হতদরিদ্রের টাকা আত্মসাতেও মোজাম্মেল

এলএ শাখায় দালাল চক্র

আজাদী প্রতিবেদন | শনিবার , ৭ নভেম্বর, ২০২০ at ৫:০৭ পূর্বাহ্ণ

ভূমি অধিগ্রহণ বাবদ ক্ষতিপূরণ পাওয়া এক হতদরিদ্র পরিবারের সামান্য ৪ লাখ টাকাও আত্মসাতের সাথে জড়িত এলএ শাখার জালিয়াতি সিন্ডিকেটের অন্যতম দালাল মোজাম্মেল হক। ওই ঘটনায় মোজাম্মেলসহ চারজনের নামে দায়েরকৃত মামলায় পরোয়ানা জারি হলেও এলএ শাখায় তার নির্বিঘ্নে যাতায়াত ছিল। এলএ শাখার কর্মচারী পরিচয়ে বিভিন্ন জালিয়াতির সাথে জড়িত ছিলেন। জেলা প্রশাসনের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী থেকে পুলিশের ঊর্ধ্বতনের সাথেও সুস্পর্ক থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে মোজাম্মেলের বিরুদ্ধে। অন্যদিকে মামলার ঘানি টেনে হতদরিদ্র সেই লোকটির অবস্থা কাহিল।
২০১৮ সালের অক্টোবরে মধ্যম মগাদিয়া গ্রামের হতদরিদ্র নাছির উদ্দিনের দক্ষিণ মগাদিয়া মৌজায় মীরসরাই ইকোনমিক জোনের জন্য অধিগ্রহণ করা (এলএ মামলা-২৫/২০১৬/১৭) দশমিক ৭৪৫ একর জায়গার ক্ষতিপূরণ বাবদ সরকার ৪ লাখ ৭৩ হাজার ৯১৩ টাকা প্রদান করে। এ সময় নাছির উদ্দিনের ব্যাংক হিসাব থেকে ৪ লাখ টাকা তুলে আত্মসাৎ করেন কর্ণফুলী থানার বাসিন্দা হাজী আব্দুল হকের ছেলে মোজাম্মেল হক, তার ভাই মফিজুল হক প্রকাশ সুমন প্রকাশ মীর হোসেন, মীরসরাই উপজেলার রফিকুল ইসলাম ও মো. আলম। ওই ঘটনায় চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে একটি মামলা (নং-২১৯৯/২০১৮) হয়। আদালত মামলাটির তদন্তভার ডিবি পুলিশের ওপর দেয়। ডিবি পুলিশের তৎকালীন উপপরিদর্শক ইমাম হোসাইন দীর্ঘ সময় মামলাটির তদন্ত চালিয়ে গত বছর নভেম্বরে প্রতিবেদন দাখিল করেন।
ইমাম হোসাইন গতকাল আজাদীকে বলেন, মামলার বাদী নাছির একজন হতদরিদ্র। পড়ালেখা নেই। জায়গা-সম্পত্তি বিষয়ে কিছুই জানেন না। সরকার যখন তার সামান্য জায়গা অধিগ্রহণ করে, ক্ষতিপূরণের টাকা কিভাবে তুলবেন সে বিষয়ে তিনি অজ্ঞ ছিলেন। ক্ষতিপূরণের টাকা পেতে তিনি এলাকার রফিকুল ইসলামের কাছে ধর্না দেন। পরে রফিকুল নাছিরকে মোজাম্মেল হকের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। এ সময় এলএ শাখার কর্মচারী হিসেবে পরিচয় দিয়ে মোজাম্মেল হক নাছিরের ক্ষতিপূরণের টাকা পাইয়ে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে তার কাছ থেকে বিভিন্ন সাদা কাগজে দস্তখত নেন। তারা ক্ষতিপূরণের টাকার জন্য নাছিরের নামে একটি ব্যাংক হিসাব খুলে দেন। পরবর্তীতে নাছিরের ব্যাংক হিসাবে ক্ষতিপূরণের টাকা জমা হলে মোজাম্মেলসহ অন্য আসামিরা একটি চেকে নাছিরের দস্তখত নিয়ে পরে তার অজান্তে ব্যাংক থেকে ৪ লাখ টাকা তুলে নেন।
তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, টাকা আত্মসাতের ঘটনায় মূল হোতা ছিলেন মোজাম্মেল। ব্যাংকের সিসিটিভি ফুটেজে যাতে ধরা না পড়েন সেজন্য তিনি তার ভাই মফিজুলকে দিয়ে টাকাগুলো তোলেন। এক্ষেত্রে ব্যাংকের কিছু অসাধু কর্মকর্তারও যোগসাজস ছিল। তিনি জানান, লোকটি এমনই হতদরিদ্র ছিল, ক্ষতিপূরণের টাকার জন্য এলএ শাখায় যাওয়া-আসার ভাড়া পর্যন্ত তার ছিল না।
জানা গেছে, চতুর এই প্রতারক প্রশাসন ও পুলিশের ঊর্ধ্বতনদের সাথেও ভালো সম্পর্ক রেখে চলে বলে তদন্তে উঠে আসে। মামলাটির তদন্ত চলাকালীন মোজাম্মেল তদন্ত কর্মকর্তাকে হুমকি দেওয়ার পাশাপাশি পুলিশের ঊর্ধ্বতনদের দিয়েও সুপারিশ করেছিলেন।
ভুক্তভোগী নাছির উদ্দিন আজাদীকে বলেন, আমাদের জায়গা বলতে কিছু নেই। বৃষ্টি পড়লে ঘরে পানি ঢোকে। বৃষ্টি না থামা পর্যন্ত ঘুমাতে পারি না। এত অভাবের মাঝে সংসার চলে। সামান্য একটু জায়গা ছিল, সরকার ওটা নিয়ে নেয়। জায়গা বাবদ ক্ষতিপূরণের কিছু টাকা পাওয়ার আশা করেছিলাম। এজন্য এক লোকের মাধ্যমে টাকাটি পাওয়ার জন্য যোগাযোগ করি। ক্ষতিপূরণের মাত্র ৭৩ হাজার টাকা হাতে পেয়েছি। বাকি ৪ লাখ টাকা তারা মেরে দিয়েছে। তিনি বলেন, সকলের পরামর্শে তাদের বিরুদ্ধে একটা মামলা করেছি। এখন সেই মামলার খরচ পর্যন্ত আমাকে চালাতে হচ্ছে।
বাদীর আইনজীবী অ্যাডভোকেট মো. তারেকুল ইসলাম আজাদীকে বলেন, ওই মামলায় মোজাম্মেলসহ চারজনের বিরুদ্ধে লকডাউনের আগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছিল। এদের মধ্যে মফিজুল হক সুমনকে এক মাস আগে পুলিশ গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠিয়েছে। বাকিরা পলাতক রয়েছে। তিনি বলেন, মোজাম্মেলের বিরুদ্ধে আগেও একাধিক ব্যক্তির ভূমি অধিগ্রহণের টাকা জালিয়াতির মাধ্যমে আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে জানা গেছে, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের এলএ শাখার কার্যালয়ে অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পাশাপাশি পুলিশের সাথে মোজাম্মেলের সুসস্পর্ক রয়েছে। তাদের মদদে তিনি বিভিন্ন জালিয়াতির আশ্রয় নিচ্ছেন। এতে বিভিন্ন সময় অভিযোগ ওঠার পরও তিনি পার পেয়ে যাচ্ছেন।
গত বছরের ৭ নভেম্বর ষোলশহর এলাকা থেকে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের এলএ শাখার এক চেইনম্যানকে প্রায় ৮ লাখ টাকাসহ গ্রেপ্তার করা হয়। চট্টগ্রাম এলএ শাখার এই চেইনম্যান ও মোজাম্মেল ছিলেন একই সিন্ডিকেটের লোক।
গত ৪ নভেম্বর ২য় মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আবু সালেম মোহাম্মদ নোমানের আদালতে ভুয়া সাক্ষর ও কাগজপত্র সৃজনের মাধ্যমে এক ব্যক্তির ভূমি অধিগ্রহণের ৫০ লাখ টাকা উত্তোলনের চেষ্টার ঘটনায় কর্ণফুলী চরলক্ষ্যা ইউপি চেয়ারম্যান, মোজাম্মেলহকসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেন শাহীদুল ইসলাম চৌধুরী নামে এক ভুক্তভোগী। এ সময় আদালত মামলাটি পিবিআইকে (পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) তদন্তের নির্দেশ দেন।
মামলার আরজিতে ভুক্তভোগী শাহীদুল ইসলাম চৌধুরী অভিযোগ করেন, ওই মামলায় যাদের বিবাদী করা হয়েছে তাদের শাহীদুল চেনেন না। ভূমি অধিগ্রহণ শাখার কোনো অসাধু কর্মচারীর যোগসাজসে কার্যালয়টিতে দাখিলকৃত কাগজপত্র সংগ্রহ করে পরবর্তীতে দস্তখত নকল করে জাল চুক্তিপত্র সৃজন করে আসামিরা।
যেভাবে টাকা আত্মসাতের চেষ্টা : চুক্তিপত্রটি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, কর্ণফুলী চরলক্ষ্যা ইউনিয়নের মৃত হাজী আব্দুল হকের ছেলে মোজাম্মেল হক ১ম পক্ষ ও দ্বিতীয় পক্ষ মোহাম্মদ শাহীদুল ইসলাম চৌধুরীর নামে সম্পাদিত চুক্তিপত্রে উভয় পক্ষের মধ্যে দীর্ঘদিনের সুসম্পর্ক থাকার কথা বলা হয়েছে।
বর্তমানে দ্বিতীয় পক্ষের পঞ্চাশ লক্ষ টাকা প্রয়োজন হওয়ায় এলএ মামলা নং-২৫/১৬-১৭ মূলে অধিগ্রহণকৃত টাকা উত্তোলন করে পরিশোধ করার শর্তে ১ম পক্ষের কাছ থেকে ২য় পক্ষ টোকেন বায়না বাবদ ৫০ লক্ষ টাকা ধার হিসেবে নেয়। উক্ত টাকা ছয় মাসের মধ্যে পরিশোধে ব্যর্থ হলে ১ম পক্ষ চুক্তিপত্রটি এলএ অফিসে প্রদর্শন করে অধিগ্রহণকৃত জায়গার টাকা এলএ অফিস থেকে উত্তোলন করতে পারবে এবং তাতে ২য় পক্ষের কোনো আপত্তি থাকবে না বলে চুক্তিপত্রে উল্লেখ রয়েছে।
নোটারি পাবলিক করা স্ট্যাম্পের প্রতিটি পাতায় মোজাম্মেল হক ও ভূমি মালিক শাহীদুল ইসলাম চৌধুরী স্বাক্ষর রয়েছে। একইভাবে প্রতিটি পাতায় কর্ণফুলী থানার ১ নং চরলক্ষ্যা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলীর সিলসহ স্বাক্ষর দেওয়া হয়েছিল। সাক্ষীদের তালিকায় কর্ণফুলী থানার চরলক্ষ্যার বাসিন্দা জাহেদের ছেলে সাইফুল ইসলাম ও একই থানার খায়ের আহম্মেদের ছেলে মোহাম্মদ ইউসুফ নামে দুই ব্যক্তিকে সাক্ষী রাখা হয়েছে।
২০১৯ সালে ২ জানুয়ারি ১শ টাকার তিনটি স্ট্যাম্পে সম্পাদিত চুক্তিপত্রটি ওই বছর ১ সেপ্টেম্বর রেজি নং ৩৬৪৬/২০১৯ মূলে নোটারি পাবলিক করা হয়। সেই চুক্তিপত্র দেখিয়ে পরের মাসে মোজাম্মেল হক চট্টগ্রাম এলএ শাখায় ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা বরাবরে এলএ শাখার অধিগ্রহণকৃত জায়গার ক্ষতিপূরণের টাকা ভূমি মালিক শাহীদুল ইসলাম ও তার তিন ভাইকে প্রদানে বন্ধ রাখার একটি আবেদন করেন।
গত অক্টোবর মাসে চট্টগ্রাম এলএ শাখা থেকে নির্ধারিত একটি শুনানির জন্য উভয় পক্ষকে নোটিশ দেওয়া হয়। কিন্তু ওই শুনানিতে মোজাম্মেল উপস্থিত ছিলেন না।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসমস্যার তাৎক্ষণিক সমাধানে কাস্টমসে গণশুনানি
পরবর্তী নিবন্ধবাইডেনের জন্য সময়ের অপেক্ষা