সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ও বিপন্ন মানবতা

লালন কান্তি দাশ | বুধবার , ২০ জুলাই, ২০২২ at ৬:১৮ পূর্বাহ্ণ

আমাদের সমাজে পরধর্ম ও পরমত সহিষ্ণুতা দিনদিন উঠে যাচ্ছে। মানুষ হয়ে উঠছে ক্রমশ অসহিষ্ণু। বিশেষ করে সাম্প্রদায়িকতা গ্রাস করছে আবহমান বাংলার ঐতিহ্য, সম্প্রীতি ও সৌন্দর্যকে। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সকলের সম্মিলিত রক্তের গ্রোতধারায় এদেশ স্বাধীন হয়েছে। এদেশের আলো, বাতাস, ভূমির উপর সকলের অধিকার সমান। সবার নিজ নিজ ধর্ম পালন, নিরাপত্তা পাওয়া ও স্বাধীনভাবে বসবাসের অধিকার রয়েছে। অথচ বাস্তবতা হলো ধর্ম অবমাননার অভিযোগে বিগত কয়েকবছর ধরে ধারাবাহিকভাবে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী ও তাদের বাড়ি ঘরে হামলা চালানো হচ্ছে, ভাংচুর ও পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, মন্দির- উপাসনালয়। যা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে চরম নিরাপত্তাহীনতা ও ক্ষোভের সৃষ্টি করছে।

ধর্ম অবমাননা অবশ্যই নিন্দনীয় ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কেউ অপরাধী প্রমাণিত হলে অবশ্যই তাকে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। কিন্তু সাময়িক উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে সত্য-মিথ্যা যাচাই না করে কিংবা প্রকৃত দোষীকে চিহ্নিত না করে ঐ সম্প্রদায়ের জানমালের উপর আক্রমণ করা আরো গর্হিত কাজ। এ জাতীয় ঘটনায় অন্যের ফেইসবুক আইডি হ্যাক করে ধর্ম অবমাননার পোস্ট দিয়ে তৃতীয় কোনো পক্ষ সমাজ ও দেশকে অস্থিতিশীল করার সুযোগ নিচ্ছে কিনা সেটা গুরুত্বের সাথে তদন্ত করা উচিত। কেননা প্রতিটি ঘটনার দৃশ্যপট একই প্রকৃতির। অমুসলিম কোনো যুবকের ধর্ম অবমাননার পোস্ট দেয়াকে কেন্দ্র করে হামলার পথ তৈরি করা হয়।

সংখ্যালঘু হওয়া এখন অপরাধের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ চিত্র আজ শুধু আমাদের দেশে নয় সমগ্র উপমহাদেশে, সমগ্র বিশ্বে। কোথাও নির্যাতিত হচ্ছে হিন্দু, কোথাও মুসলিম, কোথাও অন্য ধর্মের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী। মানবতা যেন আজ গুমরে কেঁদে মরে। একথা সত্যি যে আমাদের দেশে বেশিরভাগ লোকই অসাম্প্রদায়িক। কিন্তু কিছু স্বার্থান্বেষী দুর্বৃত্ত পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টির অপপ্রয়াস চালায়। তাদের মূল লক্ষ্য সংখ্যালঘুদের দেশ থেকে বিতাড়িত করা, ভূমি ও সম্পত্তি দখল করা। বলাবাহুল্য আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতির আরো অবনতির হওয়ার আশংকাকে একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। রামু, নাসিরনগর, শাল্লা, কুমিল্লাসহ নিকট অতীতে ঘটে যাওয়া কোনো সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনার বিচার হয়নি। একটি ঘটনা আলোচিত হলে প্রথম কয়েকদিন লোকদেখানো ধরপাকড় চলে, পরবর্তীতে আর কোনো বিচারিক তৎপরতা চোখে পড়ে না। বিচারহীনতার এ সংস্কৃতি দুর্বৃত্তদের দিনদিন বলীয়ান করছে।

তাই সকল সম্প্রদায়ের ধর্মপ্রাণ মানুষকে এ ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে ব্যবহার করে উস্কানি সৃষ্টি কিংবা গুজব ছড়িয়ে দিয়ে কেউ যাতে পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে না পারে এ ব্যাপারে প্রশাসনকে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিতে হবে। ধর্ম অবমাননাকারী ও সাম্প্রদায়িক দুর্বৃত্তদের শাস্তি নিশ্চিত করা না গেলে এধরনের ঘটনা বারবার ঘটতে থাকবে। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার অধিকার কারো নেই। সাম্প্রদায়িকতার বিষদাঁত ভেঙে দিতে রাষ্ট্রকেই নিতে হবে মূল দায়িত্ব। প্রতিটি ধর্মের মূল মর্মবাণী হল-শান্তি স্থাপন ও মানুষের কল্যাণ। ধর্মের এ বাণী ছড়িয়ে দিতে হবে সবখানে। যে কোনো মূল্যে সকল ধর্ম ও বর্ণের মানুষের মর্যাদাকে সমুন্নত রাখতে হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ‘মা’ সুমধুর প্রশান্তির ছোঁয়া
পরবর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে