সৈকতের বঙ্গবন্ধু

শিবুকান্তি দাশ

| বুধবার , ২৪ আগস্ট, ২০২২ at ৫:৪৭ পূর্বাহ্ণ

বঙ্গবন্ধুর ছবি। সৈকতদের ঘরে বড়ো একটা বঙ্গবন্ধুর ছবি টাঙ্গানো আছে। ছোট্ট সৈকত বঙ্গবন্ধুর ছবিটা দেখে দেখে বঙ্গবন্ধুর সাথে বন্ধুত্ব করে ফেলেছে। বঙ্গবন্ধুকে সে দেখতে পায় সবখানে। বঙ্গবন্ধু তার সাথে কথা বলে। হ্যাঁ। একদম সত্যি কিন্তু। হয়ত কেউ বিশ্বাস করতে চাইবে না। কিন্তু বাস্তবতা আছে। সেই ছোট্ট বেলা থেকে বঙ্গবন্ধুকে সে দাদু বলে ডাকতো। এখনো দাদুই ডাকে। দাদু তার সাথে কত কথা বলে। সে আর দাদু জানে। তবে তার বড়ো দুঃখ। বঙ্গবন্ধুকে সে ছাড়া আর কেউ দেখতে পায় না। তা কি করে হয় ? সৈকত মাঝে মাঝে রেগে গিয়ে বলে দাদু, তুমি শুধু আমার সাথে কথা বলো অন্যদের সাথে কথা বলো না কেন ? ওরা তো বিশ্বাস করতে চায় না তুমি যে আমার সাথে কথা বলো। তখন বঙ্গবন্ধু শুধু হাসে। সৈকতও হাসে। এজন্য কেউ কেউ তাকে পাগলও বলে। মুক্তিযুদ্ধ বা বঙ্গবন্ধু বিষয়ে কেউ কোন মিথ্যা কথা বললে সৈকত সাথে সাথে তার প্রতিবাদ করে। বঙ্গবন্ধুর সাথে কথা বলে। বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে সত্যটা জেনে তবে সবাইকে জানায়। কি আশ্চর্য্য।
সৈকতের জন্ম সেই একাত্তরে। সারাদেশ যখন উত্তাল যুদ্ধের ডামাডোল চারদিকে, তখন সৈকত জন্ম নেয়। তারপর তো পুরো মুক্তিযুদ্ধকাল দোলনায়। একদিন মিলিটারি আসছে শুনে বাড়ির সবার সাথে সৈকতের মা ,ঠাম্মি ,পিসিমা সবাই সৈকতকে দোলনায় ফেলে পালিয়ে গিয়েছিল। অনেকক্ষণ পর যখন দেখে সৈকত কারো কোলে নেই। ওমা মায়ের সেকি চিৎকার। এদিকে মিলিটারির ভয়ে সবাইতো চুপ। এমন সময় গগন বিদারী চিৎকার সৈকতের মায়ের। সবাই পারে তো সৈকতের মাকে গলা চেপে ধরে। এমনি অবস্থায় সৈকতের মেজ পিসিমা রত্না, বাঁশঝাড়ের ভেতর দিয়ে কাঁটা-কুটা কত কি মাড়িয়ে নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে বাড়িতে গিয়ে ভাইপোকে কোলে করে নিরাপদে নিয়ে আসে। সৈকত তখনও ঘুমে।
সৈকতের যখন একটু একটু বুদ্ধি হয়, ফুল পাখি, মা-বাবা,কাকা সবাইকে চিনতে শিখেছে তখন থেকে বঙ্গবন্ধুকেও চিনতে শিখেছে। তার মেজকাকাই তাকে ছবিটার সামনে নিয়ে গিয়ে বলতো দ্যাখ দ্যাখ বঙ্গবন্ধু। সৈকতও আধো আধো কন্ঠে বলতো বম বম বু। এভাবে বলতে বলতে একদিন ঠিকই বঙ্গবন্ধু বলতে শিখে ফেলে।

সৈকতদের ঘরের বারান্দায় সোনালী ফ্রেমে বাধা বঙ্গবন্ধুর ছবি টাঙ্গানো ছিল। সৈকতের বাবায় সেই ছবি এনেছিল। সেই থেকে দেয়ালে টাঙ্গানো। ছোট্ট সৈকত কখনো কান্নাকাটি করলে সবাই বঙ্গবন্ধুর ছবিটার সামনে নিয়ে গিয়ে বলতে এই দাদু মারবে। তখন কান্না থামিয়ে দিয়ে ছবির দিকে তাকিয়ে থাকতো সৈকত। যখন একটু একটু বড় হচ্ছে সৈকত সব সময় বঙ্গবন্ধুকে বলতো দাদু দেখো আমাকে খেতে দিচ্ছে না, আমাকে খেলতে দিচ্ছে না। বললে মা কাকা বা পিসিমারা সৈকতকে তা দিয়ে দিতো। তাতে সৈকতের মনে একটা রেখাপাত হয়ে যাচ্ছিল। সেই রেখাপাত আজো তার ভেতর রয়ে গেলো। কিন্তু ১৯৭৫ সালের পনের আগস্ট যখন বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হলো সেদিন অন্য রকম হয়ে যায় সৈকত।
সৈকতের বয়স তখন পাঁচ। তার স্পষ্ট মনে আছে। রেডিওতে যখন বলতে ছিল শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে সৈকত তখন রেডিওটা বন্ধ করে দেয়। যখনই রেডিওতে বঙ্গবন্ধু হত্যার খবর বলতো সৈকত রেডিও বন্ধ করে দিত। সবার মুখে মুখে বঙ্গবন্ধু হত্যার কথা শুনতে পেয়ে সৈকত কেমন নির্বাক হয়ে যায়। সে খেলতে যায় না। কিছু খেতে চায় না। মা বাবা জোর করেও খাওয়াতে পারে না। এভাবে অনেক দিন চলে যায়। তাকে আরো আঘাত করে তাদের ঘরে বঙ্গবন্ধুর যে ছবিটি সোনালী ফ্রেমে বাঁধা ছিল সেটাও কবে কে যে খুলে নিয়ে গেছে কেউ বলে না। সৈকত সেই ছবির জন্য সেদিন সারাটা দিন শুধু কেঁদেছে। কারণ তখন বলা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর ছবি কেউ রাখতে পারবে না। রাখলে বিপদ। ভয়ে সৈকতের বাবা কাকারা বঙ্গবন্ধুর ছবিটাকে সরিয়ে রেখেছিল। তবে সৈকতের ঠাম্মিও ছিল শেখ সাহেবের ভক্ত। তিনি বললেন ছবিটাকে সুন্দর করে কাপড় দিয়ে ঢেকে ছাদের ঘরে যত্নে রাখার জন্য। অনেক দিন, বছর কেটে যায়।সৈকত ইশকুলে ভর্তি হয়। মা বা কাকার হাত ধরে ইশকুলে যায় সৈকত। যেতে যেতে কত কি কথা বলে। মুজিব কোট পড়া বঙ্গবন্ধুর আদলের কোন লোক দেখলে মা বাবা কাকাকে বলতো উনি কি বঙ্গবন্ধু ? বঙ্গবন্ধুর মুখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো দাড়ি নেই কেন সেটাও সৈকতের প্রশ্ন।
সৈকত এখন সব কিছু বুঝতে পারে। সেদিন ইশকুল থেকে ফেরার পথে কিছু লোক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে নানা কথা বলে যাচ্ছিল। একজন বলল বঙ্গবন্ধু তো পাকিস্তানিদের শর্ত মেনে প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়ে ছিল ? আরেকজন বলল না না। বঙ্গবন্ধু দেশের স্বাধীনতার দাবি থেকে কখনো সরে আসেনি। সৈকত সাথে সাথে তার বঙ্গবন্ধু দাদুকে স্মরণ করে জানতে চায় কোনটা সত্য। বঙ্গবন্ধুও সৈকতকে তার জবাব দিয়ে দেয়। আর সৈকতও গর্জে উঠে বলে, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থেকে বলেছিল ‘আমি স্বাধীনতা চাই। এ জন্য যদি আমাকে কারাগারে মরতেও হয় তাতে আমার কোন দুঃখ থাকবে না। আমার লাশটা বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিও’। সবাই অবাক হয়ে যায়। এতটুকু শিশু এসব জানলো কি ভাবে ? এসব কথা লেখা আছে ‘বঙ্গবন্ধুর আসমাপ্ত আত্নজীবনী’তে। বাবা মাকে বলে এই বইটি তোমরা পড়ে নিও। জানতে পারবে বঙ্গবন্ধুর সর্ম্পকে অনেক কিছু।

পূর্ববর্তী নিবন্ধইকবাল বাবুল
পরবর্তী নিবন্ধসা গ রে র ম রু দ্যা ন