২২ দপ্তরের বিরুদ্ধে ৪৭ অভিযোগ

সবচেয়ে বেশি সেবা সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে ৩০টির তাৎক্ষণিক সমাধান, তিনটির বিষয়ে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত

আজাদী প্রতিবেদন | বৃহস্পতিবার , ৪ আগস্ট, ২০২২ at ৬:৩২ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উন্মুক্ত গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে ২২ সরকারি দপ্তরের বিরুদ্ধে আনিত ৪৭ ব্যক্তির অভিযোগের মধ্য থেকে ৩০টির তাৎক্ষণিক সমাধান করা হয়েছে। তিনটি অভিযোগ বিষয়ে নেয়া হয় অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত। ১৪ জন অভিযোগকারী শুনানিতে অংশগ্রহণ করেননি। এ ১৪ জনের অভিযোগগুলো যাচাই-বাছাই করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেয়া হয়। গতকাল বুধবার চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের (চমেক) শাহ আলম বীর উত্তম অডিটোরিয়ামে দুদকের এ গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়। উন্মুক্ত এ গণশুনানিতে অংশগ্রহণ করতে দুইশ’র অধিক ব্যক্তি দুদকের বসানো অভিযোগ বক্সে অভিযোগ ফেলেন। সেখান থেকে ৪৭ ব্যক্তির অভিযোগকে প্রাধান্য দেয়া হয়। অভিযোগগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি অভিযোগ চসিক, সিডিএ, ওয়াসা, পিডিবি প্রভৃতি সেবা সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধেই।
দুদক সূত্র জানায়, ২২ দপ্তরের বিরুদ্ধে আসা ৪৭ অভিযোগের মধ্যে বাংলাদেশ রেলওয়ের (পূর্ব) বিরুদ্ধে ছিল ২টি, পাসপোর্ট অফিসের বিরুদ্ধে ৪টি, বিআরটিএর বিরুদ্ধে ২টি, সিডিএর বিরুদ্ধে ৪টি, সিটি কর্পোরেশনের বিরুদ্ধে ৭টি, ভূমি অফিসের বিরুদ্ধে ৩টি, এলএ শাখার বিরুদ্ধে ৩টি, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিরুদ্ধে ৫টি, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ২টি, চট্টগ্রাম কাস্টমসের বিরুদ্ধে ১টি, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের বিরুদ্ধে ২টি, ওয়াসার বিরুদ্ধে ২টি, বিভাগীয় হিসাব নিয়ন্ত্রক দপ্তরের বিরুদ্ধে ২টি, কেজিডিসিএল’র বিরুদ্ধে ১টি, খাদ্য নিয়ন্ত্রক অধিদপ্তরের বিরুদ্ধে ১টি, পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিরুদ্ধে ১টি, বিআরটিসির বিরুদ্ধে ১টি, বিটিসিএল’র বিরুদ্ধে ১টি, যমুনা অয়েল কোম্পানির বিরুদ্ধে ১টি, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের বিরুদ্ধে ১টি, জাতীয় গৃহায়ণ অধিদপ্তরের বিরুদ্ধে ১টি ও জেলা নির্বাচন অফিসের বিরুদ্ধে ছিল ১টি অভিযোগ। সবচেয়ে বেশি অভিযোগ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের বিরুদ্ধে। তাদের বিরুদ্ধে ৭টি অভিযোগ করেন সেবাপ্রার্থীরা। এরপর রয়েছে জেলা প্রশাসন। ভূমি অফিস ও এলএ শাখা মিলে তাদের বিরুদ্ধে মোট দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৬টি অভিযোগ করেন সেবাপ্রার্থীরা।
বাংলাদেশ রেলওয়ের বিরুদ্ধে আনিত দুটি অভিযোগ দিয়ে এই উন্মুক্ত গণশুনানি শুরু হয়। মো. ফয়েজ আহমদ মিয়া ও মো. সাহাবুদ্দিন নামের দুজন ব্যক্তি এ দুই অভিযোগ আনেন। এর মধ্যে মো. ফয়েজ আহমদ মিয়া অভিযোগে বলেন, পাহাড়তলীর রেলওয়ে স্টেট ডিপার্টমেন্টের অফিস সহকারী আমিনুল ইসলাম এবং ইঞ্জিনিয়ার শহিদুজ্জামানসহ পাঁচজন বাংলাদেশ রেলওয়ের ভুয়া লিজের কাগজপত্র প্রদান করে তার কাছ থেকে ৭৫ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন এবং তার নামে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করে আসছেন। এ বিষয়ে রেলওয়ের সচিব বরাবর অভিযোগ দিলে তিনি মহাপরিচালককে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। অপর অভিযোগকারী পাহাড়তলীর হিসাবরক্ষক মো. সাহাবউদ্দিনের বিরুদ্ধে আইস ফ্যাক্টরি রোডের স্টেশন কলোনি সংলগ্ন রেলওয়ের ভূমিতে দোকান ও জায়গা ভাড়া দিয়ে বেআইনিভাবে অর্থ উপার্জনের অভিযোগ করেন। এর মধ্যে মো. ফয়েজ আহমদ মিয়ার অভিযোগ বিষয়ে ৭ দিনের মধ্যে জবাব দিতে নির্দেশ দেয়া হয়। অপর দিকে মো. সাহাবুদ্দিনের অভিযোগ মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়। তার উদ্দেশ্যে দুদক কমিশনার বলেন, আপনি নিজেই অপরাধ করেছেন।
অভিযোগগুলোর মধ্যে ৪২তম অভিযোগ ছিল বিআরটিসির বিরুদ্ধে। দপ্তরটি অযৌক্তিকভাবে ভ্যাট কর্তন করে এমন অভিযোগটি করেন কদমতলীর মো. আবুল মোকারম। শুনানি শেষে এ বিষয়ে তিনদিনের মধ্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে নির্দেশ দেয়া হয়।
চট্টগ্রাম ওয়াসার বিরুদ্ধে করা দুটি অভিযোগের মধ্য থেকে একটির বিষয়ে তাৎক্ষণিক সমাধান দেয়া হয়। মো. হাসান নামের অভিযোগকারীর অভিযোগটি তিনদিনের মধ্যে সমাধান করতে নির্দেশ দেয়া হয়। তিনি অভিযোগ করেন, তার আবাসিক বাড়ি থেকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বিল নেয়া হচ্ছে। অন্যজন শুনানিতে হাজির না থাকায় তা যাচাই বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত হয়।
৩৫তম অভিযোগকারী ছিলেন নুরুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি অভিযোগে উল্লেখ করেন, মিটার সংযোগ দিতে মোটা অংকের টাকা চেয়েছেন বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড এ কে খান অফিসের উপ-সহকারী প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম। এ বিষয়ে শুনানি শেষে ২৮ দিনের মধ্যে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেয়া হয়। এলএ শাখার বিরুদ্ধে ২৪তম অভিযোগটি করেন সীতাকুণ্ডের সেলিম রাহমান চৌধুরী নামের এক ব্যক্তি। তিনি তার অভিযোগে উল্লেখ করেন, তার ক্রয়কৃত ভূমি অধিগ্রহণ হয়। কিন্তু তিনি ক্ষতিপূরণ পাননি। অন্যজনকে তা দিয়ে দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে শুনানি শেষে সংশ্লিষ্ট শাখা বরাবর আবেদন করতে নির্দেশ দেয়া হয়। ২২তম অভিযোগটিও ছিল জেলা প্রশাসনের এলএ শাখার কয়েকজনের বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে শুনানিতে ডিসি বলেন, নিষ্পত্তিযোগ্য হলে অভিযোগটি নিষ্পত্তি করা হবে। ২১তম অভিযোগটি করেন মো. নুরুল ইসলাম নামের পটিয়ার এক ব্যক্তির। তার কাছ থেকে তহসিলদার জসিম উদ্দিন ও সার্ভেয়ার মো. মশিউর ঘুষ গ্রহণ করেছেন- এমনই অভিযোগ তার। এ বিষয়ে শুনানি শেষে ডিসিকে তহসিলদার বিষয়ে খোঁজ নিতে বলেন দুদক কমিশনার। এক পর্যায়ে ডিসি দুদক কমিশনারকে আশ্বস্ত করেন।
৩১তম অভিযোগটি বন্দর কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে করেন নুর চেহের বেগম নামের ৮৭ বছর বয়সী এক বৃদ্ধা। অধিগ্রহণকৃত জমির ক্ষতিপূরণের টাকা পাননি এমনই অভিযোগ তার। এ বিষয়ে শুনানিতে বন্দর কর্তৃপক্ষ বলেন, বিষয়টি সম্পূর্ণ জেলা প্রশাসনের। একপর্যায়ে জেলা প্রশাসক বৃদ্ধাকে ৫ লাখ টাকা সহায়তা দেবেন এবং এ সংক্রান্ত কাগজ দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে আশ্বস্ত করেন। ৩ নম্বর অভিযোগটি পাসপোর্ট অফিসের বিরুদ্ধে করেন রিপন বড়ুয়া নামের একজন সেবা গ্রহিতা। তিনি বলেন, পাসপোর্ট পেতে তিনি হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এ কারণে চিকিৎসার জন্য মাকে তিনি বিদেশ নিয়ে যেতে পারছেন না। এ বিষয়ে শুনানি শেষে দুই দিনের মধ্যে পাসপোর্ট দেবেন মর্মে সিদ্ধান্ত হয়। সবার শেষে ৪৭তম অভিযোগ বিষয়ে শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। অভিযোগটি জেলা নির্বাচন অফিসের বিরুদ্ধে করেন মো. রফিকুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি। দুদক কমিশনারের নির্দেশে এ অভিযোগের তাৎক্ষণিক সমাধান হয়।
উন্মুক্ত এ গণশুনানিতে প্রধান অতিথি ছিলেন দুর্নীতি দমন কমিশনের কশিনার ড. মো. মোজাম্মেল হক। জেলা প্রশাসক মো. মমিনুর রহমানের সভাপতিত্বে এতে আরও উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার আশরাফ উদ্দিন, দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) এ কে এম সোহেল, সিএমপি কমিশনার কৃষ্ণপদ রায়, দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি মনোয়ারা হাকিম আলী এবং অভিযোগকারী ও অভিযুক্ত দপ্তরের প্রতিনিধিরা।
গণশুনানি শেষে প্রধান অতিথির বক্তব্যে দুদক কমিশনার বলেন, সরকারি সব সংস্থাকে দুর্নীতিমুক্ত করতে নিজেদেরই সচেতন হতে হবে। অসৎ উদ্দেশ্যে কোনো সহজ কাজকে দীর্ঘসূত্রতার অজুহাতে আটকে রাখার সুযোগ নেই। আজ (গতকাল) যেসব অভিযোগ নিষ্পত্তি করা হয়েছে তার সঠিক প্রতিফলন যাতে হয় সেদিকে নজর দিতে হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবয়স ৪৭ থেকে হলো ৮৭, এখনো মেলেনি ভূমি অধিগ্রহণের টাকা
পরবর্তী নিবন্ধ৭৮৬