৩০ মে- এই তো তিনি আছেন, এভাবে আছেন, এতটা আছেন…এরপরেও কী করে বলি, আজ তাঁর চলে যাওয়ার দিন! বরং বলি, আজ শুধু এক বৃষ্টির তারিখ, চোখের কাজল ধুয়ে যাওয়ার দিন, আজ মন তিস্তা হবার দিন। ঋতুপর্ণ ঘোষ- কেউ কেউ আছেন এমন, অনায়াসে ভেতরটা পড়ে নিতে পারেন। অথচ গড়পরতা একজন সাধারণের পক্ষে খুব সহজ কাজ নয় আমার এবং আমাদের অর্থাৎ নারীদের অন্দরের ভাবনা জানা। সেই কঠিন কাজটিই তিনি কত সহজে করেছেন। অন্দরমহলের গোপন অন্ধকারটুকুতে পরম যত্নে আলো ধরেছেন। প্রথা ভেঙেছেন, ধারা গড়তে। গড়তে তো অনেকেই পারেন, সুনিপুণ হাতে ভাঙতে ওঁর মত ক’জনে পারেন! আসলে এটা অনেকটা নিজের কাছে যাওয়ার মতই অশেষ একটা প্রক্রিয়া। যারা এ-পথের পথিক তারা ভাবতে থাকেন, যদি একটুও এগোই – মনে হয় আরো অনেক অনেক দূর যেতে হবে। আসলে প্রতিটা মুহূর্তে, ভাবনার তথাকথিত নির্বিষ প্রকাশে, আচরণে পুরুষতান্ত্রিকতা ঢুকে আছে কখনো প্রকাশ্যে কখনো ছদ্মবেশে। সবার আগে সেগুলোকে চেনা জরুরি। জরুরি এই বোধ- যে, এটা একটা নিরন্তর প্রক্রিয়া। রাস্তাটা সহজ নয় মোটেই কিন্তু একবার ঠিকভাবে চিনে হাঁটতে শুরু করলে গন্তব্যের আকর্ষণ অমোঘ! ঋতুপর্ণ নামের মানুষটি সেই গন্তব্য ঠিকঠাক চিনে নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন।
তাঁর এক একটা সিনেমা দেখেছি… মনে হয়েছে এ-তো আমারই গল্প। তাঁর লেখা পড়েছি… মনে হয়েছে, আমারই মুখ থেকে শুনে লিখছেন। ভাবনার বাঁশি যখন একই সুরে বাজতে থাকে, এভাবেই দূরের কেউ আপন হয়ে যায়…ঋতুপর্ণ হয়েছিলেন। ওঁর জায়গাটা ভাবনার এতোটাই কাছের, যতটা কাছে এলে দূরে সরে যাওয়া কঠিন। এভাবেই আপন হয়ে ওঠা, এভাবেই প্রিয় হয়ে থাকা…মানুষটা থাকলেও, না থাকলেও। এসব তো গেল আমার ব্যক্তিগত অনুভব। ঋতুপর্ণ ঘোষ পৃথিবী নামের এই গ্রহকে বিদায় জানিয়েছেন ঠিক আট বছর আগে। ওঁর প্রয়াণের কয়েক বছর পরে তারই বন্ধু, কাছের মানুষ সঙ্গীতা দত্ত ‘সবার যেথায় আপন তুমি, হে প্রিয়’ হয়ে ওঠা যে এক ঋতুপর্ণ আছেন, সেই ঋতুপর্ণকে নিয়ে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন। নাম- সন্ধ্যের পাখি- বার্ড অফ ডাস্ক। ৯০ মিনিট দৈর্ঘ্যেও এই তথ্যচিত্রটি সম্পর্কে সঙ্গীতা বলেন, ‘ঋতুকে নিয়ে তথ্যচিত্র নির্মাণের সিদ্ধান্ত কেবলই বিষয়ভিত্তিক তত্ত্ব আর তথ্যের ভিত্তিতে হবে, এমনটা ভাবা কঠিন; যেখানে ওর সাথে আমার বন্ধুতার সংযোগ অনেক বেশি আবেগতাড়িত। কলেজজীবন থেকে আমরা একসাথে। এরপর ও বিজ্ঞাপন জগতে ব্যস্ত হলো। আমি পিএইচডি শেষ করে মুম্বাই হয়ে পরে লন্ডনে চলে এলাম। তবে সংযোগটা কখনোই বিচ্ছিন্ন হয়নি’।
জীবনের শেষ কুড়ি বছরে কুড়িটি চলচ্চিত্র নির্মাণ আর বারোবার জাতীয় পুরস্কার পাওয়া ঋতুপর্ণ তাঁর দর্শক-শ্রোতার ভাবনায় রাজনীতি, নারীবাদ, জেন্ডার ইস্যু, প্রেম আর আকাঙ্ক্ষাকে সমানতালে মিশিয়ে দিতে পেরেছেন। আমেরিকায় ওঁর চলচ্চিত্রের প্রথম প্রদর্শনীর পরে সঙ্গীতা ওঁকে যুক্তরাজ্যে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে যান। লন্ডনে প্রদর্শিত হয় বাড়িওয়ালি আর উৎসব, সেটার নির্মাণকাল ছিল ২০০০ সাল। এরপরে ঋতুপর্ণ আরো বেশি বিস্তৃত পরিসরে, তারকা-অভিনেতাদেরকে নিয়ে কাজ করতে অধিক মনযোগী হয়ে ওঠেন। ঐশ্বর্য রাই আর রাইমা সেনকে নিয়ে চোখের বালি, রেইনকোটে আবারো ঐশ্বর্য আর অজয় দেবগন, এরপর অভিষেক বচ্চন আর সোহা আলি খানকে নিয়ে অন্তরমহল এবং শেষে অমিতাভ বচ্চন আর অর্জুন রামপালকে নিয়ে দ্য লাস্ট লিয়ার নির্মাণ ওঁর সেই আগ্রহকে মূর্ত করে তোলে।
এরপরপরই সেই গুরুত্বপূর্ণ বাঁকটা এলো সঙ্গীতা দত্তের কর্মজীবনে। তিনি কাজ করতে শুরু করলেন ঋতুপর্ণের সহকারী পরিচালক হিসেবে। সহকর্মী হিসেবে সঙ্গীতার মনে হয়েছে, শুধু চলচ্চিত্র নির্মাণেই নয়, ঋতুপর্ণ লেখালিখিতে, অর্থাৎ গদ্য আর কবিতা নির্মাণেও সমান মেধাবী। তার শেষ ক’টি চলচ্চিত্রে জেন্ডার-ইস্যুটাও খুব স্পষ্ট আর তীব্রভাবে এসেছে। তরুণদের সাথে আলাপচারিতায় সঙ্গীতা এটা প্রায়ই শুনেছেন যে, সিনেমাশিল্পে ঋতুপর্ণ একজন আইকন শুধু নন, তার উপস্থাপনাটাই পুরোটাকে আরো বেশি মাধুর্যমন্ডিত করে। সবিস্তারে এবং খুব সূক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম ক্যামেরার কাজ এই উপস্থাপনাকে অন্য সকলের চেয়ে ঋতুকে এগিয়ে রাখে।
এই সন্ধ্যের পাখি, ইংরেজি নামে বার্ড অফ ডাস্ক’এর এক জায়গায় ঋতুপর্ণর বন্ধু এবং মেন্টর অপর্ণা সেন বলছেন, ‘নারী-পুরুষ জেন্ডার নিয়ে ওর যে প্রবল অন্তর্দ্বন্দ্ব, তা দেখে একবার ওর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, অস্ত্রোপচারের সাহায্যে তুই কি আমার মতো হতে চাস? উত্তরে ও বলেছিল, না’। কিংবদন্তী অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, ‘কী সুচারুভাবে, কী শিল্পিতভাবে চলচ্চিত্র নির্মাণের মধ্য দিয়ে ঋতুপর্ণ মধ্যবিত্ত শ্রেণির দর্শককে সিনেমা হলে আবারো টেনে এনেছেন! অবাক হতে হয়।’ শর্মিলা ঠাকুর ঋতুপর্ণর মেধায় মুগ্ধ হয়েও ‘শুভ মহরৎ’-এ তার সহশিল্পী হিসেবে রাখীকে নির্বাচন করাকে সহজমনে নিতে পারেননি। এখানে তিনি বলেছেনও তা, ‘এর নির্মাণকালে কিছু বিষয় আমি সত্যিই পছন্দ করিনি।’
সন্ধ্যের পাখিকে এক অন্যমাত্রা দিয়েছে সৌমিত্রর কণ্ঠস্বর ব্যবহার। ঋতুপর্ণর স্মৃতিকথামূলক রচনা ‘ফার্স্ট পারসন’ থেকে কিছু নির্বাচিত অংশ এখানে পাঠ করেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সঙ্গীতা এই প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘১৯৯২ তে ঋতুর প্রথম সিনেমা ‘হীরের আঙটি’ মুক্তি না পাওয়ার বেদনা থেকে শুরু করে ওর প্রাণের শহরকে নিয়ে লেখা বিভিন্ন কবিতার পাঠ সৌমিত্রর কণ্ঠে যেন প্রাণ পেয়েছে। এখানে উল্লেখযোগ্য সবচেয়ে হৃদয়ছোঁয়া পাঠ ছিল, ঋতুর মায়ের সেই পঙতিগুলো- যা তিনি খাওয়ানোর ছলে ওকে বলতেন ব’লে ঋতু লিখেছে ওর স্মৃতিকথায়।’
এ-তথ্যচিত্রে নন্দিতা দাশ, প্রসেনজিৎ, কঙ্কনা সেন, সঙ্গীতজন দেবজ্যোতি মিশ্র এরা ছাড়াও আরো অনেকের সাথে কৌশিক গাঙুলিও ভাগ করে নিয়েছেন তার অনুভব। ঋতুপর্ণ ঘোষ যেতে যেতে কৌশিক গাঙুলি, অতনু ঘোষদের মতন কিছু নির্মাতাকে তার সৃষ্টিপথের পথিক করে রেখে গেছেন। ভারতীয় পেনাল কোডের ৩৭৭ ধারার বৈষম্যকে কেন্দ্র করে নির্মিত ‘আরেকটি প্রেমের গল্প’ সিনেমার শুটিং-এর স্মৃতি কৌশিক বর্ণনা করেছেন। কৌশিকের এই সিনেমায় ঋতুপর্ণ একজন ট্রান্সজেন্ডার হিসেবে অভিনয় করেছেন। তিনি বর্ণনা করেন, চমকে দেয়া সেই মুহূর্তটিকে, যখন ঋতুপর্ণ ‘দিভা’র বেশে সাজ নিয়ে ক্যামেরার সামনে এলেন!
ঋতুপর্ণকে আরো গভীরে অনুধাবন করা যায় সন্ধ্যের পাখির সেই দৃশ্যগুলোতে যেখানে কলকাতা- যাকে ঋতু ডাকতেন ‘ প্রেমিকা ও মা’ নামে, সেই শহরের দৃশ্যায়নে। চিরাচরিত ট্রাম বা উত্তর কলকাতার পুরনো বাড়ির জানালা নয়, এখানে এসেছে রাতের নীরবতায় এ-শহর কীভাবে কথা বলে ওঠে কিংবা উঁচু অট্টলিকার পাশে কবরের সারি কিংবা মোহাররমের সেই মিছিল! অথবা কলেজের সেইসব ছেলেমেয়েরা, যারা নিজেদেরকে মুড়িয়ে নিয়েছে ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক পোস্টারের রঙে! ঋতুপর্ণ কখনো এই শহরের বাইরে নিয়ে যেতে চাননি নিজেকে। সন্ধ্যের পাখির পরিচালক সঙ্গীতা বলেন, ‘আমার যাপনের বেশিরভাগই ছিল এ-শহরের বাইরে। এই তথ্যচিত্র নির্মাণের সময়ে আমি যেন শহর কলকাতাকে পুনরায় আবিষ্কার করি, ঋতুর চোখে দেখা কলকাতা!”
লন্ডনে ভারতীয় চলচ্চিত্র উৎসব আর সাউথব্যাঙ্ক চলচ্চিত্র উৎসব ছাড়াও সে বছর কলকাতার নন্দনে প্রদর্শিত হয় ঋতুপর্ণর জীবনভিত্তিক এই ‘সন্ধ্যের পাখি’। যে নন্দন-কে নিয়ে গভীর ভালোবাসা আর গর্বভরে ঋতুপর্ণ লিখেছিলেন, ‘এই পৃথিবীতে যে ক’টি স্থানে আমি সবচেয়ে বেশি আরাম পাই, সবচেয়ে বেশি নিরাপদ বোধ করি, এদের অন্যতম হলো আমার মায়ের বাড়ি যেখানে আমি জন্মেছিলাম, বেড়ে উঠেছিলাম আর এই নন্দন।’ সেই নন্দন, যেখানে ঋতুপর্ণ বিশ্বচলচ্চিত্রকে তার সৃষ্টির প্রথম ঝলক দেখিয়েছিলেন, এবং ওঁর প্রয়াণদিনে রাষ্ট্র তোপধ্বনিতে অভিবাদন জানিয়ে তাঁকে শেষ বিদায় জানিয়েছিল। সেই দিনটি ছিল মন ব্যাকুল হয়ে তিস্তা হবার দিন।