স্বাধীনতার আজাদী ও স্বাধীন-আশার আজাদী

ড. মো. সেকান্দর চৌধুরী | সোমবার , ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৭:১৫ পূর্বাহ্ণ

১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি এ দেশের তরুণরা বাংলা ভাষাকে তৎকালীন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার জন্য বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছিল। সেই অসাধারণ আত্নোৎসর্গকে শ্রদ্ধা জানিয়ে একুশের প্রথম কবিতা “কাঁদতে আসিনি ফাঁসীর দাবি নিয়ে এসেছি’ রচনা করেছিলেন কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী। পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভয়াল ভ্রুকুটিকে উপেক্ষা করে ২২ ফেব্রুয়ারি রাতে এই কবিতাটি ছেপেছিলো কোহিনুর ইলেকট্রিক প্রেস (যা এখনকার আজাদী প্রেস) । এই পত্রিকাই বাঙালির প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের প্রচার দিয়েছিলো “জয় বাংলা, বাংলার জয়” শিরোনামে।
উদ্ধৃতিটি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সমাজতাত্ত্বিক ও বিশিষ্ট চিন্তক ড. অনুপম সেনের। লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো পত্রিকার নাম- আজাদী। আজাদীর আভিধানিক অর্থ স্বাধীনতা। পত্রিকার প্রকাশনা শুরু ষাটের দশকের গোড়া থেকে (প্রথম প্রকাশ ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৬০)। আর ষাটের দশক মানে উত্তাল বাংলাদেশ। এছাড়া পৃথিবীর দেশে দেশে তখন মুক্তিকামী মানুষের সংগ্রাম। আমাদের দেশের মুক্তির প্রত্যয় তখন একটিই। লাওস-ক্যাম্বোডিয়া-মোজাম্বিক-বলিভিয়ায় চলছে মরণজয়ী সংগ্রাম। বাংলাদেশের স্বাধীনতার যে টার্নিং পয়েন্টগুলো রয়েছে, যেমন ’৬২-’৬৪-র ছাত্র আন্দোলন, ’৬৯-র গণআন্দোলন, ’৭০-এর নির্বাচনসহ স্বাধীনতার দিকে ধাবিত প্রতিটি উত্তাল ও যুগান্তকারী ইস্যুতে দৈনিক আজাদীর ভূমিকা ছিলো ইতিহাসের মাইলফলক। আজাদী কোনো দলীয় পত্রিকা না হয়েও মুক্তিযুদ্ধ ও প্রগতিশীল চিন্তা- চেতনার প্রশ্নে নিরঙ্কুুশভাবে স্পষ্ট, একাট্টা। অবশ্য এর প্রেক্ষাপট আজাদীর জন্মলগ্ন ও প্রতিষ্ঠাকাল থেকে অঙ্কুরিত।
১৯৭১ সালের ১ মার্চ ইয়হিয়া খান পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করলেন। বিক্ষুব্ধ বাংলা ও বাঙালির মুখপাত্র হয়ে উঠলো আজাদী। ২ মার্চ স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন, ৩ মার্চ স্বাধীনতার ইশতেহার ঘোষণা, ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ভাষণ- এই উত্তাল দিনগুলোতে আজাদীর ভূমিকা ছিলো লড়াকু, দেশ আর জনগণের পক্ষে। ৮ মার্চ গঠন করা হয় চট্টগ্রাম সংগ্রাম পরিষদ এবং তখন থেকেই ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের বিপ্লবী কর্মকাণ্ড শুরু হয়। তাদের আশ্রয় আজাদী; প্রচারপত্র, যাবতীয় কর্মসূচির ইশতেহার। অতঃপর ২৩ মার্চ চট্টগ্রামের নেতারা শপথ গ্রহণ করেন। জয় বাংলা বাহিনীর মার্চ, ২৪ মার্চের প্রতিরোধ, শিল্পী সাহিত্যিক সংস্কৃতিকর্মীদের একাত্মতা ও সক্রিয় ভূমিকা, শ্রমিকদের আত্মত্যাগ এবং ২৬ মার্চ দিবাগত রাতে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রতিটি কর্মসূচিতে আজাদীর ছিলো সংগ্রামী ভূমিকা।
কবি-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের, যেমন- এ.আর মল্লিক, মমতাজউদ্দিন আহমদ, আবুল ফজল প্রমুখের যে যুগান্তকারী অবদান তা ইতিহাস । আর তাদের পৃষ্ঠপোষক ছিলো আজাদী।
পেছনে ফিরে তাকালে দেখতে পাই আজাদীর প্রতিষ্ঠাতা আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার এতদ্‌অঞ্চলের প্রথম মুসলিম প্রকৌশলী। সম্পূর্ণ বিপরীত পেশাগত মানসের এই মহাত্মা আন্দরকিল্লায় স্থাপন করেন কোহিনুর লাইব্রেরী। তারপর অদূরের কাটাপাহাড়ে কোহিনুর ইলেকট্রিক প্রেস। তিনি প্রকাশ করতে শুরু করলেন কোহিনুর নামে সাহিত্য পত্রিকা। ওই পত্রিকাকে ঘিরে সমবেত করলেন সাহিত্যিক মাহবুব উল আলম, ওহীদুল আলম, শওকত ওসমান, আবুল ফজল, সাদত আলী আখন্দ (মুস্তফা নুরুল ইসলাম, এম আর আখতার মুকুলের পিতা) প্রমুখ বরেণ্য সৃষ্টিশীল ব্যক্তিবর্গকে। এছাড়া ৫২’র ভাষা আন্দোলনে আজাদী প্রেস- এর ভূমিকা আমাদের গৌরবের অধ্যায়। দৈনিক বর্তমান আজাদীর সম্পাদক এম. এ. মালেক এর জবানি : আমার বাবা আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার নিজের প্রফেশন ছেড়ে লাইব্রেরি ও প্রেস করেছিলেন। তিরিশের দশকে পশ্চাদবাদ মুসলিম সমাজকে শিক্ষার মাধ্যমে এগিয়ে নিতে। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনে কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী রচিত একুশের প্রথম কবিতা ‘কাদতে আসিনি ফাঁসীর দাবি নিয়ে এসেছি’ কবিতাটি তিনি ছেপেছিলেন অসীম সাহসিকতায়। বায়ান্নের ২২ ফেব্রুয়ারি তারিখ রাতেই কোহিনুর ইলেকট্রিক প্রেসে শুরু হয়ে যায় কবিতাটি প্রকাশের কার্যক্রম। গভীর রাতে কম্পোজ ও প্রুফের কাজ যখন সমাপ্তপ্রায় তখন সরকারের গোয়েন্দা বাহিনী হঠাৎ হামলা শুরু করে প্রেসে। কিন্তু প্রেস কর্মচারীরা অতীব দ্রুততায় সম্পূর্ণ কম্পোজ ম্যাটার এমনভাবে লুকিয়ে ফেলে যে, তন্ন তন্ন করে খোঁজাখুঁজির পরও পুলিশ, তার খোঁজ পায়নি। ফলে ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসীর দাবি নিয়ে এসেছি’র প্রকাশনার কাজ শেষ করা যায়। পরদিন তেইশ ফেব্রুয়ারি তারিখে লালদীঘীর প্রতিবাদ সভায় কবিতাটি পাঠের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। পাক সরকার কবিতাটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ারকে গ্রেফতার করতে এলে প্রেস ম্যানেজার দবির আহমদ চৌধুরী নিজ কাঁধে ছাপার দায়িত্ব তুলে নেন। তাই গ্রেফতার করা হয় প্রেস ম্যানেজার দবিরকে। অবশ্য পরে তার জামিন দেয়া হয়েছিলো।
গোয়েন্দা গল্পের মতোই এ আখ্যান রোমাঞ্চকর মনে হলেও, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আজাদীর অতুলনীয় গৌরব সাহস ও কৃতিত্বের ইতিহাস।
শুধু তা নয়, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পত্রিকা প্রকাশের মহিমা অর্জনের স্বাক্ষরও আজাদী। ৭১-এর ১৬-ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলো। ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি ঘাতক সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করলো। পরদিন দেশের অন্য কোনো পত্রিকা প্রকাশিত হলো না। কিন্তু চট্টগ্রাম থেকে বেরিয়েছে একমাত্র দৈনিক আজাদী। এর হেডলাইন ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়।’- এ আমাদের জন্যে অনেক শ্লাঘার বিষয়।
এ- তো গেলো রাজনীতির প্রসঙ্গ। রাজনীতি কখনো পুষ্ট হয় না, সমান্তরালে যদি সংস্কৃতি পাশাপাশি হাত ধরে না এগোয়। মনে রাখতে হবে আজাদীকে কেন্দ্র করে এমন কতিপয় মহৎ, গুণী, সৃষ্টিশীল, প্রগতিমনস্ক ব্যক্তিত্বের সমাবেশ হয়েছিলো যাঁরা আজ কালের আখরে স্বমহিমায় দীপ্র। যেমন ধরা যাক- স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন আবুল কাশেম সন্দ্বীপ- তিনি ছিলেন আজাদীর পৃষ্ঠপোষকতায় পুষ্ট। এছাড়া শরীফ রাজা, সাধন ধর, অরুণ দাশগুপ্ত, সিদ্দিক আহমদ, বিমলেন্দু বড়ুয়া, সুখেন্দু ভট্টাচার্য, অমিতাভ বড়ুয়া, সুসাহিত্যিক আনিস চৌধুরী, মোহাম্মদ ইউসুফ, চৌধুরী জহুরুল হক, মোহাম্মদ হোসেন খান, মাহবুবুল হক- এরকম আরো অনেক উত্তুঙ্গ প্রতিভা রয়েছেন। যাঁরা কেবল আজাদীর সম্পদ নয়, সমগ্র দেশেরই গৌরব।
এছাড়া আজাদী এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যেটি থেকে জাতীয় পুরস্কার অর্জন করেছে তিন তিনজন কীর্তিমান। অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ পেয়েছেন স্বাধীনতা পুরস্কার, এম.এ. মালেক একুশে পদক এবং রাশেদ রউফ বাংলা একাডেমি পুরস্কার।
আজাদী কেবল শিল্প সাহিত্য নয়, সামাজিক আন্দোলনেও জনমত গঠনে কার্যকর ও সার্থক ভূমিকা পালন করে চলেছে। চলমান সিআরবি রক্ষা আন্দোলন, এর পক্ষে আজাদীর ভূমিকাও বিস্তৃত। আজাদী কর্তৃপক্ষ আন্দোলন সংশ্লিষ্ট লেখা নিয়ে প্রতিদিন পৃথক পরিসর বরাদ্দ করেছিলো। এছাড়া পহেলা বৈশাখ সিআরবিতে যে বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ অনুষ্ঠান হয়ে আসছে সেই আয়োজনের অন্যতম পৃষ্ঠপোষকতাও দৈনিক আজাদীর।
আজাদী চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত হলেও আজাদীর প্রচার সংখ্যা ঢাকার অনেক প্রতিষ্ঠিত পত্রিকার চেয়েও বেশী। আর একটি বিষয় উল্লেখ্য, যা আমাদের জন্যে গৌরবের বিষয় তা হলো- আজাদীর অনলাইন ভার্সন বাংলাদেশে প্রকাশিত অন্যান্য পত্রিকার চেয়েও অগ্রগণ্য বলে একটি পরিসংখ্যানে এই তথ্য ওঠে এসেছে।
আজাদী এখন ঐতিহ্য। আজাদী আর চট্টগ্রাম সমার্থক। আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ারের হাত ধরে যে পত্রিকার পথ চলাশুরু, অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ, এম.এ মালেক এবং তৎপরবর্তী ওয়াহিদ মালেক, শিহাব মালেকের ধারাবাহিকতায় উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ হচ্ছে আজাদী। পক্ষান্তরে বলা যায় যে, যা-কিছু শুভ কল্যাণকর তার পক্ষেই আজাদী। চির নবীন, চির নতুন- সবসময়ই আজাদীর নবযাত্রা । আজাদী সর্বতোভাবেই জনমুখী। আজাদীর এই অক্ষয় কীর্তি অব্যাহত থাকুক। যুগ যুগ জিয়ো- প্রিয় আজাদী।

লেখক : প্রফেসর, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, সাবেক ডিন, কলা ও মানববিদ্যা অনুষদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। প্রাবন্ধিক ও গবেষক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামের শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির ধারা
পরবর্তী নিবন্ধনামেই যার মুক্তি – তাকে আবদ্ধ করার শক্তি কোথায়?