নামেই যার মুক্তি – তাকে আবদ্ধ করার শক্তি কোথায়?

অজয় দাশগুপ্ত | সোমবার , ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৭:১৬ পূর্বাহ্ণ

আজাদী প্রমাণ করেছে মুদ্রণ শিল্প বা মুদ্রিত সংবাদপত্রের ভবিষ্যত সংকটাপন্ন মনে হলেও তার সম্ভাবনা অফুরন্ত। জাতীয় দৈনিক নামে পরিচিত ঢাকার সংবাদপত্রগুলো কতটা চালু বা কার কত সার্কুলেশান সেটা অজানা কিছু নয়। সেসব তথ্যে না গিয়েও বলা যায় দু তিনটি পত্রিকা বাদ দিলে বাকী সবগুলোর প্রচার সংখ্যা আজাদীর চাইতে কম। আজাদীর এই অভূতপূর্ব পাঠকপ্রিয়তা কোনো হঠাৎ ঘটনা কিংবা সাময়িক কিছু না। দীর্ঘ সময় ধরে এই প্রিয়তা বজায় রাখার কঠিন কাজটি করে চলেছে দৈনিক আজাদী।
আজাদীর ছাপা বা মুদ্রণ শৈলী যে এর অন্যতম আকর্ষণ না এটা সবাই মানেন। বরং চট্টগ্রামেই আজাদীকে পিছিয়ে দেয়ার প্রতিযোগিতায় বর্ণিল দৈনিক দেখেছি আমরা। কালস্রোতে একটিও টেকে নি। আমি মনে করি এই বিষয়টি ভাবীকালের সংবাদপত্র গবেষকদের জন্য কৌতুহল ও দরকারী একটা বিষয় হতে পারে। আমি যখন আজাদীর সাথে লেখা ও মননে যুক্ত হয়েছিলাম তখন এর ছাপার মান নিয়ে কতো প্রশ্ন। কতো তির্যক কথাবার্তা। কোনো কিছুই গায়ে মাখে নি আজাদী। যার মূল কারণ এর সম্পাদক ছিলেন সৌম্য দর্শন শান্ত স্বভাবের অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ। রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাপুষ্ট ভদ্রলোক ছিলেন ভেতরে শক্ত ও স্থির। তিনি জানতেন কী করছেন, কেন করছেন। বার্তা বিভাগে সাধন ধরের মতো প্রবীণ মানুষ, সাহিত্যে অরুণ দাশগুপ্ত সাংবাদিকতায় ওবায়দুল হক, মোহাম্মদ ইউসুফ, সিদ্দিক ভাইরা ছিলেন এক একজন ভ্যানগার্ড। এর সাথে যুক্ত হয়েছেন পর্যায়ক্রমে প্রদীপ দেওয়ানজীরা। বিশেষত তখনকার তরুণ লেখক সংগঠক রাশেদ রউফের অন্তর্ভুক্তি ছিল সুদূরপ্রসারী পরিবর্তনের সূচনালগ্ন। যার প্রভাব ও ফল এখন দৃশ্যমান। বলাবাহুল্য নেপথ্যচারী সম্পাদক প্রকাশক জনাব আবদুল মালেক না থাকলে এসব কোনো কিছুই হতে পারতো না ।
সে আজাদী আজ এমন এক শক্ত খুঁটির ওপর দাঁড়িয়ে যে করোনার মতো অতিমারী বহু সংবাদপত্রের মৃত্যু বা অকাল প্রয়াণ ঘটালেও আজাদীকে দমাতে পারে নি। এ এক আশ্চর্য বিষয়, চট্টগ্রাম, বৃহত্তর চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি বিস্তৃত এলাকায় এই সংবাদপত্র ছাড়া যেমন দিন শুরু হয় না তেমনি মধ্যপ্রাচ্য সহ দুনিয়ার নানা দেশের বাঙালির দিন শুরু হয় ই আজাদীর পাতা খুলে। সিডনিতে আমার মতো অনেকেই আছেন যারা আজাদী না পড়ে ঘুমাতে যান না। এই জনপ্রিয়তার জন্য সবাই চেষ্টা করলেও একমাত্র আজাদীই তা ধরে রেখেছে। আমি মনে করি কেবল সৌকর্য্য সজ্জা আর শিল্পবোধ যদি কোনো দৈনিকের উপাদান হতো তাহলে বাংলাদেশে শিল্পমানের সাময়িকীগুলোই বাজারে হট কেকের মতো বিকাতো। মানুষ আসলে কী চায় বা কী তাদের ইচ্ছা সে বিষয়টি আজাদী ধরতে পেরেছে বলেই আজ পর্যন্ত তার অগ্রযাত্রা অব্যহত আছে।
সময় মানুষ আর তার বোধ এই তিন জরুরি বিষয় যারা ধারণ করে তারাই সময়কে ছাপিয়ে টিকে থাকে। দৈনিক পত্রিকার কাজ না গুজব ছড়ানো না নেতিবাচক খবর দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করা। চটকদারী নিউজ করে সাময়িকভাবে বিভ্রান্ত করা গেলেও আখেরে তাতে বিশ্বাস নষ্ট ছাড়া আর কোনো লাভ নেই। আমি দেখেছি বিশেষত চট্টগ্রামের যে কোনো বিতর্কিত বিষয়ে মানুষ শেষ কথাটি বা আসল ঘটনা জানার জন্য আজাদীতে চোখ বুলিয়ে নেয়। এর নাম বিশ্বাস এর নাম আস্থা।
বাংলাদেশের এই প্রবীণ স্বাধীনতা পরবর্তী দেশে প্রথম মুদ্রিত সংবাদপত্রের দায়িত্ব ও তাই অধিক। রাজনৈতিক অচলায়তন, সামাজিক অপরাধ, নৈতিক পতনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আজাদী আরো কঠিন এবং গঠনমূলক আলোচনা সহ খবর নিয়ে কাজ করলে মানুষ উপকৃত হবে। যা সরকার বিরোধী দল এমন কি জনগণের জন্যও হবে দরকারী। আয়না বা দর্পণ বলে যে কথাটা তার কাজ আজাদী করে আর যতো তা আয়না হয়ে উঠবে ততোই মানুষ তাতে চোখ রাখবে। দেখে নেবে নিজের ও সমাজের প্রতিবিম্ব। ‘সুখে দুখে ফেইসবুকে’ নামে যে অংশটি তাতে এসব বিষয় যুক্ত হলে আরো গতি লাভ করবে। ভেবে দেখার অনুরোধ জানাই।
শেষ করার আগে একটা অনুরোধ জানাবো। দেশের আয় দেশের ব্যবসা বাণিজ্য সহ নানা উন্নয়নে চট্টগ্রামের অবদান শীর্ষে। চট্টগ্রাম দেশ বা বাকী সবাইকে যা দেয় যতো দেয় তার বিনিময়ে প্রাপ্তি নেহায়েত কম। আমরা কোনো খাতির বা অন্যায্য চাওয়ার কথা বলছি না। আজ অবদি আমরা কোনো রাষ্ট্রপতি, স্পীকার পাই নি। আমাদের শহরের জলাবদ্ধতা পাহাড় কাটা সহ নানা সমস্যায় দেশের মনোযোগ নিয়ে তর্ক আছে। এই বিষয়গুলো আজাদীর মাধ্যমে ব্যাপকভাবে সাড়া ফেলতে পারে। পুরো দেশ ও চট্টগ্রামকে একসাথে গ্রন্থিত করার উপযুক্ত মাধ্যম এই আজাদী একাধিকবার লিখেছি। আমার সৌভাগ্য আমি বহু বছর থেকে এর সাথে যুক্ত আছি। এর ভালো মন্দ এগিয়ে চলা থমকে দাঁড়ানোর সময়কাল দেখেছি আমি।
নিঃসন্দেহে বলতে পারি, প্রতিযোগিতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা আর পলিটিক্স এই তিনটি বিষয় মোকাবেলা করেই আজ এই অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে গৌরবের আজাদী। নামেই যার মুক্তি তাকে আবদ্ধ করার শক্তি কোথায়? চট্টগ্রাম তথা দেশের সংবাদপত্র জগতের মহীরুহ আজাদীর জন্মদিনে সিডনি তথা অষ্ট্রেলিয়ার ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা। আমার সমান বয়সী এই দৈনিকের শতায়ু কামনা করি। আশা করি অনন্ত সময় ধরে লেখক পাঠক আর শুভানুধ্যায়ি জন্ম দেয়া দৈনিকটি চলবে জনগণের ভালোবাসায়। জয়তু আজাদী।

লেখক: সিডনি প্রবাসী প্রাবন্ধিক, ছড়াশিল্পী,
কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্বাধীনতার আজাদী ও স্বাধীন-আশার আজাদী
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রাম অঞ্চলের লোকখাদ্য