১. সাহিত্যে কবিতা এক অসাধারণ সূক্ষ্ম মাধ্যম। বাক্য বিনিময়েরও এক আদিম এবং অকৃত্রিম পন্থা। বাল্মিকীর অভিশাপ কবিতায় রূপায়িত হয়েছিল। হৃদয়ের গভীর বেদনাকে আর কোনো মাধ্যম যথার্থ করে প্রকাশ প্রায় অসম্ভব। একজন কবি যা অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করেন তা তার অভিজ্ঞতা; এই অভিজ্ঞতাই কল্পনার ডানায় ভর করে শব্দায়িত হয়ে কবিতার জন্ম হয়। প্রতিটি মানুষ যার যার অতীতকাল পুঁজি করে ভবিষৎ গড়ে। ফারাক শুধু এতটুকু যে কবি যা করেন তা তার সত্য ও সুন্দরের এক অবিমিশ্র প্রকাশ।
আমার ধারণায় কবিতা, সৃষ্টি এবং নির্মাণের এক যৌথ প্রয়াসের শিল্পিত ফসল। কবিতা শুধু সৃষ্টি বলা যাবে না যেহেতু কবিতার আঙ্গিক এবং অলংকরণের বিষয়টি একটি সুচিন্তিত অভিজ্ঞানের প্রায়োগিক পদ্ধতি। কবিতার এনাটমি নির্ণয়ে প্রত্যেক মহৎ কবিরাই থাকেন সচেতন অবিশিষ্ট বিষয় এবং শব্দপ্রাপ্তি বহুলাংশে স্বতঃস্ফূর্ত চেতনার আনন্দ-প্রকাশ। সাধারণ মানুষের মতো একজন কবিকেও আনন্দ বেদনা, সুখ দঃখের প্রতিবেশ, পরিবেশ ডিঙ্গিয়ে পথ চলতে হয়, সেই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে, মানসিক অবস্থারও পরিবর্তন হয়। এক একটি পরিবর্তিত সময়ের সৃষ্টি অন্য সময়ের সৃষ্টির সঙ্গে তুলনাযোগ্য হয় না। সহজ সরল আনন্দঘন সময়ের কাব্যানুভূতি এবং তার শব্দ, সঙ্গ অনুষঙ্গ, প্রকাশের প্রযুক্তি অনেকাংশে যেমন সহজ সরল হয়; ঠিক তেমনি জীবনের দুঃসময়ের মানসিকতা থেকে অনুসূত কাব্যরীতি ধারণ করতে পারে দুর্বোধ্য কাব্যভাষা। যদি কবি দর্শন আরোপণ কিংবা কৃত্রিম কাব্যভাষা তৈরির কোনো দুরভিসন্ধি পোষণ না করেন, তবে জটিল সময়ের ফলশ্রুতি হিসেবে লিখিত দুর্বোধ্য কবিতাটিকে কৃত্রিমতার অভিযোগ দেয়া যাবে না। মোট কথা একজন কবির কাব্যরীতির সময়গত পরিবর্তগুলো কবির স্বকীয় গুণাবলীরই মুখ্যাংশ। এই স্বতঃস্ফূর্ত পরিবর্তন একদিকে যেমন মৌলিক অন্যদিকে বৈচিত্র্যময়।
মানুষের জন্মগত অন্যান্য প্রবৃত্তির মতো কাব্যকরণও এক ধরনের প্রবৃত্তি। ইচ্ছে করলেই একজন যেমন বিজ্ঞানী হন না তেমনি একজন কবিও তার ব্যতিক্রম নন।
ব্যক্তিসত্তার ভিতর দিয়ে বিশেষভাবে পরিস্ফূটিত মানসিক অবস্থা যার যার কৃতকর্ম ও সাধনা মাধ্যমকে চিহ্নিত করে। এ এক মনোজাগতিক নৈসর্গিক অনড় অবস্থান। কবিতা বোধ বুদ্ধির এক অনিন্দ্য সুন্দর সংবন্ধন। তবে অতিবুদ্ধির মাত্রাতিক্রমণ কবিতার চরিত্রকে করে রুগ্ন।
আজ স্বৈরাচারী কাব্যকরণের যুগে, একটি বিষয়ে, আমার ধারণায়, অনেককেই সচেতন হওয়া অনিবার্য। কবিতা নির্মাণের প্রাথমিক পর্যায়ে ও দ্বিতীয় পর্যায়ের কবিতা উত্তরণের সৃজনশীলতায় কবিতা হয়ে ওঠার ভিত্তিস্তরটিকে পাঠককুল শনাক্ত করতে পারলেই আজ অনেক অকবিকে তাদের পক্ষে চিহ্নিত করা সম্ভব হবে। এই প্রক্রিয়ায় আজকের অনেক স্বৈরাচারী কবিরও উত্থান বিলোপ হবে।
মানসিকতা ও জীবনাচরণে ভেতরে ভেতরে কবি হয়ে না উঠলে কারো পক্ষে কবিতা রচনার সৃজনী প্রণয়ন অসম্ভব। কবিতার শব্দ কবিকে শনাক্ত করে। একজন শক্তিমান কবির পরিচয়ই অকপটে পাঠকের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কবিতাকে রহস্যময় করার জন্যে কোনো গোয়েন্দা প্রশিক্ষণের প্রয়োজন পড়ে না। প্রাকৃতিকভাবে অর্জিত মানসিকতার অবদমন আজকের অনেক কবিকেই আমরা রহস্য-সুন্দর শব্দ সঞ্চারকের ভূমিকায় দেখতে পাই। এখানে কৃত্রিমতার ছোঁয়া না থাকলে ঐ দুর্বোধ্য কবিতার জন্যে কবি দায়ী হবেন কেন? এ ধরনের বোধ-বৈষম্যের সমাধানে পাঠককুলকে কবির মনোজাগতিক পরিবেশে প্রবেশ করে উদঘাটন করতে হবে কবিতার সূক্ষ্মতম প্রতীক প্রকরণের রহস্য- উপাদান। কষ্টার্জিত এ প্রাপ্তি তখন পাঠকের একান্ত একার।
২. সাহিত্যের সূক্ষ্ম এবং শুদ্ধতম মাধ্যমটি হচ্ছে কবিতা। যদিও আবেগতাড়িত হয়ে জনসংখ্যার একটি অংশ, আঙ্গিকে প্রায়শ হ্রস্বাকৃতির হওয়াতে; সহজে কিছু শব্দ উগরে দিয়ে কবিতায় নিজের ব্যক্তিগত অনুভূতি প্রকাশ করেন। এই অজীর্ণ বমনে অনেকেই গ্রন্থ প্রকাশ করতে দ্বিধা করছেন না, এমন কী সেই বইয়ের প্রকাশ উৎসবে মেতে উঠার জন্যে বাংলা একাডেমির বই মেলায় ভিড় করেন। আমাদের ভাবতে হবে; কাগজের অপচয় করে এই সাধ পূরণ কতটুকু যুক্তিযুক্ত?
আমার ধারণায়, সাধারণ অর্থে কবিতা, পদ্য, ছড়া; এ প্রত্যেকটির স্বতন্ত্র লেখা-প্রক্রিয়া সম্পর্কে একজন সৃজনশীলের সাধারণ জ্ঞান না থাকলে একটি রীতিকে অন্যটির সঙ্গে পার্থক্য নির্দিষ্ট করে লেখক তার প্রার্থিত রীতিটি অনুসরণে ব্যর্থ হবেন। ফলে পদ্য, গীতি কাব্য, এমন কী ছড়ার ভাষা ব্যবহার করে নিজেকে ‘কবি’ হিসেবে দাবি করতে কুণ্ঠাবোধ করবেন না।
আমাদের বাংলা সাহিত্যের ঐতিহ্য এবং বাঙালির সংস্কৃতি-প্রবণতা প্রমাণ করে যে, আমরা পলি মানসিকতার স্নিগ্ধ-চরিত্র। অনেকেই বাংলা কবিতায় অনায়াস ছন্দ ব্যবহারে অনীহা প্রকাশ করেন। কিংবা কথায় কথায় কবিতায় অন্তর্লীন ছন্দের প্রবহমানতার কথা বলে অকবিতা রচনা করেন। কবিতার পা নির্দিষ্ট এক ধরনের চলন রীতিতে অভ্যস্ত; যার কারণে সাহিত্যের অন্যান্য দক্ষ কারিগরকে ভাঙা-গড়া, নির্মাণ-বিনির্মাণ বিষয়ে প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন জরুরি, পরবর্তীতে বোধের সঙ্গে বুদ্ধির সংমিশ্রণ ঘটিয়ে তার নিজস্বতাকে পূর্ণাঙ্গ সৃষ্টিতে রূপান্তরিত করা, অন্তত আমার দৃষ্টিতে অনিবার্য।
কবিতা শিল্পটি সব সময়েই চতুমাত্রিক বা পঞ্চ-ইন্দ্রিয়াতীত বা ষষ্ঠ ইন্দ্রীয়গ্রাহ্য। সুতরাং কবিতার ত্রি-মাত্রিকতার আপাত দৃশ্যমানতা এবং আণ্ডারস্ট্যান্ডিং এর সুবিধা থাকলেও চতুমাত্রিকতার অদৃশ্যমান শিল্পকে একজন নিবিষ্ট পাঠক গভীর অন্তর্দৃষ্টি প্রক্ষেপণ করে কাব্যরস ও রহস্যের ক্রম উন্মোচন করতে পারেন। এই সাহিত্যসুন্দর উন্মোচনা একজন সৃজনশীলকে মহাকলের বিচারের ধ্রুপদী শিল্পের স্রষ্টা হিসেবে অভিহিত করার সুযোগ-হয়তো বা থাকবে।