শয্যা বাড়লেও হাসপাতালে রোগীর চাপ

আজাদী প্রতিবেদন | মঙ্গলবার , ২৩ মার্চ, ২০২১ at ৭:০৩ পূর্বাহ্ণ

ফের করোনা রোগীতে ভরে গেছে নগরীর সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল। বেশ কিছুদিন ধরে ভিড় বাড়লেও গত কয়েকদিন ধরে রোগীর চাপ সামাল দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে হাসপাতালগুলোকে। করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত আইসিইউসহ কেবিন/শয্যার শতভাগ রোগীতে ভরপুর। যেন ঠাঁই নেই অবস্থা। এরইমধ্যে বেশ কয়টি বেসরকারি হাসপাতালে করোনা রোগীর জন্য শয্যা বাড়ানো হয়েছে। তবে শয্যা বাড়ানোর পরও রোগীর জায়গা সংকুলান হচ্ছে না। ফেরত যেতে হচ্ছে রোগীদের।
হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুই তিন সপ্তাহ আগেও করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত কেবিন/শয্যার বেশির ভাগই খালি ছিল। কিন্তু গত ১৫/২০ দিন ধরে এ চিত্র পাল্টে হঠাৎ রোগীর চাপ বেড়ে গেছে হাসপাতালগুলোতে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে বেসরকারি পার্কভিউ, মেট্রোপলিটন, ন্যাশনাল এবং মা ও শিশু হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত শয্যার একটিও খালি নেই। এরমধ্যে শয্যা বাড়িয়েও রোগীর চাপ সামাল দিতে পারছেনা কয়েকটি হাসপাতাল।
আগের ৩০টির সাথে আরো ২৬টি বাড়িয়ে করোনা রোগীদের জন্য কেবিন সংখ্যা ৫৫টি করা হয়েছে বেসরকারি পার্কভিউ হাসপাতালে। এরপরও রোগীর চাপ সামাল দিতে পারছেনা হাসপাতালটি। ৮টি আইসিইউ নির্ধারিত রাখলেও সেখানে ১০ জন রোগীকে রাখতে হয়েছে বলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। হাসপাতালের সবকয়টি কেবিন ও আইসিইউ রোগী ভর্তি জানিয়ে হাসপাতালটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রেজাউল করিম আজাদীকে বলেন, শয্যা খালি না থাকায় প্রতিদিন বেশ কয়জন রোগীকে ফেরত দিতে হচ্ছে। রোগীর চাপ বাড়ায় আমরা কেবিন সংখ্যাও প্রায় দ্বিগুন করেছি। কিন্তু এরপরও রোগীর জায়গা দিতে পারছিনা।
একই চিত্র মেট্রোপলিটন হাসপাতালেও। এই হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য ১৮টি কেবিন নির্ধারিত। সোমবার এসব কেবিনের সবকয়টিতেই রোগী ভর্তি বলে জানান মেট্রোপলিটন হাসপাতালের জিএম মোহাম্মদ সেলিম। শয্যা খালি না থাকায় কয়েকজন রোগীকে ফিরিয়ে দিতে হয়েছে বলেও জানান তিনি। এ হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত আইসিইউ-এইচডিও’র সংখ্যা ১২টি। এর মধ্যে সোমবার ১০ জন করোনা রোগী আইসিইউ-এইচডিওতে চিকিৎসাধীন বলে জানান হাসপাতালের জিএম মোহাম্মদ সেলিম।
করোনা রোগীদের শয্যা খালি নেই বেসরকারি ন্যাশনাল হাসপাতালেও। বরং নির্ধারিত শয্যার অতিরিক্ত রোগী ভর্তি রাখতে হয়েছে এখানে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ৭টি আইসিইউসহ করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত ২৭টি শয্যার সবকয়টিতে রোগী ভর্তি ছিল সোমবার। এর মধ্যে ৭টি আইসিইউতে ৬ জন রোগী চিকিৎসাধীন বলে জানান হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. আমজাদ হোসেন। শয্যার অতিরিক্ত আরো ৭ জন রোগীকে বিশেষ ব্যবস্থায় রেখে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, করোনা রোগীদের শয্যা খালি থাকছে না। যার কারণে অনেক রোগীকে ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে।
শয্যার অতিরিক্ত রোগী ভর্তি রয়েছে আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতালেও। ১০টি আইসিইউসহ করোনা রোগীদের জন্য বর্তমানে ৯৮টি শয্যা চালু আছে এ হাসপাতালে। এর মধ্যে আইসিইউতে ১০ জনসহ সোমবার ১০৪ জন করোনা রোগী ভর্তি রয়েছেন বলে জানালেন হাসপাতালের পরিচালক (প্রশাসন) ডা. নুরুল হক।
৮টি আইসিইউসহ করোনা রোগীদের জন্য বর্তমানে ৩৬টি শয্যা রয়েছে বেসরকারি ম্যাঙ হাসপাতালে। কেবিনে ২১ জন এবং আইসিইউতে ৭ জনসহ সোমবার ২৮ জন রোগী ভর্তি বলে জানিয়েছেন ম্যাঙ হাসপাতালের জিএম রঞ্জন প্রসাদ দাশ গুপ্ত। তিনি বলেন, এখন রোগীর চাপ প্রচন্ড বেড়ে গেছে। এই খালি তো এই ভর্তি। একটি শয্যা খালি হলেও কিছু সময় পর নতুন রোগী চলে আসছে। বর্তমানে এভাবেই চলছে।
সিএসসিআর হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য ১৩টি শয্যা নির্ধারিত। এর মধ্যে সোমবার ১১ জন রোগী ভর্তি আছেন বলে জানান হাসপাতালটির আরএমও ডা. এমজাদ হোসেন। এছাড়া আইসিইউতে ২ জন রোগী চিকিৎসাধীন বলেও জানান তিনি।
বেসরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি রোগী বেড়েছে সরকারি হাসপাতালগুলোতেও। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের করোনা ইউনিটে মোট ২০০ শয্যা নির্ধারণ করা হয়। সংক্রমনের হার কমায় কয়েকমাস ধরে একশ শয্যায় করোনা রোগীদের চিকিৎসা চালু রয়েছে। তবে বর্তমানে ভর্তিকৃত রোগীর সংখ্যা একশ ছাড়িয়েছে এই হাসপাতালে। গতকাল সবমিলিয়ে ৯৬ জন রোগী ভর্তি বলে জানান চমেক হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এস এম হুমায়ুন কবীর। তবে সকালে এই সংখ্যা ১০৪ জন ছিল মর্মে সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে। এতদিন ধরে একশ শয্যায় করোনা রোগীর চিকিৎসা দেয়া হলেও এখন আরো ৬০টি শয্যায় চিকিৎসা কার্যক্রম চালু করা হয়েছে জানিয়ে চমেক হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এস এম হুমায়ুন কবীর বলেন, শয্যা বাড়িয়ে ১৬০টি করা হলেও এসব শয্যায় আমরা অন্তত ২০০ রোগীর চিকিৎসা দিতে পারবো। আমরা সেভাবেই প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছি। একই দিন আইসিইউতে ৯ জনসহ সবমিলিয়ে ৪৮ জন করোনা রোগী ভর্তি রয়েছেন চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে। জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্বে থাকা চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। ফৌজদারহাট বিআইটিআইডি হাসপাতালে সোমবার ১১ জন রোগী ভর্তি ছিলেন বলেও সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে।
হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আক্রান্তদের অনেকেই বাসায় বসে চিকিৎসা নেন। প্রথম দিকে হাসপাতালে আসছেন না। অনেকেই একদম অন্তিম মুহুর্তে হাসপাতালে আসছেন। ততক্ষনে কিন্তু ওই রোগীর ফুসফুস অধিকাংশ ক্ষতিগ্রস্ত। বাসায় থেকে ফুসফুস বেশির ভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর যারা হাসপাতালে আসছেন, বিশেষ করে তাদের রিকভার করার চান্স কম। এ ধরণের রোগীদের বাঁচানোটা খুবই কঠিন। এদিকে, অনেকে অপ্রয়োজনে হাসপাতলে ভিড় করছেন বলে মনে করেন চিকিৎসকরা। আত্মীয়-স্বজন কেউ ভর্তি থাকলে খুবই প্রয়োজন এমন সদস্য ছাড়া শিশু-বয়স্কদের হাসপাতালে না যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন ন্যাশনাল হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. আমজাদ হোসেন। হাসপাতালে ভিড় করার ফলে শিশু ও বয়স্করা করোনা আক্রান্তের ঝুঁকিতে পড়ছেন বলেও মনে করেন তিনি।
স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তা ও চিকিৎসকরা বলছেন, টিকাদান শুরুর পর করোনা নিয়ে মানুষের উদাসীনতা আরো বেড়েছে। যেন এক ধরণের অবহেলা কাজ করছে মানুষের মাঝে। যার কারণে স্বাস্থ্য বিধি মানা তো দূরের কথা, অধিকাংশের মুখে মাস্কটিও দেখা যাচ্ছে না। তাছাড়া বিয়ে-গায়ে হলুদ, উৎসবসহ সব ধরণের সামাজিক-সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান হচ্ছে হরহামেশাই। এসব অনুষ্ঠানে শারীরিক দূরত্ব বা স্বাস্থ্য বিধি মানছেনা কেউ। এতে করে সংক্রমন আবারো বাড়ছে হু হু করে।
চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. বিদ্যুৎ বড়ুয়া বলছেন, সমপ্রতি হাসপাতালে ভর্তি হওয়া অনেকেই কঙবাজারসহ বিভিন্ন পর্যটন স্থান ঘুরে এসে আক্রান্ত হয়েছেন বলে আমরা শুনেছি। অর্থাৎ বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় অনুষ্ঠানের পাশাপাশি বিনোদন ও পর্যটন স্থান থেকে সংক্রমন ছড়িয়ে পড়ছে। এ নিয়ে সতর্ক না হলে এবং মুখে মাস্ক পরার পাশাপাশি স্বাস্থ্য বিধি মেনে না চললে সংক্রমনের হার ফের আশংকাজনক পর্যায়ে পৌঁছতে পারে বলে মন্তব্য করেন এই দুই চিকিৎসক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিতে নগরীর তিন প্রবেশপথে বসবে চেকপোস্ট
পরবর্তী নিবন্ধদেশে সাত মাসে সর্বোচ্চ শনাক্ত ২৮০৯, মৃত্যু ৩০ জনের