ষাটের দশকে চট্টগ্রামের ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যেন নক্ষত্রের মেলা বসে গিয়েছিলো। সেই দশককে দু’ভাগ করে বিচার করাই সমীচীন। ১৯৬০ থেকে ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দ একভাগ এবং ১৯৬৪ থেকে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়ের ছাত্র রাজনীতিকে দ্বিতীয় ভাগে অন্তর্ভুক্ত করে আমি বিচার করতে চাই। ৬০-৬৪-এই চার বছরের মধ্যে প্রথম দেড় বছর মোটামুটি সামরিক শাসনের বৃত্তে আবদ্ধ ছিলো। উক্ত সময়ের মধ্যে চট্টগ্রামের ছাত্র রাজনীতিতে যাঁদের হাত ধরে ছাত্রলীগের নবজন্ম হয়েছিলো, তাঁরা পিতৃত্বের আসন দাবি করতেই পারেন। তাঁদের কথা একবার এখানে বলে নেয়া যাক, এম এ মান্নান, শহীদ মুরিদুল আলম, ফেরদৌস কোরেশী, আবু ছালেহ, আবদুর রউফ খালেদ-এই পঞ্চপাণ্ডবকে যদি পথিকৃতের মর্যাদা দিতে হয়, তাহলে তাঁদের পেছনে পেছনে ধুলি উড়িয়ে অশ্ব ছুটিয়ে আসেন যে সপ্ত ঘোড়সওয়ার-কফিলউদ্দিন, অধ্যক্ষ শায়েস্তা খান, বখতেয়ার কামাল, অধ্যক্ষ হারুনুর রশিদ, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, লোকমানুল মাহমুদ, আবুল কালাম আজাদ (অ্যাডভোকেট), তাঁদের কথাও ভুলে যাই কি করে ?
৬৪ থেকে অনেক নাম ভিড় করে আসে- চাকসুর প্রথম ভিপি ইব্রাহিম ও প্রথম জিএস শহীদ আবদুর রব, আশরাফ খান, নুরুন্নবী চৌধুরী, মির্জা আবু মনসুর, নুরুল আলম চৌধুরী, ইদরিস আলম, এসএম ইউসুফ, গোলাম রব্বান, কাজী আবু জাফর, সুলতান উল কবির চৌধুরী, হাজি কামাল, এমনি অনিঃশেষ কত নাম। এই নক্ষত্রমণ্ডলীর মধ্যে অবস্থান করে যে নক্ষত্রটি স্বকীয় দীপ্তিতে স্বতন্ত্র প্রভায় সমুজ্জল হয়ে বিরাজ করতো সেই নক্ষত্রের নাম নুরুল আলম চৌধুরী।
ষাট দশকের এই ছাত্র নেতাদের মধ্য থেকেই উদ্ভব হয় বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতির, পরিণামে যা স্বাধীন বাংলাদেশের আবির্ভাবকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছিলো। নুরুল আলম চৌধুরীকে আমি প্রথমত বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের রাজপথের একজন লড়াকু সৈনিক হিসেবে শনাক্ত করি। বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য তিনি এত আকুল হয়ে উঠেছিলেন যে, ’৭১-এর ছাব্বিশ মার্চ বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করার পর কোত্থেকে নুরুল আলম চৌধুরী সেই ঘোষণা প্রচারের জন্য একটি ট্যাঙি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন। কাক ডাকা ভোরে চট্টগ্রাম-কঙবাজার রোডে মাইক দিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করতে করতে তাঁকে কালুরঘাট সেতু করতে দেখেন তাঁরই এক সহকর্মী।
নুরুল আলম চৌধুরী একজন সুস্থ ধারার পরিশীলিত রাজনীতিক ছিলেন। তিনি কড়া ইস্ত্রি করা পাজামা পাঞ্জাবি পরতেন। সেটা তাঁর দেহের শুভ্রতা প্রকাশ করতো, কিন্তু তিনি যে মনেও রাজহংসের মতো শুভ্র সুন্দর ছিলেন, সেটাই মনে পড়ে বেশি।
সমসাময়িক ছাত্রনেতা, যাঁদের সঙ্গে তিনি চব্বিশ ঘণ্টা চলাফেরা, ওঠাবসা করতেন, যেমন ইদরিস আলম (তাঁরা পরস্পরকে খালাতো ভাই বলে সম্বোধন করতেন), এস এম ইউসুফ, বদি-বদন-নুর মোহাম্মদ চৌধুরী, আশরাফ খান-রাজনীতিতে সাধনা ও সিদ্ধিতে তাঁর এসব বন্ধুকে তিনি ছাড়িয়ে ছাপিয়ে অনেক উঁচুতে উঠে গিয়েছিলেন। তিনি দু’দু’বার এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাঁর কোন বন্ধু সেটা হতে পারেন নি। শুধু সুলতান ভাই একবার বাঁশখালী থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি রাষ্ট্রদূত হয়ে বিদেশে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন, তাঁর বন্ধুদের কেউ সেটা হন নি। তিনি একাই শুধু তাঁর জেলায় আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন।
এর মানে এই নয় যে, বন্ধুরা তাঁর চেয়ে ন্যুন বা হীন ছিলেন। বরং ইদরিস আলম ও এসএস ইউসুফ তাঁর চেয়ে জ্ঞানী ও বিদ্বান নেতা ছিলেন বলে তিনি প্রকাশ্যেই স্বীকার করতে কখনো কুণ্ঠাবোধ করেন নি। তিনি সব সময় উপর্যুক্ত দু’নেতাকে ইজ্জত করতেন, প্রশংসা করতেন তাদের পাণ্ডিত্যের জন্য। ইদরিস আলম যখন পূর্বকোণে “আমরা তখন যুদ্ধে” শিরোনামে মুক্তিযুদ্ধের ওপর তাঁর তুমুল আলোড়নসৃষ্টিকারী ধারাবাহিক কলাম লিখে চলেছিলেন, তখন নুরুল আলম ভাই-ই তাঁকে সব সময় উৎসাহ যোগাতেন এবং লেখা চালিয়ে যাওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করতেন। তখন মিমি সুপার মার্কেটের পেছনে কোথাও তাঁর বাসা ছিল। কোন একটি লেখা পড়ে তিনি এত বেশি খুশি হয়েছিলেন যে, ইদরিস ভাই ও আমাকে তাঁর বাসায় দাওয়াত দিয়েছিলেন। তাঁর স্ত্রী রোজি আপাকে দিয়েও দাওয়াত দিয়েছিলেন। যদিও কোন অনিবার্য কারণে সে দাওয়াত আমরা রক্ষা করতে পারি নি। তবে এছাক্যার পুলের কাছে ইদরিস ভাইয়ের নতুন বাড়িতে তিনজন কব্জি ডুবিয়ে খেয়েছি। ভাবি এত বিচিত্র পদের উপাদেয় রান্না করেছিলেন যে, তা খেয়ে ঢেকুর তুলতে কতক্ষণ বিছানায় গড়াগড়ি খেয়েছি বলতে পারবো না।
নুরুল আলম চৌধুরী মক্কা বিজয়ের আগের মুসলমান অর্থাৎ ৬৯-পূর্ব দুঃসময়ের আওয়ামী লিগার। ইদরিস আলম, আশরাফ খান, বদন দীদারি, নুর মোহাম্মদ চৌধুরী ও শাহ বদিউল আলমের সঙ্গে নুরুল আলম চৌধুরী সমগ্র চট্টগ্রাম এমনকি নোয়াখালী, কুমিল্লা পর্যন্ত গিয়ে সভা মিছিল করে ৬দফার প্রচার কার্য চালিয়েছেন। একারণে গরীব-দুঃখী, অসহায়, সাধারণ আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের বন্ধু জহুর আহমদ চৌধুরী সত্তর সালে সংসদ নির্বাচনেও নুরুল আলম চৌধুরীকে মনোনয়ন দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তখন তাঁর এখতিয়ার ছিলো না। ৭৩ সালে যখন সুযোগ পেলেন, তখন প্রথম সুযোগেই নুরুল আলম চৌধুরীকে আওয়ামী লীগের টিকিট পাইয়ে দিতে বিলম্ব করেন নি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচের ছাত্র হিসেবে উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সমাজের মাঝে ছাত্রলীগের রাজনীতি ছড়িয়ে দেয়ার জন্য সিরাজ ভাই (সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী) আর নুরুল আলম চৌধুরী প্রথম কমিটি গঠন করে সঙ্গে সঙ্গে কাজ শুরু করে দিয়েছিলেন। ফলও পেয়েছিলেন হাতে হাতে। প্রথম নির্বাচনে ছাত্রলীগ বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। বাকলিয়ার বিখ্যাত মৌলভী সাহেবের বংশের ইব্রাহিম ভাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র-ছাত্রী সংসদের (চাকসু) ভিপি বা সহ সভাপতি ও শহরের এনায়েত বাজার স্টেশন কলোনীর আবদুর রব (মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য ভারতে যাওয়ার পথে ১৩ এপ্রিল ১৯৭১ পাহাড়তলী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সামনে পাকিস্তানি বাহিনীর এম্বুশে পড়ে আবদুর রব, সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরী, অধ্যাপক দিলীপ চৌধুরী ও শেখ মোজাফফর আহমদ শাহাদাত বরণ করেন।) সাধারণ সম্পাদক বা জিএস নির্বাচিত হন। কিন্তু ২য় নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে ভাগাভাগি করে ছাত্রলীগকে চাকসু নির্বাচনে জিততে হয়েছিলো। সেই ক্যাবিনেট হীরা-মান্না পরিষদ নামে প্রসিদ্ধ। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন অনেক ছাত্রনেতা। মোবারক ভাই, রব্বান ভাই, ইদ্রিস ভাই, ফজলু ভাই, শফিউল বশর ভাই, ইউনুস ভাই-কত নাম বলবো।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সিনেট নির্বাচনে নুরুল আলম ভাইয়ের প্যানেল বিজয়ী হয়। তাঁদের প্যানেলের দপ্তর খোলা হয়েছিলো ইসলামাবাদ টাউন কোপারেটিভ ব্যাংক ভবনের দোতলায় অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ আমিন চৌধুরীর বাসায়। আমিন সাহেব ইতিহাসবিদ আবদুল হক চৌধুরীর জ্যেষ্ঠপুত্র। তাঁদের প্যানেলের প্রার্থীদের ক্রিডেনসিয়াল লেখার দায়িত্ব পড়েছিলো আমার ওপর। প্রতিদিন সন্ধ্যায় সেখানে জমজমাট আসরে হাজির থাকতেন-নুরুল আলম ভাই, ইব্রাহিম ভাই (চাকসুর প্রথম ভিপি), শহীদুল আমিন ও মঞ্জুরুল আমিন চৌধুরী ভ্রাতৃদ্বয়, হুমায়ুন ভাই (আমীর হুমায়ুন মাহমুদ চৌধুরী), মঈনু ভাই- ইফতি ভাই ভ্রাতৃদ্বয়, মোছলেম ভাই, তাজুল ভাই প্রভৃতি। সেই সময় নুরুল আলম ভাইর চরিত্রের খোলামেলা, দরবারি রূপটি প্রকটিত হয়েছিলো।
তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ছিলেন (১৯৬৬-৬৯)। তিনি উক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে ২য় শ্রেণি পেয়ে এম,এ পাস করেন। কিন্তু পাস করেও আমলার চাকরিতে যোগদানে তাঁর প্রবৃত্তি হয়নি। প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ভারতে গিয়ে ট্রেনিং গ্রহণ করেন। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিলেন। ১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ পাকিস্তান বিমান বাহিনী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের উপর বিমান আক্রমণ করলে বেতার কেন্দ্রটি নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে ফেলার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। ফলে বেতার কেন্দ্রটিকে চট্টগ্রাম থেকে রামগড় হয়ে ভারতের আগরতলায় নিয়ে যেতে তার যথেষ্ট ভূমিকা ছিল। নুরুল আলম চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধে ভারতে গিয়ে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত নির্বাচনে প্রথমবারের মত স্বতন্ত্র নির্বাচিত এলাকা হিসেবে ঘোষিত ফটিকছড়ি আসন থেকে তাঁকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া হয়। তিনি বিপুল ভোটে জয়লাভ করে দেশের কনিষ্ঠ সাংসদ হিসেবে সংসদীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। ১৯৮৬ সালেও সংসদীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে তাঁকে ফটিকছড়ি আসনে মনোনয়ন দেওয়া হলে তিনি আবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এসময় তিনি বাংলাদেশ চা বোর্ডের সদস্য নিযুক্ত হন। তিন জোটের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে নুরুল আলম চৌধুরী বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। এসময় তিনি অত্যাচার-নির্যাতনের সম্মুখীন হন।
নুরুল আলম চৌধুরী ওমানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। তিনি সেখানে তিন বছর অত্যন্ত সুনামের সাথে স্বীয় দায়িত্ব পালন করেন। তিনি রূপালী ব্যাংকে সরকারের নিযুক্ত পরিচালক হিসেবেও কিছুদিন কাজ করেন।
নুরুল আলম চৌধুরী উত্তর চট্টগ্রামের একটি বনেদী বংশে জন্মগ্রহণ করে তিনি সে বংশের গৌরব আরো বৃদ্ধি করেছেন। ১৯৪৫ সালের ২১ মে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার গোপালঘাটা গ্রামের বিখ্যাত চৌধুরী বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আলহাজ মতিউর রহমান চৌধুরী। নুরুল আলম চৌধুরী প্রথিতযশা আইনজীবী অ্যাডভোকেট বদরুল হক খানের একমাত্র কন্যা মনফুজা খাতুন রোজিকে বিয়ে করেন। তাঁদের ২ পুত্র, ১ কন্যা। নুরুল আলম চৌধুরী ২০১৯ সালের ২৭ জানুয়ারি প্রয়াত হন।