স্বাধীনতার পথ ধরেই বিকশিত হয়েছে উন্নয়ন

ড. শিরীণ আখতার | রবিবার , ২৬ মার্চ, ২০২৩ at ৫:৩২ পূর্বাহ্ণ

স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার অধিকার মানুষের জন্মগত অধিকার। যখন অন্যের দ্বারা লুণ্ঠিত হয় তখনই সে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। সর্বস্ব ত্যাগ করে তাই স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠায় জীবন উৎসর্গ করে মানুষ। মানুষ হিসেবে আমরা বাঙালি। বাঙালি জাতির রয়েছে আত্মত্যাগের এমনই একটি মহিমান্বিত দিন। যে দিনের তাৎপর্য অপরিসীম। এ দিনটি বাঙালির জীবনে বয়ে আনে আনন্দবেদনার হর্ষবিষাদ অনুভূতি। একদিকে হারানোর কষ্ট অন্যদিকে প্রাপ্তির আনন্দ। শেষ পর্যন্ত সর্বস্ব হারিয়ে যেন স্বাধীনতা প্রাপ্তির অপার আনন্দটা বড় হয়ে ওঠে প্রতিটি বাঙালির কাছে। গৌরবোজ্জ্বল এই দিনটি প্রতিবছর আসে আত্মত্যাগ ও আত্মপরিচয়ের বার্তা নিয়ে। স্মরণ করিয়ে দেয় আমাদের দায়িত্বকর্তব্য।

পলাশীর প্রান্তরে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হওয়ার পর দীর্ঘ ১৯০ বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করে পাকভারত উপমহাদেশের জনগণ পেয়েছিল পাকিস্তান ও ভারত নামের দুইটি দেশ। পাকিস্তানিরা যখন বাঙালিদের নতুন করে শোষণ ও পরাধীনতার শৃঙ্খলে বেঁধে রাখার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, ঠিক তখনই শতাব্দীর মহানায়ক জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার অভ্যুদয়ে বাঙালি জাতিকে মুক্তির মহামন্ত্রে উজ্জীবিত করে ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়ে গেছেন স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্যে। তিনি এ দেশের স্বাধিকার আন্দোলনে প্রেরণা দিয়েছিলেন। তার অপরিসীম সাহস, দৃঢ়চেতা মনোভাব ও আপসহীন নেতৃত্ব পরাধীন বাঙালি জাতিকে সংগ্রামী হওয়ার প্রেরণা জুগিয়েছিল।

১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বাঙালিদের রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। কিন্তু বিজয়ী দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয় না। শুরু হয় ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত করার ষড়যন্ত্র। ইয়াহিয়া তথা সরকারপক্ষ আলোচনায় বসতে চাইলেন এবং বসলেন। এবার শুরু হলো আলোচনার নামে কালক্ষেপণ। এতসব ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এ বিশাল জনসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়ে বললেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ২৫ মার্চ রাতে শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে ঘুমন্ত বাঙালিদের ওপর। পৃথিবীর ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাকাণ্ড চালায় ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নাম দিয়ে। ১৯৭১ সালের এই দিনে বাংলাদেশের মুক্তিকামী জনতা পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের সূচনা করে। আর এই দিনেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছিলতাই ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পালন করি আমাদেও মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। ২৫ মার্চ কাল রাত্রির পরপরই শুরু হয় প্রতিরোধ ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। সমগ্র জাতি দলমতধর্মবর্ণ নির্বিশেষে ‘জয় বাংলাজয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান বুকে ধারণ করে এবং হৃদয়ে বিশ্বাস স্থাপনের মধ্য দিয়ে মরণপণ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিপাগল বাঙালির রক্তের বন্যায় ভেসে যায় পাকিস্তানের দক্ষ, প্রশিক্ষিত ও আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত দু’লক্ষাধিক হানাদার বাহিনীর অত্যাচার, নির্যাতন, হত্যাযজ্ঞ, জ্বালাওপোড়াও অভিযান ‘অপারেশন সার্চলাইট’।

দেশ স্বাধীন করার প্রত্যয়ে দৃঢ়চিত্ত বাঙালি জাতির ইতিহাসে এ দিনটি একটি মাইলফলক। বস্তুত স্বাধীনতা শব্দটির তাৎপর্য গভীর ও ব্যাপক। স্বাধীনতা মানে নতুন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আয়োজন নয়, স্বাধীনতা হলো স্বাধীন রাষ্ট্রে সার্বভৌম জাতি হিসেবে টিকে থাকার আয়োজন। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল উদ্দেশ্যটাই ছিল যেন আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জন এবং কল্যাণমুখী, মানবিক, অসামপ্রদায়িক, প্রগতিশীল স্বতন্ত্র গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। দেশের মানুষের মৌলিক অধিকার কিংবা ন্যায়সংগত অধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমে জাতীয় পরিচয়’কে প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যই হলো এই স্বাধীনতা। শোষণ, বৈষম্য এবং অন্যায়ের অবসান ঘটিয়ে যেন ক্ষুধাদারিদ্র্য মুক্ত একটি সুখীসমৃদ্ধ সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ছিল স্বাধীনতার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। ফলে মহান স্বাধীনতা দিবস শুধু স্মৃতিচারণ নয়, জাতির জীবনে স্বাধীনতা অর্থবহ, তাৎপর্যময় করে তোলার পাশাপাশি স্বাধীনতাসার্বভৌমত্ব সংরক্ষণে শপথ গ্রহণের দিনও। স্বাধীনতা অর্জন যত কঠিন, স্বাধীনতা রক্ষা করা তার চেয়ে বেশি কঠিন। চলমান বিশ্ব প্রেক্ষাপট এবং আমাদের বাস্তবতায় এই বিষয়টি নানাভাবে বিবেচিত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। জাতির স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের মাধ্যমে জাতীয় নিরাপত্তা ও জাতীয় সমৃদ্ধি নিশ্চিত করা সম্ভব। আমাদের জানা দরকার, স্বাধীনতা মানে ইচ্ছার স্বাধীনতা, রাজনীতির স্বাধীনতা এবং অবশ্যই অর্থনৈতিক মুক্তি।

এই স্বাধীনতার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, মুক্তিবাহিনী এবং এদেশের জ্ঞানীগুণী বুদ্ধিজীবীরা সেদিন রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর টার্গেটে পরিণত হয়েছিল। তারা বাংলার জ্ঞানীগুণী এবং মুক্তিযোদ্ধার পরিবারকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গেলে নির্বিচারে গুলি করত মেরে ফেলতো। তাই এই রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের কথা বাংলার মানুষ সারাজীবন মনে রাখবে।

বহু ত্যাগ এবং সংগ্রামের বিনিময়ে আমরা এই স্বাধীনতা পেয়েছি। বঙ্গবন্ধু সারা জীবন সুখি সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্নট দেখে গেছেন। বঙ্গবন্ধু এদেশকে একটি সোনার বাংলায় পরিণত করতে। কিন্তু স্বাধীনতার ৫৩ বছরে আমাদের অর্জনও কম নয়। একসময় যে দেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলে উপহাস করা হতো সেই বাংলাদেশ আজ এশিয়ার একটি সম্ভাবনাময় দেশ। ১৯৭১ সালে সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকার বার্ষিক বাজেট আজ পরিণত হয়েছে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেটে। সেদিনের ১২৯ ডলার মাথাপিছু আয়ের দেশটিতে বর্তমান মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৫৫৪ ডলারে উন্নীত হয়েছে। সময় পেরিয়েছে, বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশও এগিয়েছে। আমাদের বৃদ্ধি এবং প্রবৃদ্ধি সময় ও প্রত্যাশার সঙ্গে সংগতি রেখেই ঊর্ধ্বগতি পেয়েছে। মাথাপিছু আয়, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে দৃশ্যমান পরিবর্তন, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ ও দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধি, বৈদেশিক বাণিজ্য বৃদ্ধি, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও ব্যবহার এবং সম্পদ উৎপাদন ও আহরণ দৃশ্যমান হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, সে কথা নির্মোহভাবেই বলা যায়।

এ অর্জনে আমরা অহংকার করতে পারি, গর্ব করতে পারি। বাংলাদেশ একসময় ছিল ভাগ্য ও পরনির্ভরশীল একটি দেশ। কিন্তু স্বাধীনতার পর আমাদের মানুষের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ ব্যাপক হারে বেড়েছে। জনগণই উন্নয়নের প্রধান কারিগর। শিক্ষা বাড়ছে। শিক্ষিত জনশক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু সুশিক্ষা, মূল্যবোধের শিক্ষা হ্রাস পাচ্ছে। তাই প্রয়োজন সুশিক্ষিত, মূল্যবোধ সম্পন্ন নৈতিক চরিত্রবান মানুষ। মূল্যবোধের শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষ তৈরি হলে তবেই গড়ে উঠবে সৎ, চরিত্রবান, মূল্যবোধ সম্পন্ন নাগরিক। নতুবা শিক্ষিত হবে, মানুষ হবে না।

আমাদের বর্তমান প্রজন্ম স্বাধীনতার ব্যাপারেই যথেষ্ট আগ্রহী। এই প্রজন্মকে স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেই এই দেশকে এগিয়ে নেওয়ার দীক্ষায় দীক্ষিত করতে হবে। এ জন্যেই এদের হাতে স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাসটিকে তুলে দেয়া জরুরি। জীবিত মুক্তিযোদ্ধা যারা রয়েছেন, তাদের কাছ থেকে সঠিক ইতিহাস সংগ্রহ করে ইতিহাসবিকৃতি রোধে ব্যাপক কাজ করা প্রয়োজন। আধুনিক শিক্ষা ও দক্ষ জনশক্তি উন্নয়ন, বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তাচেতনা, প্রযুক্তির ক্রমাগত ব্যবহার বৃদ্ধি এবং একটি পরমতসহিষ্ণু জাতি গঠনই নির্ধারণ করবে বাংলাদেশের আগামী দিনের অগ্রযাত্রা।

আমরা চেয়েছিলাম শোষণহীন একটি স্বাধীন দেশ, একটি প্রগতিশীল সমাজব্যবস্থা। আমাদের স্বাধীনতার লক্ষ্য ছিল দুঃখী মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন। চেয়েছিলাম শিক্ষাসংস্কৃতিতে, গণতান্ত্রিক চেতনায় আমাদের স্বাধীন ও স্বনির্ভর একটি দেশ গড়ে তুলতে যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মমতাময়ী মায়ের নেতৃত্বে ধীরে ধীরে পূর্ণ করছে। তাঁর গৃহীত মেঘা প্রকল্পগুলো দেশকে উন্নতির সোপানে নিয়ে গেছে। দেশ স্বাধীন হয়েছে বলেই উন্নয়ন বিকশিত হচ্ছে। আগামী ৫০ বছরে দেশ কতটা এগিয়ে যাবে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যেই সকল পরিকল্পনা করে রেখেছে।

হার্বার্ট হুভার বলেছিলেন, ‘স্বাধীনতা মানুষের মনে একটি খোলা জানালা, যেই দিক দিয়ে মানুষের আত্মা ও মানব মর্যাদার আলো প্রবেশ করে।’ একাত্তরের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের অর্জন এই জাতির শ্রেষ্ঠতম অর্জন ছিল বলেই আমরা মর্যাদায় সমাসীন হতে পেরেছি। অর্জিত মর্যাদা অক্ষুণ্ন থাকুক আজকের স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসে এটাই প্রত্যাশা।

লেখক : উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

ও বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদৈনিক আজাদীতে একাত্তরের মার্চ
পরবর্তী নিবন্ধফটিকছড়িতে ‘পূর্ব শত্রুতার জেরে’ ছুরিকাঘাতে খুন