয়ত, নাস্তার টেবিলে হোস্টেলে থাকা সকল ভ্রমণকারীর সবার সাথেই সবার কম বেশি দেখা হয়ে যায়। কে কোথায় ঘুরতে যাবে, কার কি পরিকল্পনা সব মোটামুটি জানা হয়ে যায়। একজনের সাথে আরেকজনের পরিকল্পনা মিলে গেলে একসাথে ঘুরে বেড়াতে পারে। সেক্ষেত্রে একজন সঙ্গীও মেলে আবার খরচও কমে আসে।

জয় আর আমি চা নিয়ে সামনের বারান্দায় বসি। সারা পৃথিবীতে এখন যদিও বয়সভিত্তিক বৈষম্য নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। মানুষের কর্মক্ষমতাকে, তার ইচ্ছাঅনিচ্ছাকে, তার ভেতরকার আকাঙ্ক্ষাকে বয়স নিয়ে বিচার করা সঠিক নয়। বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত সমাজে বড় হয়ে এই বিষয়টি খুব বেশি অনুধাবন করতে পারিনি। সবসময় দেখে এসেছি বয়স হয়ে যাওয়া মানে হাইপ্রেশারডায়াবেটিকহার্টের রোগ; বয়স হয়ে যাওয়া মানে সাদা বা সাদার কাছাকাছি হালকা রঙের কাপড় পরা; বয়স হয়ে যাওয়া মানে নাতিনাতনিদের গল্প শোনানো, কোন কোন ক্ষেত্রে স্কুলে আনা নেয়া করা। একজন ষাটোর্ধ্ব নারী একা ভ্রমণে বের হবে, এটি কল্পনার বাইরের জগৎ।

পরিচয়ের পরের দুইতিন দিনে জয়ের সাথে অনেক গল্প হল, জয় জানালো জাপানের নারীদের সামাজিক বাস্তবতার কথা। জয়ের বয়স যখন ২২২৩ বছর তখন তিনি তার মাস্টার্স শেষ করেন, সেও কম করে ৪০ বছর আগের কথা। এত বছর পর জয়ের মনে হল, মাস্টার্সের যে থিসিস তখন করেছিল, সেটা আসলে অভিজ্ঞতার অভাবে ভাল কোন গবেষণা হয়নি। থিসিস মানে মানুষের জ্ঞান ভাণ্ডারে নতুন জ্ঞানের সংযুক্তি। সেটি যদি সন্তুষ্টিজনক না হয় তাহলে তো আফসোস নিয়ে মরতে হবে। এই ভাবনা থেকে জয় তাঁর ইউনিভার্সিটিতে যোগাযোগ করেন থিসিসটি পুনরায় করার ইচ্ছা প্রকাশ করে। জয়ের সৌভাগ্য তাঁর যে প্রফেসর ছিলেন, তিনি বেঁচে ছিলেন। জয় তাঁর সাথে যোগাযোগ করল। প্রফেসর জয়কে বোঝানোর চেষ্টা করল ওঁর থিসিস তখনকার সময়ের প্রেক্ষাপটে ভাল হয়েছে। কিন্তু, জয় নাছোড়বান্দা। ইউনিভার্সিটি থেকে অনুমতি পেলেন না, কিন্তু প্রফেসরকে রাজি করালেন তাঁর নতুন থিসিসের সুপারভাইজ করবার জন্য। জয় বা প্রফেসর ইউনিভার্সিটির সাথে যুক্ত না হয়ে, ব্যক্তিগতভাবে পুনরায় থিসিস করতেই পারেন। যেই কথা সেই কাজ, প্রায় ৪০ বছর পর জয় তাঁর থিসিসের কাজ পুনরায় শুরু করলেন। এই কাজের জন্য তাঁর নিরিবিলি পরিবেশ দরকার, তার জন্য জয় এসেছে থাইল্যান্ডে। একটা দ্বীপে বাস করছে প্রায় এক বছর ধরে। থিসিসের কাজে যখন হাঁপিয়ে উঠে, তখন ঘুরে বেড়ায় থাইল্যান্ডের বিভিন্ন শহরে।

কথা প্রসঙ্গে জয় জানায়, জাপানের নারীদের উপর তাঁর অনেক রাগ। নারীরা নিজেদের অধিকার নিয়ে খুব একটা কথা বলে না। বিশেষ করে, জয় যখন লেখাপড়া করছিল, তখন লেখাপড়া শেষে ভাল একটা বিয়ে হবে এইটাই একমাত্র লক্ষ্য ছিল। নারীরা যদিও কলকারখানায় কাজ করত, কিন্তু সেখানে মানুষ হিসেবে তাদের গণ্য করা হত না, নিম্ন শ্রেণির প্রাণি হিসেবেই গণ্য করা হত। তারা যে টাকা আয় করত, সেটার উপর তাদের তেমন একটা অধিকার ছিল না। বেতন ছিল পুরুষের কম। নারীরা কাজ করত কেবল পরিবারের অর্থনৈতিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য, এর সাথে মানুষ হিসেবে তাদের অধিকারের কোন সম্পর্ক নেই। জয়ের মতে পরিস্থিতি এখনো খুব একটা উন্নত হয়নি। কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে, কিন্তু সিদ্ধান্ত নেয়ার মত জায়গায়, পরিচালনায় তাদের খুব একটা দেখা যায় না। আর এখনো মেয়েদের চাকরিবাকরি শেষে সেই ঘরগেরস্থালির কাজ করতে হয়, বাচ্চা বড় করার দায়িত্ব পালন করতে হয়। পুরুষের অংশগ্রহণ এইসব ক্ষেত্রে খুবই সীমিত। আর সবকিছুর পর নারীদের স্বামী কর্তৃক শারীরিকমানসিক নির্যাতন তো আছেই। এখনো জাপানের সমাজের মেয়েদের বড় একটা অংশ বিয়ে করে স্বামীর উপর নির্ভর করে জীবন কাটাতেই পছন্দ করে। নারী নির্যাতনএর বিষয় এখনো নারীরা লুকিয়ে রাখে। জয় দক্ষিণ এশিয়ার নারীদের খুব পছন্দ করে তাদের সাহসিকতার জন্য। তাঁর ভাষ্যমতে এই অঞ্চলের মেয়েরা মুখবন্ধ করে সব মেনে নেয় না, তাদের প্রতিকূলতা উত্তরণের সর্বাত্মক চেষ্টা করে।

জাপান এশিয়ার সবচেয়ে উন্নত দেশ, সে দেশের একজন নারীর মুখে এইসব কথা বেশ ধাক্কা দেয়ায় মত ছিল আমার জন্য। মিয়ানমার ভ্রমণ করেছিলাম জাপানি আরেক নারী মিকার সাথে। আত্মনির্ভরশীল, সাহসী মিকা জাপানের আগল ভাঙ্গাদের দলে। নারীবাদ নিয়ে কোন ধারণা না থাকলেও, মানুষ হিসেবে জীবনকে দেখবার অদম্য ইচ্ছা মিকাকে সাহস যুগিয়েছে একা ভ্রমণে বের হতে। মিকা বলেছিল, জাপানে শুধু মেয়ে নয়, ছেলেরাও দেশের বাইরে যাওয়ার খুব একটা সাহস করে না, যেখানে জাপানি পাসপোর্ট দিয়ে পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশে ভিসার ঝামেলা ছাড়াই ভ্রমণ করা যায়।

জয় রাগ প্রকাশ করে বলছিল, জাপানিরা শুধু মেকআপ করতে পারে, ওদের কেমন দেখাচ্ছে, কে কোন ব্রান্ডের কাপড় পরেছে সেটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্যতার চেয়ে। অমানুষিক পরিশ্রম করে যে টাকা আয় করে, তার বড় অংশ খরচ করে প্রসাধনী সামগ্রী কিনতে। জয়ের কথার সাথে মিকার কথার বেশ মিলে গেছে এই প্রসঙ্গে। কোথাও যাওয়ার আগে মিকার বেশ সময় লাগত মেকআপ করবার জন্য। জাপানের বাইরে প্রথম মিয়ানমার গিয়ে মিকার নাকি বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল যে, নারীরা মেকআপ ছাড়া ঘরের বাইরে যায়। মেকআপ ছাড়া ঘরের বাইরে যাওয়ার কথা ভাবতেই পারে না বেশিরভাগ জাপানি নারীরা, সে যে বয়সেরই হোক না কেন। মিকা জানিয়েছিল, কোনদিন মেকআপ করার সময় না থাকলে মাস্ক দিয়ে মুখ ঢেকে ঘর থেকে বের হয়।

জয় বিয়ে করেছিল দেশের বাইরে থাকে এমন একজনকে। তাঁর সময়ে একা দেশের বাইরে মেয়েরা গেলে সেটা নিয়ে নানান কথা হত। তাই পরিবার থেকে মেয়েদের একা দেশের বাইরে যেতে দেয়ার প্রচলন ছিল না। কিন্তু, জয় তাঁর রক্ষণশীল সমাজ থেকে বের হবার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তাঁর দেশবিদেশ ঘুরে দেখাবার শখ। জয় বুঝে গিয়ে ছিল, কেবল বিয়ের মাধম্যেই সে এই দেশের বাইরে যেতে পারবে। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী বলে বিদেশে গিয়ে ঠেকবে না, এই বিশ্বাস ছিল। জয়ের স্বামী ইংল্যান্ডের জাপানি এম্বাসিতে ‘ভাষা ও সংস্কৃতি’ বিভাগে কাজ করত। বিয়ের পর স্বামীর সাথে জয় চলে গেল ইংল্যান্ড। তখন জাপানে সবেমাত্র নারীবাদী আন্দোলন শুরু হয়েছে। এর পেছনে আমেরিকার জাপান অধিগ্রহণের একটা বড় ভূমিকা ছিল। ১৯৭৯ সালের জাতিসংঘ নারীর উপর সকল ধরনের নির্যাতন নির্মূলের জন্য সম্মেলন করে। ১৯৮৫ জাাপান জাতিসংঘের এই কার্যক্রমের সাথে সম্মতি প্রকাশ করে এবং জাপানের নারীদের অধিকারের বিষয়ে কাজ করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। জাপানে নারীরা স্কুলে যাওয়া শুরু করে ১৮৯০ এর দিকে। তখন চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার আইন পাস হয়। ১৯১৩ সালে ৩ জন নারী প্রথমবারের মত ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়।

আজ থেকে ১০০ বছর আগে, ১৯২২ সালে জাপানের নারীরা রাজনৈতিক মিটিংয়ে উপস্থিত থাকার অধিকার পেয়েছিল, যদিও রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ ছিল। ১৯৪৫ সালে প্রাপ্তবয়স্ক নারী ভোটের অধিকার পায়। ২০২১ সালের জাতীয় নির্বাচনে ১০৫১ জন প্রার্থীর মধ্যে নারী ছিল মাত্র ১৮৬ জন। নারী রাজনীতিবিদরা যৌন হয়রানির অভিযোগ করেতারা নিজের দলীয় কর্মীর দ্বারা যেমন হয়রানির শিকার হয়, তেমনি ভোট চাইতে গেলে ভোটারদের দ্বারাও হয়রানির শিকার হয়। অনেককেই শুনতে হয়েছে পার্লামেন্টের আশা ছেড়ে ঘরে গিয়ে বাচ্চা লালনপালন করবার কথা।

বিয়ের কিছুদিন পরই প্রগতিশীল জয় এর সাথে তাঁর স্বামীর বিরোধ শুরু হয় জাপানী সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে। তাঁর স্বামী জাপানের রক্ষণশীল জীবনযাপন করতে চাইত, আর জয় চাইত রক্ষণশীলতা ভাঙতে। এক পর্যায়ে জয় বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেয়। তাঁর পরিবারের মানুষ তাকে কোন প্রকার সমর্থন করেনি। জয় এর ইচ্ছে ছিল প্যারিসে আইফেল টাওয়ারের কাছের কোন এলাকায় বাস করবার, যেখান থেকে প্রতিরাতে আইফেল টাওয়ার দেখতে পাবে; জয়ের ইচ্ছে সমুদ্র তীরে বাস করার। কিন্তু তাঁর স্বামীর এইসব কোন ইচ্ছা নেই। জয় নিজের সাথে যুদ্ধে নেমেছে। সংসার নাকি আনন্দময় স্বাধীন জীবন! কোনটা সে বেছে নেবে? তার পরিবার থেকে জানিয়ে দিয়েছে, ডিভোর্স নিলে তারা সব সম্পর্ক ছিন্ন করে দেবে। কারণ আশির দশকের জাপানি সমাজে ডিভোর্সকে খুব খারাপ চোখে দেখা হত। সমাজের মানুষ অনেক সমালোচনা করত। জয়ের ছোট বোন ছিল, তাদের বিয়ে দিতে সমস্যা হবে। সবদিক ভেবে, জয় নিজের জীবনকে অন্যের জন্য বিসর্জন দেবার প্রয়োজন দেখল না। একটাই জীবন, সেটা অন্যের ইচ্ছেয় কাটানোর কোন কারণ জয় খুঁজে পেল না। ডিভোর্স নিয়ে জয় চলে গেল প্যারিস। নিজের নাম দিল ‘জয়’। শুরু করল দোভাষীর কাজ, শুরু করল উচ্চতর শিক্ষা। তারপর ৪০ বছর ধরে ঘুরে বেড়িয়েছে সব মহাদেশ। যদিও পরবর্তীতে তাঁর পরিবার অনুরোধ করেছিল ফিরে যেতে, কিন্তু অভিমানী জয়ের স্থায়ীভাবে আর ফিরে যাওয়া হয়নি। অনেক বছর পর দেশে ফিরে গিয়েছিল তাঁর বাবার মৃত্যুর খবরে। এখন বছরে একবার যায়, আর বোনের সন্তানেরা ঘুরে যায় জয় যখন যে দেশে থাকে সে দেশে।

জয়, মিকাদের পথ ধরেই ইতিবাচকভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে জাপানি সমাজে নারীদের অবস্থান। আনন্দের জয় হোক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসত্তার মুখোমুখি দাঁড়াবার আনন্দ
পরবর্তী নিবন্ধবিত্তশালীদের উচিত সুবিধাবঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়ানো