সিটি অফ লন্ডন

রেফায়েত ইবনে আমিন | সোমবার , ১৩ মার্চ, ২০২৩ at ১০:৩১ পূর্বাহ্ণ

আজকে ভিন্ন একটা লন্ডন শহর সম্পর্কে বলবো। অধিকাংশ মেরিনারই পণ্যবাহী জাহাজেই কাজ করিজেনারেল ড্রাইকার্গো, বাল্কক্যারিয়ার, গ্রেইন বা ওরক্যারিয়ার, কন্টেইনারশিপ, তেল বা কেমিক্যালট্যাঙ্কার, কারক্যারিয়ার, ক্যাট্‌ল্‌ক্যরিয়ার, রেফ্রিজেরেটেডশিপ ইত্যাদি। অফশোর অয়েলরিগ গভীর সমুদ্রতল থেকে তেল/গ্যাস তুলে। এছাড়াও রয়েছে টাগবোট, কোস্টালভেসেল, বাঙ্কারভেসেল, ওয়াটারক্যারিয়ার, সাপ্লাইভেসেল। কেউ প্যাসেঞ্জারশিপেও কাজ করে। যদিও প্যাসেঞ্জারশিপগুলো বিশ্বের সবচাইতে সুন্দর পোর্টগুলোতে যায়; তবুও আমি ব্যক্তিগতভাবে সেগুলোতে কখনই কাজ করতে চাইনাই। কারণ, কার্গোজাহাজে আমরা অফিসাররাই রাজা। কিন্তু প্যাসেঞ্জারশিপে প্যাসেঞ্জাররা প্রধান। তাদের আরামআয়েস, বিনোদনই প্রায়োরিটি। আর মেরিনাররা দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে যায়।

১৯৯০এ একবার ননকনভেনশানাল ছোট্ট জাহাজে দুসপ্তাহ কাজ করার সুযোগ হয়েছিলো। আমি তখন ইংল্যান্ডের সাউথশিল্ড্‌স্‌ শহরে প্রফেশানাল পরীক্ষাপাশের পরে, ভবিষ্যতের চিফইঞ্জিনিয়ারিং পরীক্ষার কয়েকটা সাবজেক্টও ক্লিয়ার করছি। তাহলে যখন দুইতিন বছর পরে আসবো, তখন প্রফেশানালি অনেক এগিয়ে থাকবো। খুবই রিল্যাক্স্‌ড্‌ মুডে ছিলাম। প্রধান লক্ষ্য সেকেন্ডইঞ্জিনিয়ারিং তো পাশ করেই গেছি; এরপরে যাই করতে পারবো সেটাই বোনাস। পড়াশুনার অবসরে চাকুরিও খুঁজি। ইংল্যান্ডে গিয়েছি সম্পূর্ণ নিজ খরচে; দশবারোমাস শেষে ব্যাঙ্কব্যাল্যান্স তলানীর দিকে। কিছু ইনকাম করতে পারলে ভালো হয়। কাগজে জাহাজের একটা টেম্পোরারি কাজের বিজ্ঞাপন দেখে সেখানে ফোন করলাম। টেলিফোনেই তারা আমাকে সিলেক্ট করে নিয়ে, সব ইন্সট্রাকশানও দিয়ে দিলো।

সেইমত নিউক্যাসেল ট্রেনস্টেশানে গিয়ে নাম বলার সঙ্গে সঙ্গে, কাউন্টার থেকে একটা টিকিট ধরিয়ে দিলো। বাংলাদেশ থেকে আসা, আমার জন্যে সবই নতুন ও বিস্ময়কর। এরকম ফোনে কথা বলেই, রেলের টিকিট পেয়ে যাওয়া; এবং সবকিছুর নিখুঁত এরেঞ্জমেন্ট আমার কল্পনার বাইরে। টিকিট অনুযায়ী ট্রেনে চেপে দুইবার ট্রেন বদলে, লন্ডনের পূর্বদিকে সাউথএন্ডঅনসি বলে ছোট্ট রিসোর্ট শহরে পৌঁছলাম। লন্ডনের নাম বললেই থেইম্‌স্‌ নদী চলে আসবে। ম্যাপে দেখবেন থেইম্‌স্‌ লন্ডনের মাঝ দিয়ে বয়ে পূর্বদিকে নর্থসিতে পড়েছে। সেখানেই সাউথএন্ডঅনসি শহরটা। লম্বা জার্নির ধকল কাটিয়ে স্টেশানের বাইরে এসেই দেখি বিশাল একটা এমিউজমেন্ট পার্ক চারিদিকে মেলা বসেছে ফেরিস্‌উইল, রোলারকোস্টার অনেক কিছু। হাজারে হাজারে মানুষ, কর্মব্যস্ত জীবনের একঘেয়েমি থেকে রেহাই পেতে সপরিবারে ঘুরতে এসেছে। অথচ, অন্যদিকে আমি এখানে এসেছি কাজের ধান্দায়।

সেটাতো ভালো, কিন্তু আমি আমার জাহাজ বা জাহাজের মানুষ চিনবো কেমন করে? টেলিফোনে মহিলা আমাকে বলেছিলো, সাউথএন্ডে গেলে তোমার শিপমেটদের দেখা মিলবে। ‘কোথায় কীভাবে দেখা হবে?’ ‘তাদের চিনবো কি করে?’ ‘তারাই বা আমাকে চিনবে কেমন করে?’ চাকরি পাওয়ার উত্তেজনায়খুশীতে, তখন এতসব জিজ্ঞেস করি নাই। তবে বেশি বেগ পেতে হলো না; একটু পরেই দেখি তিনচারজন মানুষ আমারই মত ব্যাগস্যুটকেস নিয়ে আরেকটা ট্রেন থেকে নামলো। ব্যাগস্যুটকেসটাই ছিলো আমার কাছে সবচেয়ে বড় ক্লু। এখানে অধিকাংশ মানুষই আসে বিনোদনের জন্যে দিনেদিনেই আবার চলে যাবে। ব্যাগস্যুটকেস নিয়ে যারা নামলো, তাদের দেখে আমার জ্ঞাতিভাইই মনে হলো, যদিও সকলেই সাদাচামড়ার বৃটিশ। আমি কাছাকাছি যেতেই, একজন এগিয়ে এসে নিজের পরিচয় দিলো স্কিপার জন বলে। সেইই জাহাজের ক্যাপ্টেন। অফিসও তাকে জানিয়েছে আমার ব্যাপারে। UMA (ইউনাইটেড মেরিন এগ্রেগ্রেট) নামের কোম্পানির কোস্টাল জাহাজগুলোতে দু’সেট মানুষ কাজ করে। প্রতিসেট দু’সপ্তাহ করে টুউইকঅন/টুউইকঅফ। সবকিছুই ফিক্স্‌ড্‌ আর ধরাবাঁধা। এই সেটের এক ইঞ্জিনিয়ারের ইমার্জেন্সির জন্যে সে এবারে যেতে পারছে না। আমি তার সাবস্টিটিউট। আমরা সবাই মিলে রেলস্টেশান থেকে বের হয়ে আরেকটা ছোট্ট টয়ট্রেনের মত রেলে চড়ে, লম্বা জেটির শেষ মাথায় নদী ও সাগরের মোহনায় চলে আসি। ছোট্ট খেলনার মত ট্রেনে জেটিতে যাওয়ার জার্নিটাও মজার। আর ৯৯% প্যাসেঞ্জারই ট্যুরিস্ট, বিনোদনআমোদপ্রমোদের জন্যে এসেছে।

জেটির শেষমাথায় যাওয়ার দশপনের মিনিটের মধ্যে ‘সিটি অফ লন্ডন’ ড্রেজারটা এসে ভিড়লো। সেটার থেকে সকলে টুপটুপ করে নেমে চলে গেলো; আর আমরা স্কিপার জনের সঙ্গে গিয়ে সেটায় উঠলাম। বড় সমুদ্রগামী জাহাজগুলোতে সাইনঅফ আর সাইনঅন এবং হ্যান্ডওভার করতেও বেশ কয়েক ঘন্টা লাগে; বা মাঝে মাঝে একদিন দুইদিনও লাগে। এখানে সেসবের বালাইই নেই। কারণ আমিই একমাত্র নতুন; আর বাকী সকলেই এই একই জাহাজ থেকে মাত্র দুই সপ্তাহ আগেই ফিরে গেছে। বড় জাহাজগুলোতে আমি বিশ থেকে ত্রিশপঁয়ত্রিশ জনের সঙ্গে সেইল করতে অভ্যস্থ। অথচ এখানে ক্রুঅফিসার সব মিলিয়ে মাত্র দশজন। স্কিপার, চিফঅফিসার, সেকেন্ডঅফিসার; চিফ ইঞ্জিনিয়ার, সেকেন্ডইঞ্জিনিয়ার, থার্ডইঞ্জিনিয়ার (আমি); একজন কুক আর তিনজন ক্রু। কেবিনে গিয়ে থিতু হয়ে বসতে না বসতেই জাহাজ ছেড়ে দিলো। সবকিছুই ঝটপট, তড়িঘড়ি।

বিখ্যাত থেইম্‌স্‌ নদী সাউথএন্ড এসে নর্থসি তে পড়েছে। আমরাও রওনা দিলাম নর্থ সির উদ্দেশ্যে। সেখানে ড্রেজিং করে নুড়িপাথরকঙ্কর নিয়ে এসে পোর্টে খালাস করবো। সেগুলো দিয়ে রাস্তার বা বিল্ডিংয়ের ম্যাটেরিয়াল বানাবে চূর্ণ করে সিমেন্টকংক্রিট বা অল্পস্বল্প গুড়া করে (Aggregate, এগ্রেগ্রেট) ইত্যাদি। একটা প্রশ্ন আসতে পারে ড্রেজিং কেনো করা হয়? প্রথমেই মাথায় আসে, পানির গভীরতা বাড়িয়ে জাহাজ চলাচলের সুবিধা করা হয়। বাংলাদেশে পলিমাটি জমে জমে নদী নৌচলাচলের অনুপযুক্ত হয়ে যায়। তখন ড্রেজার দিয়ে তলা থেকে মাটি তুলে অন্য কোথায়ও অন্যকাজে ব্যবহার করে; বাঁধ বা লেভি তৈরি করে; শক্তমাটিপাথর নিয়ে রাস্তাবিল্ডিং নির্মাণ কাজ করা হয়। তবে প্রকৃতির উপরে ড্রেজিংএর ক্ষতিকারক/উপকারী দুইধরনের প্রভাবই অনেক পানির তলদেশকে ডিস্টার্ব করা হয়, পানির স্বাভাবিক গতিপথকে বদলে দেয়; সেখানের মাছ ও অন্যান্য প্রাণী, জলজ উদ্ভিদের ক্ষতিও হয়। আবার ড্রেজিংএর উপকারী দিকও রয়েছে নদীর নাব্যতা, নৌচলাচলের উপযোগী করা, জলবদ্ধতা নিরসন, বন্যানিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি।

কীভাবে ড্রেজিং করে? আগেকার আমলে মেকানিক্যাল ড্রেজিং হতো বাকেট (bucket) বা পাত্র দিয়ে দড়ি/কাছি বা কনভেয়ারবেল্টের সাহায্যে মাটি তুলতো। এখনকার দিনে অধিকাংশই হাইড্রোলিক ড্রেজার। “সিটি অফ লন্ডন” হাইড্রোলিক টাইপের, এবং এর সাকশানহপার জাহাজের পিছে (Trailing Suction Hopper Dredger)। জাহাজের দুইপাশে দুইটা ফিল্টারসহ পাম্প (সাকশানহপার), মোটা নলসহ নামিয়ে বালু বা মাটির মাঝে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। পাম্প চালু করলে, ভ্যাকুয়ামক্লিনারের মত বালুমাটিকঙ্করপাথর নল দিয়ে এসে জাহাজের হোল্ডিংট্যাঙ্কে জমা হয়। ফিল্টার থাকে বড় পাথর বা জলজ উদ্ভিদশ্যাওলা ইত্যাদিকে আটকানোর জন্যে। ইচ্ছা করেই প্রচুর পানিসহ তুলা হয়, তারপরে হোল্ডিংট্যাঙ্কে কিছুক্ষণ থিতু হলে তলানীর বালুকঙ্কর রেখে, উপর থেকে পানি স্কিম করে আবার সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয়। একসময়ে হোল্ডিং ট্যাঙ্ক ভরে গেলে, আমরা পোর্টে ফিরে এসে, পাথর ডিসচার্জ করে আবার নর্থসিতে ফিরতাম। শুকনা নুড়িপাথরবালু তো ডিসচার্জ করা যাবে না, তাই আবারো নদী থেকে পানি নিয়ে মিশিয়ে শরবতের মত বানিয়ে ডিসচার্জ করতে হতো।

অন্য অনেক ড্রেজার আছে, যেগুলো হোল্ডিংট্যাঙ্কে জমা করে না। একদিকের বালু অন্যদিকে ছুড়ে মারে রেইনবোইয়িং (রংধনু) বলে। অথবা, হোল্ডে করে নিয়ে জায়গামত এসে, জাহাজের তলায় পানির নীচে কয়েকটা দরজা খুলে বালুমাটি সেখানে ফেলে দেয়। এছাড়াও শক্ত পাথুরিয়া মাটি ভাঙবার বা কাটার জন্যে রয়েছে কাটার সাকশান ড্রেজার (Cutter Suction Dredger)

জাহাজটা ঝকঝকে তকতকে, ১৯৮৯ সালে তৈরি মাত্র এক বছরের পুরানো। এ যাবতকাল আমি বিশতিরিশ বছরের পুরানো সব লক্কড়ঝক্কড় মার্কা (rust0bucket) জাহাজে উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দিয়েছি; কিন্তু এখন একদম আল্ট্রামডার্ন, ঝাঁচকচকে নতুন জাহাজে চড়ে অন্যধরনের অনুভূতি হচ্ছে। সবকিছুই অটোম্যাটিক, কাজকর্মও বেশী কিছুই নাই। ইঞ্জিন আনএটেন্ডেড চলে, আমরা তিন ইঞ্জিনিয়ার শুধু খেয়াল রাখি।

দেখতে দেখতে দুই সপ্তাহ শেষ হয়ে গেলে, আবারো সেই সাউথএন্ডঅনসি তে এলাম। এই জাহাজ সাউথএন্ড পোর্টের জেটি শুধুমাত্র মানুষ বদলী করার সময়ই ব্যবহার করে। এখানে কোন পাথর খালাস করা হয় না। এবারে আমরাও এখানে এসেই নেমে গেলাম; আর জেটিতে দাঁড়িয়ে থাকা সেই অন্যদলটা দায়িত্ব নিয়ে নিলো। আমি আবারো ট্রেন স্টেশানে গিয়ে নাম বলতেই, টিকিটমাস্টার আমার হাতে টিকিট ধরিয়ে দিলো, একদম আমার বাসার স্টেশান পর্যন্ত। ট্রেনে উঠার আগে ব্যাঙ্কের এটিএমএ গিয়ে দেখি, আমার একাউন্টে অলরেডি বেতন জমা হয়ে আছে। সবকিছুই নিখুঁত সিস্টেমের মাধ্যমে হয়ে হয়ে যাচ্ছে। যে বা যারা করছে, তারা জানে কীভাবে কী করতে হয়; এবং কীভাবে মানুষের হয়রানি কমাতে হয়। নিজ বেতনের নিজের প্রাপ্য টাকা তুলতে গিয়ে বাংলাদেশে আমাকে অনেক ভোগান্তি পোষাতে হতো; কিন্তু এখানে তার বিন্দুমাত্রই দেখলাম না। এর আগে ও পরে, জীবনে আরো অনেক জাহাজেই তো চাকরি করেছি; কিন্তু সেই সিটি অফ লন্ডনের দুই সপ্তাহ ছিলো একটু অন্য ধরনের অভিজ্ঞতা।

টলিডো, ওহাইও, ২০২৩

refayet@yahoo.com

পূর্ববর্তী নিবন্ধকীভাবে তাঁরা হয়ে উঠলেন ব্যান্ড তারকা
পরবর্তী নিবন্ধসন্দীপনার উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠান