কন্টেনার হ্যান্ডলিং এর সক্ষমতা বাড়াতে বন্দর কর্তৃপক্ষের উদ্যোগ

হাসান আকবর | বুধবার , ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ at ৮:২৬ পূর্বাহ্ণ

বিশ্বের একশ’ ব্যস্ততম কন্টেনার হ্যান্ডলিংকারী বন্দরের তালিকায় ২০২০ সালে চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থান ছিল ৫৮তম স্থানে। পরের দুয়েক বছরের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরকে লয়েড’স লিস্টের ৫০তম স্থানে নিয়ে আসার একটি স্বপ্ন নিয়ে কাজ করছিল চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। কিন্তু করোনার ধাক্কা টানা সাত বছর ক্রমান্বয়ে অগ্রসর হওয়া চট্টগ্রাম বন্দরকে ওই বছরই হুট করে ৯ ধাপ পিছিয়ে দেয়। যার ধাক্কা সামলে সামনে এগুনোর ক্ষেত্রে এখনো হিমশিম খাচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর। করোনার সেই ধাক্কা কাটিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরকে ৫০তম স্থানে নিয়ে আসার নিরলস এক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থান ৬৭তম স্থানে। বন্দরের অবকাঠামোগত সুবিধা বাড়ানোর পাশাপাশি ব্যবসাবান্ধব বন্দর হিসেবে বন্দরের সুনাম ধরে রাখতেও সচেষ্ট বন্দর কর্তৃপক্ষ। এরই ধারাবাহিকতায় জাহাজের অবস্থানকাল কমিয়ে আনাসহ বিভিন্নমুখী সুযোগ সুবিধা বাড়ানো হচ্ছে।

চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজের অবস্থানকাল অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় কমে গেছে। দুই থেকে আড়াই হাজার কন্টেনার নিয়ে আসা একটি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর করার মাত্র আড়াই থেকে তিন দিনের মধ্যে ফিরতি পথে যাত্রা করার দৃশ্য এখন প্রায় প্রাত্যহিক। আড়াই হাজারের বেশি কন্টেনার নিয়েও জাহাজ ভিড়ছে বন্দরে এবং যথারীতি কন্টেনার খালাস করে ফিরতি পথ ধরছে। বন্দরের ইকুইপমেন্ট বৃদ্ধি, ইয়ার্ড বৃদ্ধি, কন্টেনার ধারণক্ষমতা বৃদ্ধিসহ নানামুখী অবকাঠামোগত উন্নয়নের সুফল মিলছে বন্দরে। এই যে আড়াই থেকে তিনদিনের মধ্যে জাহাজের ফিরতি পথ ধরা যে কত স্বস্তির, জাহাজের টার্ণ এ্যারাউন্ড টাইম ২.৫ দিনে নেমে আসা যে কত আনন্দের তা শুধু দেশের আমদানি রপ্তানি বাণিজ্যের সাথে জড়িতরাই বুঝতে পারেন। ব্যবসায়ী নেতারা বলেছেন, কন্টেনার কিংবা খোলা পণ্য নিয়ে আসা একটি জাহাজ যখন অলস বসে থাকে তখন আমদানিকারকের ঘুম হারাম হয়ে যায়। অলস বসে থাকা জাহাজ আর হাতির মধ্যে কোন পার্থক্য নেই বলে মন্তব্য করে একজন ব্যবসায়ী নেতা বলেন, মাঝারী আকৃতির একটি জাহাজও যদি একদিন অলস বসে থাকে সংশ্লিষ্ট আমদানিকারকের বিশ থেকে ত্রিশ হাজার ডলার গচ্ছা যায়। এটি প্রতিদিনকার হিসেবে। শুক্র শনিবার বলে কিছু নেই। জাহাজ বসে থাকবে, ভাড়া কিংবা ফিক্সড অপারেটিং কস্ট বা এফওসি বাবদ ক্ষতিপূরণ যোগাতে হবে। এই টাকা যোগাতে হয় ডলারে। ভয়াবহ রকমের ডলার ক্রাইসিসে থাকার নাজুক পরিস্থিতিতে অনাহুত ডলার গচ্ছা দিতে গিয়ে ব্যবসায়ী শিল্পপতিরা চোখে সর্যে ফুল দেখেন। তবে চট্টগ্রাম বন্দর সেই দুঃসহ পরিস্থিতি সামলে উঠেছে বছর কয়েক ধরে। কথায় কথায় বন্দর বন্ধ হওয়া বা ভয়াবহ রকমের জটের অবস্থা এখন আর নেই। দশপণের দিন ধরে জাহাজের অলস বসে থাকার পরিস্থিতিও এখন আর নেই। বছর কয়েক আগেও চট্টগ্রাম বন্দরের নাম শুনলে বিদেশী জাহাজ মালিকেরা জাহাজ পাঠাতে রাজি হতেন না, বর্ধিত ভাড়া হাকতেন। বিদেশী জাহাজ মালিকদের সংগঠনের পক্ষ থেকে কনজেশন সারচার্জ আরোপ হতো যখন তখন, চট্টগ্রাম বন্দরের উপর এই চার্জ আরোপের হুমকি ঝুলে থাকতো। নানামুখী উন্নয়নের ফলে ওই সব এখন রূপকথার মতো হয়ে গেছে বলেও বন্দরের শীর্ষ কর্মকর্তারা মন্তব্য করেছেন।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, জাহাজের অবস্থানকাল কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে বহুল আলোচিত ওয়ান ইলেভেনের সংস্কার কার্যক্রম যাদুকরি ভূমিকা রেখেছে। ওয়ান ইলেভেন নিয়ে যেখানে যত বিতর্ক থাকুক না কেন, যত ধরনের প্রশ্নই উঠুক না কেন একটি ব্যাপার সকলকেই একবাক্যে মানতে হবে যে চিরচেনা চট্টগ্রাম বন্দরকে আমুল পাল্টে দেয়ার জন্য ওয়ান ইলেভেন অনন্য ভূমিকা রেখেছে। ওই সংস্কার কার্যক্রমের সাথে অবকাঠামোগত উন্নয়নের ফলে জাহাজের অবস্থানকাল ২.৫০ দিনে নেমে আসে। পতেঙ্গা কন্টেনার টার্মিনাল (পিসিটি) পুরোদমে অপারেশন শুরু হলে এবং বে টার্মিনাল নির্মিত হলে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজের অবস্থানকাল আরো কমে যাবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে।

দেশের আমদানি রপ্তানি বাণিজ্যের প্রবেশদ্বার চট্টগ্রাম বন্দর। দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রায় ৯০ শতাংশই এই বন্দরের মাধ্যমেই পরিচালিত হয়। কর্ণফুলী নদীর পাড়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে দুই হাজার একরেরও বেশি ভূমি রয়েছে। পতেঙ্গার মোহনা থেকে উজানে ৯ কিলোমিটার চ্যানেলে জাহাজ চলাচল করে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের ১৩টি সাধারণ বার্থ, চিটাগাং কন্টেনার টার্মিনাল (সিসিটি) ৩টি জেটি, নিউমুরিং কন্টেনার টার্মিনালে ৫টি জেটি, ২টি ডলফিন জেটি, এবং ৬টি রিভার মুরিং জেটি মিলে বন্দরে একই সাথে ৩২/৩৩টি জাহাজ বার্থিং দেয়া যায়। চট্টগ্রাম বন্দরের ১৭টি মুল জেটির মধ্যে ১ নম্বর জেটি এখন আর কোন কাজ করেনা। অপরদিকে ১২ নম্বর জেটিতেও জাহাজ ভিড়ানো কঠিন হয়ে উঠে। বর্তমানে সিটিটি এবং এনসিটি মিলে মোট ১৬টি জেটিতে হরদম জাহাজ ভিড়ানো চলে। এরমধ্যে জেনারেল জেটির মধ্যে ৪টি, সিসিটির ২টি এবং এনসিটির ৪টি মিলে ১০টি জেটিতে কন্টেনার জাহাজ ভিড়ানো হয়। মাঝেমধ্যে চাপ বেশি থাকলে জেনারেল কার্গো বার্থের মধ্যে কন্টেনার জাহাজের জন্য একটি জেটি বাড়িয়ে দেয়া হয়। এনসিটি ১ নম্বর জেটিতে শুধুমাত্র পানগাঁও টার্মিনালের জাহাজ ভিড়ানো হয়। চট্টগ্রাম বন্দরের সিসিটি এবং এনসিটির সবগুলো জেটিতে কী গ্যান্ট্রি ক্রেন রয়েছে। বাকি জেটিগুলোতে শোর হ্যান্ডলিং ক্রেন দিয়ে কার্গো এবং কন্টেনার হ্যান্ডলিং করা হয়।

চট্টগ্রাম বন্দরে বর্তমানে সর্বোচ্চ ২০০ মিটার লম্বা এবং ১০ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়ানো হয়। তবে গুপ্তাখাল বাঁকের জন্য সিসিটি এবং এনসিটিসহ জেনারেল কার্গো বার্থে ২০০ মিটার জাহাজ আনতে ড্রাফট ৯ মিটার নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে জাহাজের ল্যান্থ ১৯০ মিটার হলে তখন ১০ মিটার ড্রাফটের জাহাজ নিয়ে আসা হয়। ল্যান্থ ১৯৫ মিটার হলে ড্রাফট ৯.৫ মিটারের জাহাজ ভিড়ানো হয়।

চট্টগ্রাম বন্দরে বিগত অর্থবছরে ৩০ লাখ ৭ হাজার ৩৪৪ টিইইউএস কন্টেনার হ্যান্ডলিং হয়েছে। যা আগের অর্থ বছরের চেয়ে ২ লাখ ৪৮ হাজার ১৪ টিইইউএস কম। ২০২১২০২২ অর্থ বছরে কন্টেনার হ্যান্ডলিং হয়েছিল ৩২ লাখ ৫৫ হাজার ৩৫৮ টিইইউএস। বিগত অর্থবছরে বন্দরে কার্গো হ্যান্ডলিং হয়েছে ১১ কোটি ৮২ লাখ ৯৬ হাজার ৭৪৩ টন। যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ১লাখ ২২ হাজার ৫৮৩ টন বেশি। ২০২১২০২২ অর্থ বছরে ১১ কোটি ৮১ লাখ ৭৪ হাজার ১৬০ টন খোলা পণ্য হ্যান্ডলিং হয়েছিল। বিগত অর্থ বছরে বন্দরে মোট ৪ হাজার ২৫৩টি জাহাজ কন্টেনার ও খোলা পণ্য নিয়ে এসেছে। আগের অর্থ বছরে এ সংখ্যা ছিল ৪ হাজার ২৩১টি।

চলতি অর্থবছরে কন্টেনার হ্যান্ডলিং এর পরিমান বেশ বৃদ্ধি পাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করে বলা হয়েছে, করোনাকালের ধাক্কার পর বৈশ্বিক সংকট এবং রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের নাজুক পরিস্থিতির শিকার হয় বন্দর। চলতি বছর সকল প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে অনেকটা স্বাভাবিক কার্যক্রম চলছে। বছর শেষে এর সুফল মিলবে বলে মন্তব্য করে বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মোহাম্মদ ওমর ফারুক বলেন, সবকিছু ঠিকঠাকভাবে এগুলে চট্টগ্রাম বন্দর আবারো লয়েড’স লিস্টে একটি ভালো অবস্থানে চলে যাবে। এখন বন্দর কর্তৃপক্ষ সেই লক্ষ্য অর্জনে কাজ করছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী

পূর্ববর্তী নিবন্ধ
পরবর্তী নিবন্ধছিপাতলী দরবারে জশনে জুলুস কাল