সেতারা মূসা

অবিসংবাদিত সাংবাদিক নারী

ডেইজী মউদুদ | শনিবার , ২৩ মার্চ, ২০২৪ at ৫:২১ পূর্বাহ্ণ

তিনি সাংবাদিক কন্যা। সাংবাদিক জায়া। সাংবাদিক জননীও। একেধারে পুরো এক সাংবাদিক পরিবার বলয়ে যিনি আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা ছিলেন বরাবরই। বলছিলাম বাংলাদেশে নারী সাংবাদিতার পথিকৃৎ সেতারা মূসার কথা। তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা এই উপমহাদেশের খ্যাতিমান সাংবাদিক আবদুস সালামের কন্যা। পাকিস্তান সরকার তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে যে তিনজন সাংবাদিককে খুবই ভয় পেতো তাঁদের অন্যতম সাংবাদিক আবদুস সালাম। অন্য দুজন হলেন তোফাজ্জাল হোসেন মানিক মিয়া এবং জহুর হোসেন চৌধুরী। সাংবাদিক আবদুস সালাম ইংরেজি পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন বিধায় তাঁর খ্যাতি ও সুনাম ছিল ঈর্ষণীয়। জানা যায়, এই পণ্ডিত ও সাহসী সম্পাদক তখন যে সম্পাদকীয়গুলো লিখতেন, ভারতের জওহরলাল নেহেরু পর্যন্ত সম্পাদকীয়গুলোর প্রশংসা পেতেন। আর সেই অসম সাহসী সাংবাদিকের কন্যা সেতারা আজ থেকে সত্তুর বছর আগেই কি সাহস না দেখিয়েছিলেন। স্কুল পালিয়ে ফুপাতো ভাই সাংবাদিক এবিএম মূসাকে বিয়ে করেছিলেন।

স্কুল পালানো সেই বালিকাটি ক্রমে হয়ে উঠেছিলেন সাংবাদিক এবিএম মূসার যোগ্য সহধর্মিণী। সেই সুবাদে সন্তানদের মাতা, শ্বশুরবাড়ির যোগ্য বধূ, এক কথায় পরিবারের মধ্যমণি। সংসারধর্মকে ছাপিয়ে সমাজের এক মহান উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা যেনো। সন্তান পালনের পাশাপাশি একাডেমিক শিক্ষার পাঠও চুকিয়েছিলেন। ক্লাস নাইন পড়ুয়া ছাত্রী ক্রমান্বয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে মাস্টার্স পাস করে সাংবাদিকতায় প্রবেশ করেন দৈনিক পূর্বদেশের নারী পাতা সম্পাদনার মধ্য দিয়ে। পাশাপাশি সিনে পত্রিকা ‘চিত্রালী’ তে কলাম লিখতেন। পূর্ব পাকিস্তান রেডিওতে মহিলাদের জন্য প্রচারিত অনুষ্ঠান পরিচালনা করে দেশব্যাপী পরিচিতি লাভ করেন। ইপিটিভির বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি অংশগ্রহণ করতেন। টিভির জন্য নিয়মিত একাংকিকা তিনি লিখতেন। মহান স্বাধীনতার পরে তিনি নিজেকে সমাজসেবায় আত্মনিয়োগ করেন। পাড়ার মহিলাদের সংগঠিত করে তিনি গড়ে তুলেন ‘সুরুচি সংসদ’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এই সংগঠনের মাধ্যমে তিনি নারীদেরকে সমাজ ও সংস্কৃতি চর্চায় উৎসাহিত করতেন। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছাড়াও তিনি মোহাম্মদপুর টাউন হলের টোকাইদের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই স্কুলে বিনামূল্যে পড়াশোনা ছাড়াও বিভিন্ন পাড়া মহল্লা থেকে জোগাড় করে পালা করে টিফিনও দেয়া হতো। এই ফাঁকে তিনি পুনরায় ফিরে আসেন সাংবাদিকতায়। সচিত্র স্বদেশ, দৈনিক জনতা, দৈনিক আওয়াজ সহ বিভিন্ন পত্রিকায় কাজ করার পাশাপাশি গড়ে তুলেছিলেন নারী সাংবাদিকদের জন্য প্রথম সংগঠন ‘বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক ফোরাম’। সাংবাদিক সেতারা মূসা গার্লস গাইডের কমিশনার, রেডক্রিসেন্টের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, ছিলেন পরিবার পরিকল্পনা সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটিতে। মহিলা কমিশনার ছিলেন, ছিলেন চীন মৈত্রী সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটিতে। জড়িত ছিলেন সুরভী সঙ্গীত নিকেতন এবং এস ও এস শিশু পল্লীর কমিটিতেও। এতো এতো কাজ করা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন পরিবারের সর্বংসহা। এই মহীয়সীর স্বামী প্রতিথযশা সাংবাদিক এবি এম মূসা সাহেবকে আমি খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। উনার বড় কন্যা মরিয়ম সুলতানা রুমা আমার সহকর্মী ছিলেন। তিনি ১৯৮৬ সাল থেকে বেশ কয়েক বছর দৈনিক পূর্বকোণের রমনীয় পাতা সম্পাদনা করতেন। সেসময় এবিএম মূসা সাহেব পূর্বকোণ অফিসে আসতেন। দেখেছি বহুবার, তবে কথা বলার সুযোগ হয়নি। আর নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের সাথে যুক্ত হবার পর তাঁদের মেজো কন্যা পারভীন সুলতানা ঝুমার সান্নিধ্য পেয়েছি। তাঁদের ছোট কন্যা ড. শারমিন মূসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের এসোসিয়েট প্রফেসর ও সিনেট মেম্বার। নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে ঢাকায় হুইল চেয়ারে বসা সেতারা মূসার সান্নিধ্য পাই। তিনি তখন বয়স ও রোগের ভারে ন্যুজ। বার্ধক্যজনিত রোগে কাবু এই অগ্রপথিক নারী সাংবাদিক। যিনি শত প্রতিকূলতা আর প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে বাংলাদেশে নারী সাংবাদিকদের পথ চলা সুগম করেছিলেন। এই অগ্রজ ও পথিকৃৎ নারী সাংবাদিককে স্যালুট জানাই। নিজে সাংবাদিকতা করেছেন। আবার নিজের দুই আত্মজাকেও সাংবাদিক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আসলে যোগ্য প্রজন্ম তৈরি করতে পারলেই মরেও তারা থাকেন অমর। সাংবাদিক এবিএম মূসা এবং সেতারা মূসা তিন কন্যাকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত তো করেছেন, গড়ে তুলেছিলেন একজন মানবিক মানুষ হিসাবেও। তিন কন্যাই উচ্চ শিক্ষিত এবং প্রতিষ্ঠিত। কন্যারা পিতা মাতার স্মৃতিকে তুলে ধরতে গঠন করেন সেতারা মূসা ফাউন্ডেশন। এই ফাউন্ডেশনের মধ্য দিয়ে তাঁরা বিভিন্ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে পিতা মাতার স্মৃতিচারণ করেন। তাঁদের নামে এওয়ার্ড প্রদান করেন দেশের বরেণ্য ব্যক্তিকে। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে স্বাধীনতার প্রথম দৈনিক এবং একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক দৈনিক আজাদী সম্পাদক এমএ মালেককে সম্মাননা প্রদান করা হয়। অনুষ্ঠানটিতে আমিও আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলাম প্রিয় ঝুমা আপার আমন্ত্রণে। সেদিন খুব ভালো লেগেছিল এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পেরে। নিজেকে অনেক সম্মানিত বোধ করেছি এই অসাধারণ ও গুণী সাংবাদিক দম্পতির সম্মানে আয়োজিত অনুষ্ঠানে আলোচক হিসাবে উপস্থিত থাকতে পেরে। গত ১৪ মার্চ ছিল সেতারা মূসার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। বিরলপ্রজ এই কিংবদন্তি ও পথিকৃৎ নারী সাংবাদিককে জানাই অপার শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা। তাঁর রেখে যাওয়া উত্তরসূরী মরিয়ম সুলতানা রুমা, পারভীন সুলতানা ঝুমা এবং ড. শারমিন মূসাকে জানাই সাধুবাদ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি রাখা যাবে না
পরবর্তী নিবন্ধঅবন্তিকা বাঁচার জন্য বিচার চেয়ে আড়াই বছর বেঁচে ছিল