স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সমানুপাতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়নি। ফলে বেকার জনসংখ্যার পরিমাণ ক্রমাগত বাড়তে থাকে। বিশেষ করে ক্রমবর্ধমান জনশক্তিকে শ্রমশক্তিতে রূপান্তর করার জন্য সরকার বিভিন্ন পথ অবলম্বন করতে থাকে। এ সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ব্যাপক শ্রমঘাটতি দেখা দেয়। শ্রমঘাটতির কারণে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে উন্নয়নের গতি বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থায় বাংলাদেশের উদ্বৃত্ত জনশক্তিকে রপ্তানি করার জন্য এক ব্যাপক সুযোগের সৃষ্টি হয়। ফলে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার মানুষ অধিক আয়ের জন্য মধ্যপ্রাচ্যে গমন করে। ১৯৮০ এর দশকে শুধু মধ্যপ্রাচ্যে নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জনশক্তি রপ্তানির সুযোগ আসে। বিশেষ করে যেসব দেশে দক্ষ ও অদক্ষ জনশক্তির প্রয়োজন সেসব দেশে বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি রপ্তানি শুরু হয়। কিন্তু এসব প্রবাসী নাগরিকেরা তাদের কষ্টার্জিত অর্থ দেশে প্রেরণ করার জন্য তেমন কোন সুযোগ ছিল না। এ অবস্থায় বিদেশ থেকে অর্থ প্রেরণের জন্য একশ্রেণির দালাল বা মিডিয়ার সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে বাংলাদেশের একশ্রেণির ব্যবসায়ী এ খাতে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করে। তাদের কাজ ছিল প্রবাসীদের অর্জিত অর্থ অবৈধ পথে দেশে এনে অধিক মুনাফা অর্জন করা। এ ব্যবসাকে বলা হয় হুন্ডি ব্যবসা। সরকারের যথাযথ নজরদারীর অভাবে এ হুন্ডি ব্যবসা এতই প্রসার লাভ করে যে প্রবাসী বাঙালিরা হুন্ডির মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠানো ছাড়া অন্য কোন উপায় কল্পনাও করতে পারতো না। তাছাড়া বিদেশের সব জায়গায় বাংলাদেশের কোন ব্যাংকের শাখাও ছিল না। আবার হুন্ডির মাধ্যমে টাকা দেশে পাঠালে স্বাভাবিক বিনিময় হারের তুলনায় বেশি রেইট পাওয়া যেত বলে প্রবাসী বাঙালিরা ব্যাংকের মাধ্যমে বৈধভাবে টাকা পাঠাতো না। সমগ্র বাংলার জনপদে ছড়িয়ে পড়েছিল হুন্ডি ব্যবসা। এসব হুন্ডি ব্যবসায়ীরা নিজ দায়িত্বে এমন কি বাড়ি গিয়ে গিয়ে প্রবাসীদের পরিবারে টাকা পৌঁছে দিত। ফলে বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি রপ্তানি দ্বারা সরকার, দেশ বা জাতি যে পরিমাণ উপকার পাওয়ার কথা ছিল তা পাওয়া সম্ভব হতো না। এ দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জন্য পণ্য আমদানি করতে গিয়ে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার (ডলার) প্রয়োজন হতো তা সংগ্রহ করা বা আয় করা সম্ভব ছিল না। ফলে বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যে ঘাটতি সবসময় বিরাজ করতো। বর্তমান সরকার এ সত্য উপলব্ধি করে প্রবাসীদের আয় যথাযথ পাওয়ার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে। আন্তর্জাতিক মানি ট্রান্সফার হিসেবে স্বীকৃত প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে একত্রিত হয়ে প্রবাসীদের আয় যথাযথভাবে আসার ব্যবস্থা করে। প্রবাসীদের আয় যাতে বৈধ নিয়মে পাঠানো হয় তা উৎসাহিত করার জন্য সরকার প্রণোদনা ঘোষণা করে। এর ফলে প্রবাসী বাঙালিরা একদিকে যেমন বৈধপথে তাদের কষ্টার্জিত অর্থ দেশে প্রেরণ করতে পারে তেমনি সরকারের নিকট থেকেও প্রণোদনা হিসেবে অতিরিক্ত অর্থ পেয়ে থাকে। অপরপক্ষে সরকারের কাছেও এ প্রক্রিয়া অধিকতর লাভজনক হয়। কারণ প্রবাসীরা বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠানোর ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণও ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে। বৃদ্ধিপ্রাপ্ত এ রিজার্ভ বাংলাদেশের অর্থনীতিকে করেছে দৃঢ় ও মজবুত। শুধু তাই নয়। সরকার যে পদ্মাসেতু নিজস্ব ফান্ডে করার জন্য এক বিশাল প্রকল্প হাতে নিয়েছে এবং তা বাস্তবায়ন করতে চলেছে, একমাত্র তা সম্ভব হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ এর পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে। আর এ রিজার্ভের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য রেমিট্যান্স তথা প্রবাসীদের আয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
প্রবাসীদের আয় তথা রেমিট্যান্স পাঠানোতে যাতে কোন অসুবিধা না হয় তার জন্য সরকার সকল বাণিজ্যিক ব্যাংকের কার্যক্রমকে প্রসারিত করার জন্য উৎসাহিত করে। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামগঞ্জ থেকেও হাজার হাজার দক্ষ ও অদক্ষ বাংলাদেশি নিজেদের ভাগ্য প্রসার করার জন্য গিয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। তাদের রেমিট্যান্স পাঠানোর সুবিধার্থে সকল স্থানে ব্যাংকের শাখা খোলা সম্ভব নয়। এ বাস্তব সত্যকে উপলব্ধি করে সরকার এজেন্ট ব্যাংকিং নামক এক ধরনের ব্যাংক ব্যবস্থা প্রসারের অনুমতি দেয়। এ ব্যাংক ব্যবস্থায় গ্রাম এলাকায় বসবাসরত শিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত যার আইটি কাজে দক্ষ ও মনযোগী তাদেরকে ব্যাংক এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে। ব্যাংকের পক্ষ হয়ে এসব এজেন্ট ব্যাংক হিসাব খোলা, নগদ জমা ও উত্তোলন, ফান্ড ট্রান্সফার, হিসাবের স্থিতি জানা, বিদ্যুৎ বিল গ্রহণ, রেমিট্যান্স প্রদান, অন্য ব্যাংকে টাকা পাঠানো ইত্যাদি কাজ সম্পাদন করে থাকে। যাঁরা এজেন্ট হয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগই স্থানীয় বাজারের ক্ষুদ্র ও মাঝারী ব্যবসায়ী। এছাড়া কিছু অবসরপ্রাপ্ত সরকারি ও বেসরকারি চাকরিজীবী রয়েছে। আর্থিক লেনদেন সহজ করে প্রান্তিক মানুষকে ব্যাংকিং সেবায় আনতে ২০১৪ সাল থেকে বাংলাদেশে চালু হয় এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা। এ সেবার সম্ভাবনা নিয়ে ২০১৫-১৬ ভিত্তি বছরে জিডিপি গণনায় নতুন খাত হিসেবে এজেন্ট ব্যাংকিংকে অন্তর্ভুক্ত করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুসারে ২০২১ সালে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত মোট ২৯টি ব্যাংকে এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা চালু আছে। এসব ব্যাংকের অধীনে সারা দেশে ১৮ হাজারেরও বেশি কেন্দ্রে মোট ১৩ হাজার ৪ শত ৭০ জন এজেন্ট ব্যবসা পরিচালনা করছেন। এর মধ্যে শহরাঞ্চলে ১ হাজার ৮৮৪ জন এবং উপশহর ও গ্রামীণ এলাকায় ১১ হাজার ৫৮৬ জন এজেন্ট কার্যক্রম চালাচ্ছে।
মাত্র আট বছরে এজেন্ট ব্যাংকিং দেশের অধিকাংশ হাটবাজার ও গ্রামগঞ্জে পৌঁছে গেছে। ফলে তাদের মাধ্যমে সহজেই বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় পাঠাতে পারছেন বাংলাদেশি নাগরিকেরা। এতে প্রবাসী আয়ের সুবিধাভোগীদের প্রেরিত অর্থ গ্রহণ করতে বাড়ি থেকে বেশি দূরে যেতে হচ্ছে না। বাড়ির পাশে কোন এজেন্টের কাছ থেকেই তাঁরা প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ সংগ্রহ করতে পারছেন। এ কারণে এজেন্ট ব্যাংকিং এর মাধ্যমে প্রবাসী আয় আসা দ্রুত বাড়ছে। এখন প্রতিমাসে গড়ে ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকার প্রবাসী আয় বিতরণ হচ্ছে এজেন্ট ব্যাংকিং এর মাধ্যমে। এজেন্ট ব্যাংকিং এর মাধ্যমে যে আয় আসছে, তার ৯১ শতাংশ আসছে গ্রামের এজেন্ট ও আউটলেটগুলোতে। এ সেবার মাধ্যমে গ্রামীণ জনগোষ্ঠী এখন সহজেই ব্যাংকে টাকা জমা রাখতে পারছে। আবার ঋণও পাচ্ছেন কেউ কেউ। এভাবে এজেন্ট ব্যাংকিং এর মাধ্যমে ব্যাংকিং সেবা ছড়িয়ে পড়ছে গ্রামগঞ্জে।
ব্যাংকিং সেবা বঞ্চিত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে সঞ্চয়ের অভ্যাস বৃদ্ধি, ক্ষুদ্র ও মাঝারী উদ্যোক্তা সৃষ্টি, নারী উদ্যোক্তার প্রতি অধিকতর মনোযোগ দেয়া এবং নগদ অর্থের সহজ প্রবাহ সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে এজেন্ট ব্যাংকিং। বিকল্প ব্যাংকিং সেবা ও কার্ড ভিত্তিক লেনদেন প্রসার ঘটছে বিস্তৃত গ্রামাঞ্চলে। গ্রামীণ অর্থনীতি আস্তে আস্তে চাঙ্গা হচ্ছে। অত্যন্ত সহজ পদ্ধতিতে প্রত্যন্ত অঞ্চলে এজেন্ট ব্যাংকিং ছড়িয়ে দিচ্ছে আর্থিক সেবা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে ২০২১ সালে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর এ তিন মাসে এজেন্ট ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে ৬ হাজার ৮৭১ কোটি টাকার প্রবাসী আয় এসেছে। সে অনুযায়ী প্রতিমাসে গড়ে ২ হাজার ২৯০ কোটি টাকার প্রবাসী আয় এসেছে। তবে একই সময়ে সব মাধ্যম মিলিয়ে বৈধ পথে প্রতিমাসে গড়ে ১৫ হাজার কোটি টাকার প্রবাসী আয় এসেছিল। আর এ ক্ষেত্রে দেখা যায়, প্রবাসী আয়ের ১২ শতাংশের বেশি এজেন্ট ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে এসেছে। এজেন্ট ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে এখন পর্যন্ত ৭৪ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা প্রবাসী আয় এসেছে। এর মধ্যে ৬৮ হাজার ৩৪২ কোটি টাকা এসেছে গ্রামীণ এজেন্ট ও আউটলেটগুলোর মাধ্যমে। অর্থাৎ এজেন্ট ব্যাংকিং এর মাধ্যমে আসা আয়ের ৯১ শতাংশ এসেছে গ্রামীণ এলাকায়। বাকি ৬ হাজার ৪৮৩ কোটি টাকা বা ৯ শতাংশ এসেছে শহরাঞ্চলে। আবার এজেন্ট ব্যাংকিং এর মাধ্যমে যত প্রবাসী আয় আসে, তার পুরোটাই তারা তুলে নেন না। এক হিসেবে দেখা যায়, প্রায় ২৫ শতাংশ অর্থ সংশ্লিষ্ট একাউন্টে জমা রাখে। এর ফলে এজেন্ট ব্যাংকিং সেবার আমানতও ধীরে ধীরে বেড়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য এজেন্ট ব্যাংকিং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশের ব্যাংক ব্যবস্থায় এ প্রক্রিয়া একটি মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে।
লেখক : পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ।
মাত্র আট বছরে এজেন্ট ব্যাংকিং দেশের অধিকাংশ হাটবাজার ও গ্রামগঞ্জে পৌঁছে গেছে। ফলে তাদের মাধ্যমে সহজেই বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় পাঠাতে পারছেন বাংলাদেশি নাগরিকেরা। এতে প্রবাসী আয়ের সুবিধাভোগীদের প্রেরিত অর্থ গ্রহণ করতে বাড়ি থেকে বেশি দূরে যেতে হচ্ছে না। বাড়ির পাশে কোন এজেন্টের কাছ থেকেই তাঁরা প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ সংগ্রহ করতে পারছেন। এ কারণে এজেন্ট ব্যাংকিং এর মাধ্যমে প্রবাসী আয় আসা দ্রুত বাড়ছে। এখন প্রতিমাসে গড়ে ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকার প্রবাসী আয় বিতরণ হচ্ছে এজেন্ট ব্যাংকিং এর মাধ্যমে। এজেন্ট ব্যাংকিং এর মাধ্যমে যে আয় আসছে, তার ৯১ শতাংশ আসছে গ্রামের এজেন্ট ও আউটলেটগুলোতে। এ সেবার মাধ্যমে গ্রামীণ জনগোষ্ঠী এখন সহজেই ব্যাংকে টাকা জমা রাখতে পারছে। আবার ঋণও পাচ্ছেন কেউ কেউ। এভাবে এজেন্ট ব্যাংকিং এর মাধ্যমে ব্যাংকিং সেবা ছড়িয়ে পড়ছে গ্রামগঞ্জে।