ধূমকেতু পত্রিকার শতবর্ষ : প্রসঙ্গ কথা
ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম
সাংবাদিকতা এবং জনমত পরস্পর নির্ভরশীল। শুধু তাই নয় একটি অপরটির পরিপূরক। জনমত গঠনে সংবাদপত্র সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। বলা যেতে পারে জনমতের উদ্ভব এবং বিকাশের পথানুসরণ করেই গড়ে উঠে সাংবাদিকতার ইতিহাস। সত্য সংবাদ প্রকাশ করা, ন্যায় ও সত্যের জন্য অবিরাম সংগ্রাম করা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে, সর্বরকম কুসংস্কারের বিরুদ্ধে জনগণকে সংগ্রাম সচেতন করে তোলা, শাসক শ্রেণীর নির্দেশের কাছে মাথা নত না করা, নির্ভিকভাবে শাসকদলের হুমকির বিরুদ্ধে অন্যায় আদেশের বিরুদ্ধে, রুখে দাঁড়ানো, মেহনতি মানুষের জীবন–জীবিকার সংগ্রামের সমর্থনে দাঁড়ানো অত্যাচারিত –উৎপীড়িত মানুষের কন্ঠে প্রতিরোধের ভাষা দেয়া, গণতন্ত্রের জন্য, স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করা– এ সবই হচ্ছে সংবাদপত্রের সামাজিক দায়িত্ব। উপনিবেশিক শাসনামলে আজ থেকে একশত বছর পূর্বে ১৯২২ সালে কবি কাজী নজরুল ইসলামের ধূমকেতু সেই দায়িত্বই পালন করছিল। আমরা দেখতে পাই প্রথম বর্ষের প্রথম সংখ্যায় ধূমকেতু সেই সত্য উচ্চারণ করতে গিয়ে ‘সারথির পথের খবর’ শীর্ষক শিরোনামের সম্পাদকীয়তে বলেছিল:
“আমার এই যাত্রা হ’ল শুরু
ওগো কর্ণধার,
তোমারে করি নমস্কার!”
“মাভৈ: বাণীর ভরসা নিয়ে” “ জয় জয় প্রলয়ঙ্কর” ব’লে “ধূমকেতু”কে রথ ক’রে আমার আজ নতুন যাত্রা শুরু হ’ল। আমার কর্ণধার আমি। আমার পথ দেখাবে আমার সত্য। আমি প্রথমে আমার যাত্রা শুরুর আগে আমার সত্যকে সালাম জানাচ্ছি– নমস্কার ক’রছি। যে পথ আমার সত্যের বিরোধী, সে পথ ছাড়া আর কোনো পথই আমার বিপথ নয়। রাজভয়– লোকভয় কোনো ভয়ই আমায় বিপথে নিয়ে যেতে পারবে না।”
সম্পাদকীয়ের শেষে বলা হয়:
“ধূমকেতু কোন সাম্প্রদায়িক কাগজ নয়। মানুষ–ধর্ম্মই সব চেয়ে বড় ধর্ম্ম। হিন্দু মুসলমানের মিলনের অন্তরায় বা ফাঁকি কোনখানে তা দেখিয়ে দিয়ে এর গলদ দূর করা এর অন্যতম উদ্দেশ্য। মানুষে মানুষে যেখানে প্রাণের মিল, আদত সত্যের মিল, সেখানে ধর্ম্মের বৈষম্য, কোনো হিংসার দুষমনীর ভাব আনে না। যার নিজের ধর্ম্মে বিশ্বাস আছে, যে নিজের ধর্ম্মের সত্যকে চিনেছে, সে কখনো অন্য ধর্ম্মকে ঘৃণা করতে পারে না। দেশের পক্ষে যা মঙ্গলকর, যা সত্য শুধু তাই লক্ষ্য করে আমার এই আগুনের ঝাণ্ডা দুলিয়ে পথে বাহির হলাম। “ জয় প্রলয়ঙ্কর”!”
সংবাদপত্র জগতে কবি কাজী নজরুল ইসলাম হঠাৎ করেই আসেন নি। গত শতকের গোড়ার দিক থেকেই কবি কাজী নজরুল ইসলাম বেশ কিছু পত্রিকার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ফলে ধূমকেতু সম্পাদনার সাহস যুগিয়েছিল পূর্বতন নবযুগ পত্রিকার সম্পাদনার অভিজ্ঞতা । বলা বাহুল্য নবযুগ পত্রিকা দিয়েই কবি কাজী নজরুলের সাংবাদিকতা জীবন শুরু হয় আবার পরবর্তীকালেও ‘নবযুগ’ দিয়েই তাঁর সংবাদিকতার পরিসমাপ্তি ঘটে। ১৯২০ সালে সারাদেশে তখন শ্রমিকদের ধর্মঘট চলছিলো। ঠিক সেসময় নজরুলের ‘মুহাজিরিন হত্যার জন্য দায়ী কে’ প্রবন্ধটি প্রকাশ হওয়ায় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এবং নবযুগ পত্রিকাটিকে ব্রিটিশ সরকারের রোষানলে পড়তে হয়, জামানতের টাকাও বাজেয়াপ্ত করা হয়। জরিমানা দিয়ে নতুন করে সাহিত্যিক মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলীর নামে ডিক্লারেশন নেয়া হয়। জ্বালাময়ী লেখা নিয়ে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের সঙ্গে মতবিরোধের কারণে ১৯২০ সালের ডিসেম্বরে মাত্র সাত মাস কাজ করার পর নজরুল ‘নবযুগ’ ছেড়ে চলে যান। এরপর ১৯২১ সালে জানুয়ারি মাসে ‘নবযুগ’ পত্রিকার প্রকাশ বন্ধ হয়ে যায়।
নবযুগ ছেড়ে আসার পর কাজী নজরুল ইসলাম বেশ কিছুদিন কুমিল্লায় ছিলেন। সেখানে বসে তিনি তাঁর সাহিত্য রচনায় মন দেন। চার–পাঁচ মাস পর তিনি আবার কলকাতায় চলে আসেন এবং ‘দৈনিক সেবক’ পত্রিকায় যোগদান করেন। মওলানা আকরম খাঁ ছিলেন এই পত্রিকার কর্ণধার। কিন্তু কবি কাজী নজরুল ইসলাম এখানেও বেশিদিন কাজ করতে পারেন নি। স্বাধীনচেতা হবার কারণে ১৯২১ সালে সেবক পত্রিকায় অগ্রসর শিরোনামে এক সম্পাদকীয় লেখার কারণে পত্রিকাটি নিষিদ্ধ হয় এবং মওলানা আকরম খাঁ গ্রেপ্তার হন। কিছুদিন পর পত্রিকাটি আবারো প্রকাশিত হয়। এবারে কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর সহযোগী হিসেবে আবুল কালাম শামসুদ্দীন যুক্ত হলেন। কিন্তু কবির শব্দ চয়ন এবং শিরোনামের সঙ্গে পত্রিকা কর্তৃপক্ষের বনিবনা না হবার কারণে তিনি স্বেচ্ছায় সেবক পত্রিকার চাকরী ছেড়ে দেন।
এরপর আবারো তিনি নিজেই পত্রিকা প্রকাশে আগ্রহী হয়ে উঠেন এবং ধূমকেতু প্রকাশের সকল রকম ব্যবস্থা করেন। ধূমকেতু পত্রিকার আবির্ভাব সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দীন যুগস্রষ্টা নজরুল গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন– ” নবযুগ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় লিখে নজরুল তাঁর মনের আগুন ছড়িয়ে যেন আরাম পান না – পান না তৃপ্তি। অবহেলিত উৎপীড়িত লাঞ্ছিত জাতি তার মুখের পানে চেয়ে আছে। এটা তিনি অনুভব করেছেন। তাই ঘা মেরে এদের জাগাবার সংকল্প নিয়েছেন নজরুল। ব্রত নিয়েছেন। নিজের হাতে কাগজ না থাকলে তো স্বাধীনভাবে কথা বলা যায় না। দু:সাহসী, লা –পরোয়া নজরুল স্থির করলেন, ‘ধূমকেতু‘ নামে একখানা অর্ধ সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করবেন।” ( যুগস্রষ্টা নজরুল, পৃ. ৩২)
ধূমকেতু পত্রিকা সপ্তাহে দুই দিন বের হতো। অধিকাংশ সংখ্যাই শুক্রবার ও মঙ্গলবার প্রকাশিত হয়েছে, পত্রিকার পৃষ্ঠার আকৃতি ছিল ক্রাউন ফোলিও (১৫ ইঞ্চি বাই ২০ ইঞ্চি)। প্রথম সংখ্যা ছিল ১৬ পৃষ্ঠার। প্রতি সংখ্যার দাম ছিল ১ আনা। পত্রিকার বার্ষিক গ্রাহক মূল্য ছিল পাঁচ টাকা। ধূমকেতু পত্রিকা প্রকাশে আর্থিক সহায়তা দেন চট্টগ্রামের হাফিজ মাসউদ আহমদ। এই আর্থিক সহায়তার পরিমাণ ছিল আড়াইশো টাকা (অরুণ কুমার বসু, নজরুল জীবনী, পৃ.১০৪)। ধূমকেতু পত্রিকার সম্পাদক, সারথি ও স্বত্বাধিকারী ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। প্রথম থেকে সপ্তম সংখ্যা পর্যন্ত সম্পাদক হিসেবে, অষ্টম সংখ্যা থেকে সারথি হিসেবে এবং ছাব্বিশ সংখ্যা থেকে প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে নজরুলের নাম মুদ্রিত হয়। পত্রিকার মুদ্রাকর ও প্রকাশক আফজাল–উল হক, কর্মসচিব বা ম্যানেজার ছিলেন শান্তিপদ সিংহ। প্রাথমিক পর্যায়ে ধূমকেতুর ঠিকানা ছিল ৩ নং কলেজ স্কয়ার, কলিকাতা, কিন্তু সপ্তম সংখ্যার পর অফিস চলে যায় ৭ প্রতাপ চাটুজ্যে লেনে। ধূমকেতু প্রকাশিত হতো কলকাতার ৭৯ নং বলরাম দে স্ট্রীটের মেটকাফ প্রেস থেকে।
১৯২২ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ধূমকেতুর ১ম বর্ষ ৯ম সংখ্যা থেকে ঘোষণা করা হয়” ‘ধূমকেতু‘র একমাত্র স্বত্ত্বাধিকারী কাজী নজরুল ইসলাম।” এই সংখ্যায় প্রকাশিত” ধূমকেতুর কেন্দ্রচ্যুতি শীর্ষক বিজ্ঞাপনে বলা হয়: ধূমকেতু কেন্দ্র ৭নং প্রতাপ চাটুয্যের লেন–এ উঠে এসেছে। অত:পর চিঠিপত্র, টাকাকড়ি, বিনিময়ের কাগজ সবই এই ঠিকানায় পাঠানোর অনুরোধ করা হয়।
১৯২২ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ১ম বর্ষ ১০ম সংখ্যা থেকে ধূমকেতুর প্রিন্টার্স লাইনে পরিবর্তন দেখা যায়। এই সংখ্যা থেকে প্রিন্টার্স লাইনে Printed, published & Edited by Afzalul Huque মূদ্রিত হতে থাকে। কিন্তু এটা বেশি দিন কার্যকর থাকেনি। ১৯২২ সালের ২৪ অক্টোবর থেকে পুণরায় প্রিন্টার্স লাইনে Printed, published & Edited by Quazi Nazrul Islam লেখা হয়। ধূমকেতু পত্রিকার ৪র্থ সংখ্যা থেকে ৬ষ্ঠ সংখ্যায় দাবী করা হয়: কলকাতায় সব কাগজের চেয়ে বেশী কাটতি। ইংরেজীতেও লেখা হয়: Guaranteed Largest circulation in Calcutta
ধূমকেতু খুব বেশিদিন প্রকাশিত হতে পারে নি। প্রথম সংখ্যা ছাপা হয়েছিল ১৯২২ সালের ১১ আগষ্ট এবং শেষ সংখ্যা ১৯২৩ সালের ২৭ জানুয়ারি। সময়ের হিসেবে টিকে ছিল মাত্র পাঁচ মাস ষোল দিন। ( সেলিনা বাহার জামান, নজরুলের ধূমকেতু, ভূমিকা অংশ)
ধূমকেতু পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় ধূমকেতু নামে কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা একটি কবিতা প্রকাশিত হয়। এই কবিতার মাধ্যমেই এটা পরিষ্কারভাবে প্রতীয়মান হয় যে, ‘ধূমকেতু ‘ জনগণের আশা আকাঙ্খার ধারক হিসাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল। ধূমকেতু কে উদ্দেশ্য করে লেখা ‘ কবিতায় কাজী নজরুল ইসলাম লেখেন:
আমি যুগে যুগে আসি, আসিয়াছি পুন: মহাবিপ্লব হেতু
এই স্রষ্টার শনি মহাকাল – ধূমকেতু
সাত সাতশ নরক জ্বালা জ্বলে মম ললাটে,
মম ধূম কুণ্ডলী করেছে শিবের ত্রিনয়ন ঘন ঘোলাটে!
ধূমকেতুর প্রথম সংখ্যাতে বিদ্রোহী কবিতাটিও পুন:মূদ্রিত হয়। কেন পুন:মূদ্রিত হলো সে বিষয়ের ব্যাখ্যাতে বলা হয়: “এই কবিতাটি প্রথমে ‘ মোসলেম ভারতে’ বের হয়। পরে এটা ‘ বিজলী’ ‘প্রবাসী’ প্রভৃতি পত্রিকায় উদ্ধৃত হয়। অনেক পাঠক কবিতাটি সম্পূর্ণভাবে পাবার জন্য ঐ সংখ্যার ‘মোসলেম ভারত’ কিনতে গিয়ে নিরাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন। কেননা ঐ সংখ্যায় পত্রিকা এত বেশী নগদ বিক্রী হয়ে গেছে যে ‘মোসলেম ভারত’ এর গ্রাহকগণ ছাড়া এখন আর কাকেও দেওয়া হচ্ছে না। সেই জন্যে অনেকের অনুরোধে আমরা কবিতাটী ‘ ধূমকেতু’তে উদ্ধৃত করে দিলাম। প্রার্থনা, কেউ যেন এটা আমাদের ধৃষ্টতা বলে মনে না করেন।”
ধূমকেতু শুধু সংবাদপত্রের দায়িত্বই পালন করেনি , পত্রিকাটিতে গান, কবিতা রম্য রচনা নিয়মিতভাবে প্রকাশ পেত। উল্লেখযোগ্য কবিতাগুলির মধ্যে ছিল– ল্যাবেণ্ডিশ বাহিনীর বিজাতীয় সঙ্গীত, রক্তাম্বরধারিণী মা, কামাল পাশা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
ধূমকেতু পত্রিকা প্রকাশ উপলক্ষে অনেকেই আনন্দ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিলেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পাঠালেন আর্শীবাণী। যেটা ধূমকেতু পত্রিকায় প্রতিটি সংখ্যায় ব্যানার শিরোনামের নীচে ছাপা হতো। কবি গুরু বাংলা ১৩২৯ সালের ২৪ শ্রাবণ লিখেছিলেন: কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু–
“আয় চলে আয় রে ধূমকেতু,
আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু,
দুর্দ্দিনের এই দুর্গ শিরে,
উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন?
অলক্ষণের তিলক রেখা,
রাতের ভালে হোক না লেখা,
জাগিয়ে দে রে চমক্ মেরে’
আছে যারা অর্দ্ধচেতন। ”
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৯২২ সালের ১২ সেপ্টেম্বর তারিখের ৮ম সংখ্যায় ‘বর্ষামঙ্গল’ নামে একটি কবিতা ছাপা হয়। কবিতাটি হয়ত ধূমকেতুকে নিয়েই লিখেছিলেন। এজন্য কবি কাজী নজরুল ইসলাম কবিতার ব্যানারে লিখলেন ‘মিষ্টিমুখ’। কথাশিল্পী, ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও কবি নজরুল ইসলামকে পরম কল্যাণীয়বরেষু সম্বোধনে শুভেচ্ছা জানিয়ে লিখেছিলেন: “ তোমার কাগজের দীর্ঘজীবন কামনা করিয়া তোমাকে একটি মাত্র আশীর্ব্বাদ করি, যেন শত্রু মিত্র নির্ব্বিশেষে নির্ভয়ে সত্য কথা বলিতে পার।” কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচী তিনিও আর্শীবাদবাণী পাঠালেন। সেদারোপম শ্রীমান কাজী নজরুল ইসলাম প্রিয়বরেষু সম্বোধনে ছন্দবদ্ধ কবিতায় লিখলেন–
প্রলয়াত্মিকা প্রোজ্জ্বল শিখা– সর্বনাশের সাথী,
জ্বালুক, বন্ধু, ধূমকেতু তব বিশ্বদহন বাতি।
কুমিল্লার বিরজাসুন্দরী দেবী যাঁকে কবি নজরুল ইসলাম মা বলে সম্বোধন করতেন, তিনিও মায়ের আশিস নামে শুভেচ্ছা পত্র পাঠান। ধূমকেতুর প্রথম সংখ্যার দ্বিতীয় পাতায় সেটা ছাপা হয়। “গগনে ধূমকেতুর উদয় হলে জগতের অমঙ্গল হয়, ঝড়, ঝঞ্ঝা, উল্কাপাত, ভূমিকম্প, দুর্ভিক্ষ, মহামারী অনিবার্য্য হয়ে ওঠে, এটা জ্যোতিষ শাস্ত্রের কথা বলে জ্ঞান হয়েছে অবধি শুনে আসছি। ৃ তিমির রাত্রির অবসানে যখন অরুণ রাগে তরুণ সূর্য্যের উদয় হবে, তখন তোমার এই ‘ধূমকেতু’ আলোর সেতু হয়ে আঁধারের পারে নিয়ে যাবে। প্রার্থনা করি যত দিন এই আগুনের শিখা এই ‘ধূমকেতু’র প্রয়োজন, তত দিন এ অমঙ্গল মঙ্গলমতে নিরাপদে থাক।”
সরোজিনী নাইডু ধূমকেতুর শুভেচ্ছাবার্তায় বলেছিল, ‘তোমার ‘ধূমকেতু’ মানুষে মানুষে মিলনের সকল অন্তরায় চূর্ণ করে দিয়ে মহামানবের সৃষ্টির শক্তি ও সামর্থ্য এনে দিক।’
সাধারণ জনগণের মধ্যেও ধূমকেতু পত্রিকা নিয়ে ব্যাপক উচ্ছ্বাস ছিল। খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দীন লিখেছেন, ” ‘ধূমকেতু‘ যেদিন প্রকাশিত হলো, কোলকাতার কলেজ স্কোয়ারের মোড়ে দেখেছি সেদিন কাড়াকাড়ি পড়ে গিয়েছিল। সারা দেশের মনের কথা টেনে বার করে নজরুল যেন ছড়িয়ে দিয়েছিলেন কাগজের পাতায় পাতায়, প্রতি ছত্রে।” ( যুগস্রষ্টা নজরুল, পৃ. ৩৩)। ধূমকেতুতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে চিঠি লিখতেন। কবি নজরুল ইসলাম চিঠিগুলি বাছাই করে ‘হংসদূত’ নামে ধূমকেতুতে ছাপাতেন।
ধূমকেতু পত্রিকাতে দেশ বিদেশের খবর ছাপা হতো খুব সংক্ষিপ্তাকারে। এর শিরোনাম ছিল ‘আগুনের ফুলকি’। দুই একটা উদ্ধৃত দেয়া যেতে পারে
যেমন প্রথম সংখ্যায় কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের খবর, পটুয়াখালি কংগ্রেসের সম্পাদক শ্রীযুক্ত সতীন্দ্র্রনাথ বাবুর কারাগারে অনশনের খবর, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ এবং বীরেন্দ্রনাথ শাসমল বাবুর কারাগার থেকে মুক্তি লাভের খবর জানা যায়। নিয়মিত কলামের মধ্যে ছিল নারী কল্যাণ, মুসলিম জাহান, সন্ধ্যা প্রদীপ,স্বদেশী সন্দেশ, পরদেশী পঞ্জী,শানাই এর পোঁ, উল্লেখযোগ্য।
উপনিবেশিক শাসনামলে সংবাদপত্র গুলির একটা বড় বৈশিষ্ট্য ছিল সম্পাদকীয়। ধূমকেতু‘ পত্রিকা প্রকাশের পর থেকে এর সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল সম্পাদকীয়। ধুমকেতু পত্রিকায় প্রকাশিত সম্পাদকীয়ের সঙ্গে সরকারি দফতরের বা প্রশাসনের একটা ব্যবধান ছিল এবং সম্পাদক হিসেবে কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর নিজের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে চলতেন। সেই সময় ‘সম্পাদকীয়’ স্তম্ভ্ভে কবি যা প্রকাশ করতেন, তা আজ বোধহয় কোনো সম্পাদকই প্রকাশ করতে সাহস করবেন না, বরং লজ্জা বোধ করবেন।
কবি কাজী নজরুল ইসলাম প্রথাগত সাংবাদিকতার ঘোর বিরোধী ছিলেন। তিনি মনে করতেন প্রচলিত সাংবাদিকতায় উপনিবেশিক শাসনকে আঘাত করা যাবে না, ফলে লজ্জা, মান, ভয় এগুলো উপেক্ষা করে সম্পাদকীয় স্তম্ভে বিভিন্ন বিষয়ের সন্নিবেশ ঘটান। তাতে কবিতাও স্থান পেত। আজকাল কবিতা ও কবির প্রাচুর্য নিয়ে আমরা ঠাট্টাবিদ্রুপ করে থাকি, আর সংবাদপত্রে কবিতার বিশেষ আমলও দেওয়া হয় না, সম্পাদকীয়তে তো নয়ই। কিন্তু আজ থেকে শতবর্ষ আগে কবি এই কাজটিই করেছেন মনের আনন্দে। কবিতায় লেখা সম্পাদকীয়তে কবি নজরুল ইসলাম মানুষের স্বাধীনতা, সাম্য ও মুক্তির আকাঙ্ক্ষার কথা বলতেন, যা পাঠক সমাজকে আলোড়িত করেছিল। ধূমকেতু পত্রিকার সম্পাদকীয় লেখার কারণে কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন।
১৯২২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয় ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ সম্পাদকীয় । কবিতার আকারে লেখা এই সম্পাদকীয়টির জন্য নজরুল এক বছর জেল খাটেন। সাহিত্য যে শোষক–নির্যাতনকারীর গায়ে চাবুকের মতো আঘাত করতে পারে তারই উদাহরণ নজরুলের এই কবিতা। এটি তাঁরই সম্পাদিত ‘ধূমকেতু’ পত্রিকার ১২শ সংখ্যায় (১৯২২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর) প্রকাশিত হয়। ধূমকেতুতে প্রকাশের পর এটি তাঁর সুস্থাবস্থায় কোনো গ্রন্থে সঙ্কলিত হয়নি।কবিতাটি প্রকাশের পর পুলিশ ধূমকেতু অফিসে হানা দেয় ৮ নভেম্বর ১৯২২ সালে। পুলিশ নজরুলকে খোঁজ করে কারণ তাঁর বিরুদ্ধে ফৌজদারী দন্ডবিধি আইনের ১২৪–ক ধারা অনুসারে রাজদ্রোহের অভিযোগে গ্রেফতারি পরোয়ানা ছিল। ‘ধূমকেতু’ অফিসে তখন উপস্থিত ছিলেন মুজফফর আহমদ ও আবদুল হালিম। তাঁরা পুলিশকে জানান, নজরুল কলকাতার বাইরে। কবিতাটি প্রকাশের ছয় সপ্তাহ পর ৮ নভেম্বর নজরুলের গ্রেফতারী পরোয়ানা নিয়ে পুলিশ পুনরায় ‘ধূমকেতু’ অফিসে এবং প্রেসে হানা দেয়। প্রসঙ্গটি ১৯২২ সালের ১৭ নভেম্বর তারিখের ধূমকেতু পত্রিকার প্রথম পাতায় ”ধূমকেতু”র গ্রহণ শিরোনামে ছাপা হয়। যেখানে উল্লেখ করা হয়েছিল– “গত ৮ই নভেম্বর (১৯২২) সকাল বেলা লালবাজারের গ্রহ ধূমকেতু কেন্দ্রে উদয় হয়েছিলেন। একই সময়ে আর একদল প্রেসেও দেখা দিয়েছিলেন। তারা কাজী নজরুল ইসলামকে চাইলেন। কিন্তু তিনি অনুপস্থিত থাকায় দেওয়ালী (১৫শ) এবং আগমনী (১২শ) সংখ্যার সব কাগজ, চিঠীপত্র ও হিসেব ইত্যাদি নিয়ে যান। যবে ‘গ্রহণ লাগা’ সুরু হোল।” একই সংখ্যায় ‘ধূমকেতুর কৈফিয়ৎ’ প্রসঙ্গে বলা হয়: গত ৮ই তারিখের ধূমকেতুর গ্রহণের ফলে আফিসের খাতা পত্র অনেক বেহাত হয়ে যাওয়ায় আমাদিগকে অনেক অসুবিধার মধ্যে কাজ চালাতে হচ্ছে। কাগজ পাঠান এবং চিঠিপত্র ইত্যাদি ব্যাপারে গ্রাহকগণের হয়ত অনেকেই কিছু না কিছু অসুবিধা ভোগ করতে হয়েছে এবং হবেও। আরা আগে থেকেই তার ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।”
পুলিশ ৩২, কলেজ স্ট্রীটে হানা দিয়ে ‘ধূমকেতুর’ প্রকাশক ও মুদ্রাকর আফজালুল হককে গ্রেফতার করে। তিনি অবশ্য তিন–চার দিন প্রেসিডেন্সি জেলে হাজতবাসের পর জামিনে মুক্তিলাভ করেন। পুলিশী হামলা সত্ত্বেও ধূমকেতু ২২শ সংখ্যা ১৭ নভেম্বর ১৯২২ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত হয়। এরপরের ‘ধূমকেতু’র কয়েকটি সংখ্যা প্রকাশক ও মুদ্রাকর অমরেশ কাঞ্জিলালের পরিচালনায় প্রকাশিত হয়। রফিকুল ইসলাম জানান, ‘নজরুলের গ্রেফতারের পূর্বেই বিহারে সমস্তিপুরে চলে যান, গিরিবালা দেবী তখন প্রমীলাকে নিয়ে সেখানে ভাইদের কাছে ছিলেন। নজরুল সমস্তিপুর থেকে তাদের নিয়ে কুমিল্লায় যান।’কুমিল্লা ‘ঝাউতলা মোড়’ থেকে ১৯২২ সালের ২৩ নভেম্বর পুলিশ নজরুলকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের পর কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে এক রাত রেখে পরদিন তাঁকে কলকাতায় নিয়ে যায় পুলিশ। বিচারাধীন বন্দী হিসেবে নজরুলকে রাখা হয় প্রেসিডেন্সি জেলে। ১৯২৩ সালের জানুয়ারি মাসে কলকাতার চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট সুইনহোর আদালতে তাঁর বিচার শুরু হয়। [তাহা ইয়াসিন, যে কবিতার জন্য নজরুল জেল খেটেছিলেন, https://pododhoni.com/যে–কবিতার–জন্য–নজরুল–জেল–খ/) জুলাই ২০, ২০২১ ]
১৯২৩ সালের ১৬ জানুয়ারি মতান্তরে ১৭ জানুয়ারি বিচারক সুইনহো মামলার রায় দেন। ভারতীয় ফৌজদারী দণ্ডবিধির ১২৪–ক এবং ১৫৩–ক ধারা অনুযায়ী ‘ধূমকেতু’ রাজদ্রোহ মামলায় নজরল এক বছর সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত হন।বিচারক সুইনহো একজন কবি ছিলেন। বিচারক একজন কবি হয়েও নজরুলকে সাধারণ কয়েদীর পর্যায়ে ফেলেন। প্রথম বা দ্বিতীয় শ্রেণীভুক্ত করেননি। ( তাহা ইয়াসিন, ঐ)।
নজরুলের এই জবানবন্দীতে যে জ্বালাময়ী প্রতিবাদ প্রকাশিত হয়েছে তার বহিঃপ্রকাশ ছিল কবিতাটির মাঝে। আর নজরুল তাঁর কবিতার মাধ্যমে যে তীব্র প্রতিবাদের জোয়ার তুলেছিলেন, তাই তাঁকে জেলে পুরে দমাতে চেয়েছিল ইংরেজ সরকার। নজরুলের পূর্বে ইংরেজের রাজরোষে পড়েছিলেন বেশ ক’জন কবি, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক ও প্রাবন্ধিক। তাঁদের মধ্যে মুকন্দদাস (১৮৭৮–১৯৩৪), সখারাম গণেশ দেউস্কর (১৮৬৯–১৯২২) অন্যতম। কিন্তু নজরুলকে নিয়ে দেশজুড়ে যে আন্দোলন–বিক্ষোভ হয়েছে। অন্যদের বেলায় হয়নি। কারণ পূর্বের ওই সকল সাহিত্যিকের চেয়ে নজরুলের প্রতিবাদী কণ্ঠ ছিল বেশি শক্তিশালী এবং নজরুল ছিলেন সে সময়ের জনপ্রিয় কবি। বিচারাধীন বন্দী হিসেবে নজরুলকে গ্রেফতারের পর রাখা হয়েছিল প্রেসিডেন্সি জেলে। বিচার শেষে ১৭ জানুয়ারি ১৯২৩ তাঁকে আলীপুর সেন্ট্রাল জেলে স্থানান্তর করা হয়। (তাহা ইয়াসিন, ঐ)।
কেন ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতাটির ওপর ব্রিটিশ সরকার নাখেশ হয়েছিলেন? কেন ব্রিটিশ সরকার এটাকে ভালো চোখে দেখেন নি? এর কারণ কবিতাটির মর্মার্থ সকালীন অসহযোগ উত্তর আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের জয়গান এবং সমালোচনা। কবিতাটিতে এ আন্দোলনকে সক্রিয় করার জন্য সমস্ত দেশবাসীর প্রতি ছিল অংশগ্রহণের আহ্বান। অন্যদিকে ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ–উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব যাঁরা ইংরেজের বিরুদ্ধে লড়তে লড়তে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন তাঁদের লড়াইয়ের কথা ।
ধূমকেতু পত্রিকায় প্রকাশিত অন্যান্য সম্পাদকীয়গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল: সারথির পথের খবর ,কাণার বোঝা কুঁজোর ঘাড়ে, রুদ্র মঙ্গল, মোরা সবাই স্বাধীন সবাই রাজা, আমরা লক্ষ্মী ছাড়ার দল, তুবরী বাশীর ডাক, বিষ বাণী, মেয় ভুখা হু, ক্ষুদিরামের মা, পথিক! তুমি পথ হারাইয়াছ?, আনন্দময়ীর আগমনে (কবিতাতে সম্পাদকীয়), ধূমকেতুর পথ, কামাল, দেয়ালী উৎসব, রণ–ভেরী (কবিতা) উল্লেখযোগ্য। উপনিবেশ শাসনের বিরুদ্ধে কবি ছিলেন সোচ্চার । রণভেরী সম্পাদকীয় লেখার উদ্দেশ্য ছিল গ্রীসের বিরুদ্ধে এ্যাঙ্গোলার তুর্কী গভর্ণমেন্ট যে যুদ্ধ চালিয়েছিলেন , সেই যুদ্ধে কামাল পাশার সাহায্যের জন্য ভারতবর্ষ থেকে দশ হাজার ভলান্টিয়ার সেনা পাঠানোর প্রস্তাব জানিয়ে কবিতার আকারে এই সম্পাদকীয় লিখেছিলেন। রণ ভেরীতে কবি নজরুল লিখলেন:
ঐ মহা সিন্ধুর পার হতে ঘন রণ ভেরী শোনা যায়–
ওরে আয়!
১৯২২ সালের ৩১ শে অক্টোবর ধূমকেতুতে ‘আমি সৈনিক’ শীর্ষক সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়। এই সম্পাদকীয়তে বলা হয়: ‘এখন দেশে সেই সেবকের দরকার যে সেবক দেশ– সৈনিক হতে পারবে।’
১৯২২ সালের ৩রা নভেম্বর তারিখের সম্পাদকীয় ছিল তেজস্বী মন্ত্রে উজ্জীবিত করার মতো। ‘নিশান বরদার‘ শীর্ষক এই সম্পাদকীয়তেও বলা হলো: ওঠ ওগো আমার নির্জীব ঘুমন্ত পতাকাবাহী স্বীয় সৈনিকদল। ওঠো, তোমাদের ডাক পড়েছে – রণ দুন্দুভি রণ ভেরী বেজে উঠেছে। তোমার বিজয় নিশান তুলে ধর। উড়িয়ে দাও উচু করে ধরে, তুলে দাও … পুড়িয়ে ফেল ঐ প্রাসাদের উপর যে নিশান বুক ফুলিয়ে দাড়িয়ে তোমাদের উপর প্রভূত্ব ঘোষণা করছে। ভেঙ্গে ফেল ঐ প্রাসাদ শৃঙ্গ! বল আমি আছি। আমার সত্য আছে। বল আমরা স্বাধীন। আমরা রাজা। বিজয় পতাকা আমাদের; আর কারো জন্য নয়। আমাদের বিজয় পতাকা তুলে ধরবার জন্যে এসো সৈনিক। পতাকার রং হবে লাল, তাকে রং করতে হবে খুন দিয়ে। বল আমরা পেছাব না।“
সত্যিকার অর্থে ১৯২২ সালের কবির ভাবনা মিলে গেছে ১৯৭১ সালে। বাংলাদেশ এক মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জন করেছে এক মহান পতাকা। যে পতাকার রং লাল আর সেটা শহীদের রক্তে রাঙা।
এভাবে কবি কাজী নজরুল ইসলামের নিজস্ব ঢংয়ে লেখা সম্পাদকীয় বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মী ও জনসাধারণের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি করে। সম্ভবত এ কারণেই প্রথাগত সাংবাদিকতার গন্ডি ডিঙ্গিয়ে ধূমকেতু নতুন মাত্রা যোগ করে। রাজনীতি, সমাজ, সাহিত্য ইত্যাদি নানা বিষয়ে ধূমকেতু পত্রিকা অফিসে আড্ডাও জমে উঠত। আসরে নিয়মিত যোগ দিতেন মঈন উদ দীন হোসায়ন, পবিত্র গাঙ্গুলী, নৃপেন চ্যাটার্জী এবং আরো অনেকে। ধূমকেতু পত্রিকা এবং তার আড্ডার খানিকটা সরস বর্ণনা পাওয়া যায় খান মুহম্মদ মঈনুদ্দীন এর লেখায় – “অল্প সময়ের মধ্যে এমন জনপ্রিয় কবিও দেখা যায় নি, এমন জনপ্রিয় কাগজও বাঙলাদেশে ধূমকেতুর আবির্ভাব অপ্রত্যাশিত, স্বল্পায়ু কিন্তু অবিস্মরণীয়। এর অফিস ছিল কোলকাতা, মেডিকেল কলেজের পূর্ব দিকে– ৭নং প্রতাপ চাটুর্যে লেনে। সেখানে সন্ধ্যার পরে বসতো যতো ‘লক্ষ্মী ছাড়ার আড্ডা‘। সেখানে যে কি হতো , আর কি হতো না, তা যারা না দেখেছেন, তাদের বলে বোঝানো যাবে না। ধূমকেতুর ধূমায়িত আস্তানায় সকল লক্ষ্মীছাড়ার মধ্যমণি হয়ে বসেছেন নজরুল। সে–কী উদ্দামতা, সে কী প্রাণ চাঞ্চল্য, সে কী হাসির উচ্ছ্বসিত হুল্লোড়! ( যুগ স্রষ্টা নজরুল, পৃ. ৩৩)
ধূমকেতু পত্রিকাতে কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর সাংবাদিকতার মাধ্যমে সত্য ও সাহসী উক্তি করেছেন নিজের সম্ভাব্য ব্যক্তিগত ক্ষতির কথা আদৌ না ভেবে। তাঁর সাহিত্য ধর্মী সাংবাদিকতায় নগরকেন্দ্রিক সমাজ জীবন থেকে শুরু করে বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামের অধিবাসীদের অভাব অভিযোগ, দাবি প্রত্যাশা সবই তুলে ধরার চেষ্টা করতেন। কবিতার পাশাপাশি কাজী নজরুল ইসলাম ধূমকেতু পত্রিকায় অনেক প্রবন্ধ লেখেন। প্রবন্ধগুলির বেশীরভাগই ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদে উজ্জীবিত করে লেখা। কবি নজরুলকে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হলে ১৯২৩ সালের ২৭ জানুয়ারি ধূমকেতু পত্রিকায় লেখা হয়: “ ধূমকেতুর সারথ, প্রতিষ্ঠাতা, উদ্দাম উন্মাদ শ্রীমান কাজি নজরুল ইসলাম বুরোক্রেসীয় ব্যবস্থায় রাজদ্রোহ অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে এক বছরের জন্যে কঠিন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন। কাজি নজরুল সম্বন্ধে অন্য সংবাদপত্রে কিছু কিছু সংবাদ বেরিয়েছে কিন্তু আমরা তার মোকদ্দমার ব্যস্ত থাকায় ধূমকেতু বার কর্ত্তে না পারায় বিশেষত: মোকদ্দমার ফলাফল না জানা পর্য্যন্ত কিছু বলা সঙ্গত নয় বিবেচনা করে বিশেষ কোনো কথা বলি নি। আজ কয়েক দিনের অদর্শনের পর মেঘ, বাদল, বজ্র ফুড়ে ধূমকেতু আবার আপনাদের সামনে উদয় হল শুধু তারি কথাই নিয়ে।”
অনুরূপভাবে প্রেসিডেন্সি জেল থেকে লেখা রাজবন্দীর জবানবন্দীতে কবি ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধের বক্তব্যকে ( যাকে রাজশক্তি রাজদ্রোহ বলে আখ্যায়িত করেছিল ) ভগবানের বাণী হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি নির্দ্বিধায় বলেছেন, “আমার বাণী সত্যের প্রবেশিকা, ভগবানের বাণী। সে বাণী রাজবিচারে রাজদ্রোহী হতে পারে; কিন্তু ন্যায়বিচারে সে বাণী ন্যায়দ্রোহী নয়, সত্যদ্রোহী নয়। সে বাণী রাজবিচারে দণ্ডিত হতে পারে; কিন্তু ধর্মের আলোকে, ন্যায়ের দুয়ারে তা নিরপরাধ, নিষ্কলুষ, অম্লান, অনির্বাণ সত্যস্বরূপী।” কবির এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশবিরোধী অকুতোভয় চেতনার সম্যক পরিচয় প্রতিভাত হয়েছে। এ বক্তব্য তার আপসহীনতার পরিচায়ক। কবি ছিলেন সত্যের পূজারি। প্রকৃতপক্ষে কবি কাজি নজরুলকে চিনলে ধূমকেতুকে চেনা যায়। ধূমকেতুর জন্ম কি জন্য তা ধূমকেতুর প্রথম সংখ্যাতেই বলা হয়েছে, নজরুলের জীবন ঠিক তারই অনুরূপ করে বিধাতা গড়ে দিয়েছেন।
পরিশেষে, শতবর্ষ পরেও ধূমকেতুর মূল্যায়নে বলা যায় উন্নতমানের গল্প, কবিতা, আলোচনা, সম্পাদকীয় নিবন্ধ সব মিলিয়ে ধূমকেতু একটি বিশিষ্ট পত্রিকা হিসেবে পরিগণিত হত। পাঁচমিশেলী লেখার মাধ্যমে ধূমকেতু ওই সময়ে হিন্দু–মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মেল বন্ধন ঘটাতে চেয়েছিল। শৃঙ্খলিত সমাজকে তিনি শৃঙ্খলমুক্ত করতে চেয়েছিলেন তাঁর ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে। ধূমকেতু ছিল সেই লেখার বাহক। ফলে উপনিবেশিক শাসনামলে বাংলার সংবাদপত্রের ইতিহাসে ধূমকেতু এক উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকার করে আছে। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের ক্ষেত্রেই শুধু নয় ক্রমান্বয়ে এই পত্রিকাটি ভারতীয় জাতীয়তাবাদের মুখপত্রে পরিণত হয়। ধূমকেতু পত্রিকা স্বল্পকালীন সময়ের জন্য প্রকাশিত হলেও বাঙালী জনসাধারণের মনে গভীর রেখাপাত সৃষ্টি করে । কবির সম্পাদিত ধূমকেতু পত্রিকায় যে নিরপেক্ষ স্বদেশ প্রেমের চিন্তাভাবনা পাওয়া যায় তা আধুনিক কালের সংবাদপত্রের ক্ষেত্রেও পাওয়া দুষ্কর।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক; প্রফেসর, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়