চট্টগ্রামের শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির ধারা

ড. নারায়ন বৈদ্য | সোমবার , ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৭:১৫ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামকে বলা হয়ে থাকে ‘প্রাচ্যের রাণী’। পাহাড়, সমুদ্র, উপত্যকা, অরণ্য প্রভৃতি নৈসর্গিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে এই চট্টগ্রাম পরিণত হয়েছে প্রাকৃতিক লীলা নিকেতনে। স্মরণাতীতকাল থেকে এর অসম ভৌগলিক অবস্থান ও পরিবেশ বহিবিশ্বের মানুষকে এখানে বসতি স্থাপনে আকৃষ্ট করেছে। এক জরিপে দেখা যায়, চট্টগ্রামের আয়তন ২,০৩৯ বর্গমাইল। চট্টগ্রাম মহানগরীর আয়তন ৯৮৬.৩৪ বর্গ কিলোমিটার। ১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দে মোঘলেরা আরাকানিদের হটিয়ে এই এলাকা দখল করে নিয়ে নাম রাখে ইসলামাবাদ। মোঘলদের আগে এখানের কোনো প্রশাসনিক কাঠামো কিংবা কোনো স্থায়ী সীমা ছিল না। ১৭৬০ খ্রিষ্টাব্দে মীর কাশেম আলী খানের কাছ থেকে এ অঞ্চলটি অধিগ্রহণ করে ব্রিটিশরা। তারাই এ অঞ্চলের নামকরণ করে চিটাগাং। তবে এ বিষয়ে অনেক মতামত পাওয়া যায়।
বৌদ্ধ পণ্ডিতদের মতে, চট্টগ্রাম নামটা চৈত দেয়াং বা চৈত গ্রাম শব্দের অপভ্রংশ। চৈত গ্রাম অর্থ বৌদ্ধ কীর্তিস্তম্ভের আবাসস্থল। এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা স্যার উইলিয়াম জোন্‌স মনে করেন, এ অঞ্চলের সবচেয়ে সুন্দর ক্ষুদে পাখি চট্‌গা থেকে চট্টগ্রাম নামের উৎপত্তি। ঐতিহ্যগতভাবে চট্টগ্রাম ছিল শিক্ষা গ্রহণের পাদভূমি। ইংরেজ শাসন এ অঞ্চলে পাকাপোক্ত হবার আগে এখানকার শিক্ষা ছিল তিনটি ধারা ভিত্তিক। মুসলমানদের জন্য ছিল মক্তব-মাদ্রাসা। হিন্দুদের জন্য ছিল পাঠশালা-টোল-চতুষ্পাঠী এবং বৌদ্ধদের জন্য ছিল কেয়াং বা বিহার। এসব বিদ্যায়তনে শিক্ষার্থীরা যেসব বই ব্যবহার করত সেগুলি ছিল হাতে লিখা বই অথবা পুথি। ইংরেজরা চট্টগ্রাম অঞ্চল দখলে নেয়ার পরও বহু বছর এ অঞ্চলে শিক্ষা বিস্তারের জন্য কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। ১৮১৩ খ্রিষ্টাব্দের পর থেকে শাসকগোষ্ঠী তাদের শাসন ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করার জন্য শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন আনার প্রয়োজন অনুভব করে। ১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় মিউনিসিপ্যাল হাই স্কুল। ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে ‘চিটাগাং ইংলিশ স্কুল’ ও ‘হাজারী স্কুল’ নামে দুইটি মধ্য ইংরেজী স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথমটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন শেখ-এ-চাটগাম-কাজেম আলী। ‘চিটাগাং ইংলিশ স্কুল’ ১৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দে উচ্চ ইংরেজী উচ্চ বিদ্যালয়ে উন্নীত হয়। এরপর ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত চট্টগ্রাম শহরে আর কোনো উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
১৮৬৯ খ্রিষ্টাব্দে সরকারি উদ্যোগে চট্টগ্রাম কলেজ স্থাপিত হয়। পরবর্তীতে ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত চট্টগ্রামে কলেজ ছিল তিনটি। এর মধ্যে একটি ছিল ইন্টারমিডিয়েট কলেজ। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের পূর্বে চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিজ্ঞানসম্মত বাণিজ্যিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু ছিল না। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে দেশ বিভাগের পর কলকাতার গভর্নমেন্ট কমার্শিয়াল ইনস্টিটিউট-এর এক চতুর্থাংশ অস্থায়ী সম্পদ নিয়ে আগষ্ট মাসের শেষ সপ্তাহে বর্তমান জেনারেল পোস্ট অফিসের সামনে শুকতারা বোর্ডিং-এ সরকারি বাণিজ্য কলেজ (বর্তমানে যা সরকারি কমার্স কলেজ) স্থাপন করা হয়। ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে এ কলেজ নাহার বিল্ডিং এ স্থানান্তর করা হয়। ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে কলেজটি নিজস্ব ভবনে পাঠদান শুরু করে। আবার ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ৬ আগষ্ট চট্টগ্রামে ‘চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ’ চালু হয়। ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার জন্য চেষ্টা চলে। অবশেষে ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দে ২৯ আগষ্ট চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য্য ছিলেন প্রফেসর আজিজুর রহমান মল্লিক। বিশ্ববিদ্যালয়টি চট্টগ্রাম শহর থেকে ২২ কিলোমিটার উত্তরে হাটহাজারী থানায় ফতেপুর মৌজায় ১৩৩০ একর জায়গাজুড়ে অবস্থিত। ড. হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে নেপালের রাজদরবার থেকে তেইশ জন বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যের যে ছেচল্লিশটি চর্যা আবিষ্কার করেছিলেন তা-ই বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগের একমাত্র সাহিত্য হিসেবে স্বীকৃত। আঠার শতকের প্রথমার্ধের আগে চট্টগ্রাম থেকে যেখানে পঞ্চাশজন কাব্য-কবিতা রচয়িতার সন্ধান পাওয়া গেছে সেখানে নোয়াখালীতে পাওয়া গেছে একজন আর কুমিল্লায় পাওয়া গেছে তিনজন। এ থেকে বুঝা যায় চট্টগ্রাম বহু পূর্ব থেকেই সাহিত্য সাধনায় অগ্রগামী ছিল। সাহিত্য সাধনায় নিয়োজিত কবি-সাহিত্যিকরা হলো- কবি নবীন চন্দ্র সেন, শশাঙ্কমোহন সেন, জীবেন্দ্র কুমার দত্ত, হেমন্ত বালা দত্ত, ক্ষেমেশ রক্ষিত, অন্নদাশংকর রায়, বিপিন চন্দ্র নন্দী, বসন্ত কুমার কানুনগো, দিদারুল আলম, ওহীদুল আলম, উমরতুল ফজল, ড. মুহম্মদ এনামুল হক, শেখ মোজাফফর আহমদ, নূর আহমদ সাহিত্যরত্ন, লোকমান খান শেরওয়ানী ও শবনম খান শেরওয়ানী প্রমুখ। সমসাময়িক কালে চট্টগ্রামের কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে সুচরিত চৌধুরী, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, আবুল ফজল, ড. আহমদ শরীফ, আবদুল হক চৌধুরী উল্লেখযোগ্য। ছড়া সাহিত্যের পাশাপাশি চট্টগ্রামে কিশোর কবিতার উৎকর্ষ সাধন হয়েছে অধিক। কিশোর কবিতা রচনায় পারঙ্গমতা প্রদর্শন করেছেন- সুজন বড়ুয়া, রাশেদ রউফ, উৎপলকান্তি বড়ুয়া, আজিজ রাহমান, রহীম শাহ, অপু বড়ুয়া, বিপুল বড়ুয়া প্রমুখ। ওমর কায়সার, অজয় দাশগুপ্ত ও উত্তম সেনের সম্পাদনায় কিশোর কবিতা সংকলন ‘ওগো আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে’- অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। পরবর্তীতে প্রকাশিত সংকলনগুলোর মধ্যে সুজন বড়ুয়ার ‘জুঁই চামেলী ফুলের বোটা’-এর নাম উল্লেখযোগ্য। আরো উল্লেখযোগ্য একক কিশোর কবিতাগ্রন্থ রাশেদ রউফের ‘আকাশের ঠিকানায় সূর্যের সীমানায়’।
উপমহাদেশের অন্যান্য জায়গার মতো চট্টগ্রামের জীবন ও সংস্কৃতি ছিল গ্রামীণ। বিভিন্ন সময়ে এ চট্টগ্রামে বিখ্যাত কবি সাহিত্যিকদের আগমন ঘটে। ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের আগমন ঘটে এ চট্টগ্রামে। রবীন্দ্রনাথের চট্টগ্রাম আগমনের ৪ বছর পর চট্টগ্রামে সাহিত্য পরিষদ গঠিত হয়। ‘চট্টল সাহিত্য পরিষদ’- চট্টগ্রামের সাহিত্য চর্চার ধারাকে বেগবান করেছে। চট্টগ্রামে যখন থেকে জনবসতি শুরু হয়েছিল তখন থেকে আজ পর্যন্ত লোকসংগীত চট্টগ্রামের লোকজনের ভূষণ হয়ে রয়েছে। চট্টগ্রামের লোকসংগীত বাংলার লোকসংগীতকে সমৃদ্ধ করেছে। গাজীর গান, হালদাফাটা গান, হঁঅলা, হাইল্যা সাইর, পাইন্যা সাইর, পালাগান বা গীতিকা, মাইজভাণ্ডারী, শিব-গৌরীর গান, উল্টা বাউলের গান, কানুফকিরের গান, ফুলপাট গান, ওলশা মাছের গান চট্টগ্রামের একান্ত নিজস্ব সম্পদ। সাংস্কৃতিক অঙ্গণে এখনো চট্টগ্রামের শিল্পী শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব-শেফালী ঘোষের গান সমাধিক জনপ্রিয়। চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে এখনো ঢোল, জোড় খাই, দবর, সানাই, ঢাক, দোতারা, একতারা ব্যবহৃত হয়। চট্টগ্রামের শিল্পী বিনয় বাঁশী একজন শ্রেষ্ঠ ঢোল বাদক ছিলেন। আর চট্টগ্রামের লোকসংগীত গায়কদের মধ্যে লক্ষীপদ আচার্য, শাক্যমিত্র বড়ুয়া, আবদুল গফুর হালী, কল্পনা লালা, কল্যাণী ঘোষ, আবদুর রহিম প্রমুখ ছিল অগ্রগণ্য।
চট্টগ্রামকে কৃষি প্রধান বাংলাদেশের বাণিজ্যিক রাজধানী বলা যায়। বাংলাদেশে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল জুড়ে রয়েছে অর্ধ লক্ষাধিক গ্রাম। শীতল স্নিগ্ধ, শান্ত- নিজস্ব সামাজিক অনন্যতা নিয়ে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের এক একটি গ্রাম। বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় অর্থনীতিতে চট্টগ্রাম অঞ্চলের ভূমিকা অধিক। প্রাকৃতিক নিয়মে মাছের ডিম প্রজননের ক্ষেত্রটি হয় চট্টগ্রামে। চট্টগ্রাম শহরের অদূরবর্তী হালদা নদীর উৎসমুখ থেকে মদুনাঘাট পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকাটি প্রাকৃতিক উপায়ে মিষ্টি পানির মৎস্য প্রজননের প্রধান ক্ষেত্র।
ব্যাংকিং কর্মকাণ্ড অর্থনৈতিক লেনদেনের গতিশীলতাকে বৃদ্ধি করে। ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রামে কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাংক, ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে সন্দ্বীপ কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাংক এবং শহর ও শহরতলীতে বেশকিছু আরবান ব্যাংক গড়ে উঠে। ষাটের দশকে যে কয়জন বাঙালি উদ্যোক্তা ও শিল্পপতি অর্থনীতিতে অবদান রেখেছিল তাঁদের মধ্যে এ. কে. খান, মীর্জা আবু ও এম আর সিদ্দিকী ছিলেন চট্টগ্রামের বাসিন্দা। বর্তমানে এস আলম গ্রুপ, সানোয়ারা গ্রুপ, এনজিএস গ্রুপ, টিকে গ্রুপ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখছে। এরা চট্টগ্রাম অঞ্চলের বাসিন্দা।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের আমদানি ও রপ্তানি নিয়ন্ত্রকের দপ্তর, রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজের অফিস, হজ অফিস ছিল চট্টগ্রামেই। বাণিজ্য ও শিল্প কারখানা ক্রমশ বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে উঠে বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড। কর্ণফুলি নদীর তলদেশ দিয়ে ট্যানেল নির্মিত হচ্ছে যার কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। এ অবস্থায় চট্টগ্রাম হয়ে উঠবে সমগ্র বাংলাদেশের প্রাণশক্তি। চট্টগ্রামের শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি ছিল এ দেশের সমগ্র অঞ্চলের তুলনায় অগ্রগামী। আর বাংলাদেশের সমগ্র অর্থনীতিকে দ্রুত উন্নয়নের সহায়তা করছে চট্টগ্রাম।

লেখক: প্রাবন্ধিক; পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধগ্রন্থের উদ্ভব ও বিকাশ : একটি পর্যালোচনা
পরবর্তী নিবন্ধস্বাধীনতার আজাদী ও স্বাধীন-আশার আজাদী