২ মে ২০২১। বাংলা সাংস্কৃতির এক উজ্জ্বলতম দিন। সত্যজিৎ জন্মশতজয়ন্তী। কাঙ্ক্ষিত উৎসব আর আয়োজন করা গেল না কোভিডের কারণে। বাঙালি সংস্কৃতিসেবীদের বিশেষ করে চলচ্চিত্রানুরাগীদের দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা ছিল নানা সমারোহে এই উৎসব আয়োজনের। সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবর্ষ উদযাপন। নিয়তির নির্মম পরিহাসে অত্যন্ত সীমিত পরিসরে বহু আকাঙ্ক্ষিত এই উৎসব উদযাপিত হলো অনলাইনে ও পত্রপত্রিকার পাতায়। ১৯২১ সালের ২ মে কলকাতার গড়পাড় রোডের পৈতৃক বাড়িতে তাঁর জন্ম। পিতৃপুরুষের ভিটে বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জে।
এককথায় বলতে গেলে রবীন্দ্রনাথের পর বহুধা বৈচিত্র্যে যিনি বাংলা সংস্কৃতিকে আরো সমৃদ্ধ করেছেন তিনি সত্যজিৎ রায়। চলচ্চিত্র, সাহিত্য, সংগীত, অংকনশিল্প, প্রকাশনা, পত্রিকা সম্পাদনা, মুদ্রণ, সব শাখায় তাঁর মৌলিক সৃষ্টি ও প্রয়োগের মধ্য দিয়ে কেবল যে পরিপুষ্ট করেছেন তা নয়, বাঙালি জাতিকে এসবক্ষেত্রে চরম আধুনিকতার স্বাদে সমৃদ্ধ করে তুলেছেন।
বিশ্বজুড়ে এখনো যে কজন মানুষের পরিচয়ে বাঙালির বিশ্বজোড়া পরিচিতি তাঁদের অন্যতম একজন সত্যজিৎ রায়। মননে, মেধায়, ব্যক্তিত্বে, প্রয়োগে আধুনিকতায় একজন মানুষ। মননে, রুচিতে, বোধে এবং শিল্পের অনুধাবনে যিনি বাঙালিকে আধুনিকতার ঠিকানায় এনে দিয়েছিলেন, এনে দিয়েছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রে প্রকৃত রেনেসাঁর সন্ধান। বাংলা চলচ্চিত্রকে অধিষ্ঠিত করেছিলেন বিশ্ব চলচ্চিত্রের অঙ্গনে।
সারা পৃথিবীর কাছে সত্যজিৎ রায়ের পরিচিতি একজন সেরা চলচ্চিত্রকার রূপে। আমাদের এই উপমহাদেশের নানান জাতির কাছেও তাই। কিন্তু বাঙালির কাছে তাঁর পরিচয় কেবল একজন চলচ্চিত্রকার হিসেবে কখনো নয়। তিনি শুধু চলচ্চিত্র শিল্পের মাধ্যমেই নয়, নানাভাবে বঙ্গসংস্কৃতিকে সম্পদশালী করে গেছেন। তাই বাঙালির কাছে সত্যজিৎ রায় তার সংস্কৃতির অভিভাবক, রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের পরে। যেপরিবারে সত্যজিতের জন্ম ১৯২১ সালে, সেপরিবারে কয়েক প্রজন্মের অনেক সদস্য বঙ্গসংস্কৃতিকে নানাভাবে পরিপুষ্ট করেছেন। পারিবারিক পারিপার্শ্বিকতার গুণে সত্যজিৎ সেই ধারাবাহিকতা অক্ষুন্ন রেখেছেন বটে, তবে তা সম্পূর্ণ মৌলিক ও অভিনবভাবে। আর সেই মৌলিকত্ব ও অভিনবতা কেবল প্রতিভাগতভাবে অর্জিত নয়, তাঁকে অর্জন করতে হয়েছে, নিরলস পরিশ্রম ও অবিরাম চর্চার মধ্য দিয়ে।
অতি শৈশবে পিতৃহারা হয়ে রীতিমত জীবন যুদ্ধে যুঝতে হয়েছে তাঁকে। কিন্তু আকৈশোরের সংস্কৃতি চর্চা তাঁকে পৌঁছে দিয়েছে অভীষ্ঠ লক্ষ্যে। এই জীবন বীক্ষণের চিত্র আমরা দেখি তাঁর দ্বিতীয় শেষ ছবি শাখা প্রশাখায়। সেখানে মূল চরিত্রের মুখে আমরা শুনি, পরিশ্রম ও সততাই হলো জীবনের উত্তরণের প্রধান দুটি সোপান।
সত্যজিতের সময়ে বাংলা মূলধারার চলচ্চিত্রও যথেষ্ট পরিণত ও মানসম্পন্ন হয়ে উঠেছিল। একে তো তিনি সকলের মাথার উপর অভিভাবকের ছায়া দিয়ে গেছেন, তার উপর তাঁর নির্মাণ দলের বিভিন্ন শিল্পী কলাকুশলীরা মূলধারার সিনেমায়ও কাজ করতেন। এছাড়া অনেকে সরাসরি তাঁর কাছে পরামর্শ চাইলে নির্দ্বিধায় তিনি সাহায্য করে যেতেন। তেমনি সত্যজিৎ রায়ও যথেষ্ট ওয়াকিবহাল থাকতেন মূলধারার চলচ্চিত্র সম্পর্কে। এখান থেকে সবসময়ই তিনি অভিনয় শিল্পী ও কলাকুশলীদের নিয়েছেন। সানার চামচ মুখে নিয়ে না জন্মালেও সত্যজিৎ জন্মেছিলেন সোনার কাঠি হাতে নিয়ে। যার পরশে বাংলা তথা উপমহাদেশীয় চলচ্চিত্র সাবালকত্ব পেয়েছে। চলচ্চিত্রাভিনয়, চলচ্চিত্র সংগীত এবং চলচ্চিত্র সাহিত্যে তিনি যেমন এনেছেন আধুনিকতার দিশা, তেমনি নিজের মৌলিক চিন্তার সঙ্গে চলচ্চিত্রের প্রকৃত প্রকরণের মিশেলে চলচ্চিত্রের বিভিন্ন শাখাতে সমৃদ্ধি এনে দিয়েছেন।
চলচ্চিত্রের বাইরে বাংলা প্রকাশনা শিল্পে এবং অংকন শিল্পেও তিনি তাঁর পূর্ববর্তী দুই পুরুষের উত্তরাধিকারকে আরো সমৃদ্ধ করে গেছেন সন্দেশ পত্রিকাকে উত্তীর্ণ করেছেন মানের শিখরে।বাংলা সাহিত্যেও তাঁর মৌলিক অবদান- গোয়েন্দা সাহিত্য ও ছোটগল্পে। ছড়ায় ও অনুবাদেও অনবদ্য অবদান রেখে গেছেন।
উপমহাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পকে সত্যজিৎ রায় উপহার দিয়েছেন অনেক প্রতিভাবান অভিনয় শিল্পী ও কলাকুশলী। তাঁর এই আবিষ্কারের মধ্যে করুণা বন্দোপাধ্যায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, শর্মিলা ঠাকুর, অপর্ণা সেন, সন্তোষ দত্ত, রবি ঘোষ, জয়া ভাদুড়ী, দীপংকর দে, কুশল চক্রবর্তী, ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়, জয়শ্রী, অলকানন্দা রায়, প্রদীপ মুখোপাধ্যয় অন্যতম। স্যার রিচার্ড এ্যাটেনবরোর মতো ডাকসাইটে অভিনেতা ও পরিচালক সত্যজিতের ছবিতে অভিনয় করেছেন। কলাকুশলীদের মধ্যেও রয়েছেন অনেকে যাদের মধ্যে সুব্রত রায়, সৌম্যেন্দু রায়, বরুণ রাহা, অশোক বসু অন্যতম।
একজন শিল্পীর জীবনের শেষ কাজকে বলা হয় ‘সোয়ান সঙ।’ মহৎ শিল্পীদের সোয়ান সঙে তাঁদের জীবনের সামগ্রিক শিল্পকৃতির নির্যাসের প্রতিফলন ঘটে থাকে।
সত্যজিৎ রায়ের সোয়ান সঙ ছিল আগন্তুক। সত্যজিৎ নিজেও বলেছেন এই ছবির বিষয়বস্তু তাঁর সারা জীবনের দর্শন। ছবির মূল চরিত্র মনমোহন মিত্র সত্যজিৎ রায়ের প্রতিভু, যে কথা তিনি নিজেই বলেছেন। এই চরিত্রের মুখে সত্যজিৎ বলে গেছেন তাঁর সারা জীবনের সঞ্চিত অভিজ্ঞতার কথা সত্যজিৎ রায়ের অন্যতম সেরা এই সৃষ্টি তাঁর জীবন দর্শনের চলচ্চৈত্রিক দলিল হয়ে রয়েছে, যার প্রতিটি দৃশ্যের মাধ্যমে আমরা বুঝে নিতে পারি অনেকটা এই চলচ্চিত্র স্রষ্টাকে।
মহৎ শিল্পীরা সুদর দৃষ্টি সম্পন্ন হন। সত্যজিৎ রায়ও তেমনি। আজ এই উপমহাদেশ জুড়ে যে ধর্মীয় হানাহানি, ধর্ম নিয়ে কুটিল রাজনীতি, ধর্ম নিয়ে সুবিধাবাদের যে চরম অস্থিরতা তা প্রথম ইঙ্গিত তিনি দিয়েছিলেন ১৯৬২ সালে দেবী ছবিতে, জীবনের প্রায় শেষ প্রান্তে আবারও তিনি এ-বষয়ে এনেছেন ১৯৯০ সালে গণশত্রু চলচ্চিত্রে।
আজ পরিবেশ নিয়ে বিশ্বজুড়ে যে সচেতনতা-প্রচার প্রচারণা তারও উল্লেখ আমরা পাই সেই ১৯৬২ সালে কাঞ্চনজঙ্ঘা’ ছবিতে। এই ছবির গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্র জগদীস ছিলেন পরিবেশবিদ ও পক্ষীবিশারদ। ছবিতে এনিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য নেই। চরিত্রটির বিভিন্ন মুভমেন্ট ও সংলাপের মাধ্যমে সত্যজিৎ রায় পুরো বিষয়টি তুলে ধরেছিলেন।
দেশে বিদেশে সব গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন এই মহাশিল্পী। তবে সবচেয়ে বড় পুরস্কার সাধারণ মানুষের ভালোবাসা যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম পেয়ে চলেছেন এবং পেয়েও যাবেন আশাকরি। বাংলার মাটিতে প্রোথিত ছিল তাঁর শেকড়। বিদেশে ছবি বানানোর অনেক সুযোগ পেয়েও তা গ্রহণ করেননি। ১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল সত্যজিৎ রায় প্রয়াত হয়েছেন। দীর্ঘ ২৯ বছরেও তাঁর স্মৃতি এতটুকু ম্লান হয়নি। প্রাসঙ্গিকতা ও চর্চা বরং ক্রমবৃদ্ধিমান। শততমবর্ষে তাঁকে যথাযথভাবে উদযাপন করা যাচ্ছেনা এই দুঃখ মনে নিয়েও প্রত্যাশা করা যায় সত্যজিৎ রায় তাঁর দ্বিতীয় শতাব্দীতেও অম্লান হয়ে থাকবেন তাঁর সৃষ্টির বৈচিত্র্যের মধ্য দিয়ে। তাঁর ছবিগুলি চলচ্চিত্র শিক্ষণ ও বীক্ষণের ক্ষেত্রে আরো আদরণীয় হয়ে উঠবেন। জন্মশতবর্ষের এই পুণ্যলগ্নে তাঁর প্রতি আমাদের সকৃতজ্ঞ শ্রদ্ধাঞ্জলি।