সমুদ্রের জলদস্যু ভাইকিং

আরিফ রায়হান | বুধবার , ২১ এপ্রিল, ২০২১ at ১০:২২ পূর্বাহ্ণ

সমুদ্রের ভয়ানক আতঙ্কের নাম ভাইকিং। তারা ছিল দুর্ধর্ষ প্রকৃতির জলদস্যু। ভাইকিংদের বিভিন্ন সমুদ্র অভিযানের কারণে সমুদ্র সম্পর্কিত ভৌগোলিক জ্ঞান অনেক বৃদ্ধি পায় এবং অসংখ্য অজানা, অচেনা জনপদ আবিষ্কৃত হয়। সমুদ্রে জলদস্যুদের ইতিহাস কোন নতুন ঘটনা নয়। মিশরের এক ফারাও এর সময়ে রচিত প্যাপিরাসের পুঁথিতে জলদস্যুসের উল্লেখ আছে। বর্ণিত আছে, পূর্ব আফ্রিকার উপকূলের যাত্রীবাহী নৌযানে জলদস্যুদের আক্রমণের কথা।
ভাইকিং শব্দের অর্থ হচ্ছে, ফিয়র্ডের সন্তান। ফিয়র্ড হল সমুদ্র উপকূলের বিশেষ ভূ-প্রাকৃতিক গঠন। বরফ যুগের হিমবাহের প্রবাহের ফলে স্ক্যাণ্ডেনেভিয়ার ভূমির অনেক অংশ মুছে যায়। যার ফলে পশ্চিম দিকের সমুদ্র উপকূলে সৃষ্টি হয় অসংখ্য ফিয়র্ড। দেশটির মেরুবৃত্তের উত্তরের দিকটা পুরোপুরিভাবে বরফ ঢাকা। দক্ষিণের দিকটা পাবর্ত্য এলাকা। ফিয়র্ডের কারণে তৈরি হওয়া ভঙ্গিল সমুদ্র উপকূল ছিল জাহাজের জন্য এক প্রকার নিরাপদ আশ্রয়স্থল। গভীর সমুদ্রে মাছ শিকারের সাথে সাথে তাদের মাঝে তখন দস্যুবৃত্তির প্রবণতা দেখা দেয়। তারা সামুদ্রিক বাণিজ্যের অন্যান্য জাহাজের ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়ে ধন সম্পদ লুট করত। তাদের হিংস্র স্বভাব আর নিষ্ঠুরতার জন্য সমুদ্রের আতঙ্ক হয়ে দেখা দেয়।
ভাইকিং জাহাজগুলো ছিল একেবারেই সাধারণ কাঠামোর। আর তাতে চড়েই তারা সুদূরের পথে পাড়ি দিত। কেবল ভূমধ্যসাগরই নয়, আমেরিকার উপকূলভাগেও তারা হানা দিয়েছিল কলম্বাসের পৌঁছানোর পাঁচশো বছর আগেই। তাদের জাহাজের গড়ন ছিল লম্বা-সরু। দুদিকের মুখ সুঁচালো। নদীর উজান পথে তারা প্রবেশ করত ইউরোপের উর্বর অঞ্চলে। ৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে তারা ইংল্যাণ্ডের ডরসেট উপকূলে আক্রমণ চালায়। এরপর প্রতি বছর তারা আক্রমণ করত। লুটপাট করত। আশপাশের ক্ষুদ্র দ্বীপগুলোকে দখল করে নিয়ে ঘাঁটি বানায়। ক্রমে ৯১২ খ্রিস্টাব্দে তারা রাইন নদী থেকে সিন নদী পর্যন্ত আধিপত্য বিস্তার করে। পশ্চিম ইউরোপের নদীপথ দিয়ে তারা প্রবেশ করে তারা শ্যাটল্যান্ড, অর্কনি, স্কটল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড পৌছে।
পরবর্তীকালে রাশিয়া, সিসিলি, উত্তর ফ্রান্সে গিয়ে বসতি স্থাপন করে। নবম শতাব্দিতে তারা পারস্যের রেই, রাগোস অঞ্চলে বাগদাদের বণিকদের সাথে বাণিজ্য করত। পণ্যদ্রব্য নিয়ে বাল্টিক সাগর পাড়ি দিয়ে পৌঁছাত ইউরোপে। রানি প্রথম এলিজাবেথের সময়ে জলদস্যুরা ইংল্যাণ্ডে প্রচণ্ড আতঙ্কের সৃষ্টি করেছিল। ইংরেজ নৌবহর যথেষ্ট দুর্বল থাকার জন্য ভাইকিংরা এতটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল। ভারতের পশ্চিম উপকূলের মালাবার হয়ে উঠল জলদস্যুদের ডেরা।
পূর্ব এশিয়ার চীন ও জাপানে জলদস্যুদের উৎপাত বৃদ্ধি পায়। চীন সমুদ্রে জলদস্যুদের নেতা ছিল পর্তুগিজ মেনেডজ পিন্টো। সিমন আন্দ্রাদা প্রথম এসে উপস্থিত হয় চিনা সমুদ্রে। তার প্রধান উদ্দেশ ছিল চিনের ছেলেমেয়েদের ক্রীতদাস হিসেবে ইউরোপের বাজারে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করা। আরব দেশ পূর্বে এসে ওমান উপদ্বীপে মিলেছে। যার উত্তরে রয়েছে পারস্যের উপকূল। সেখানে পৌঁছাতে গেলে যেতে হত হরমুজের সরু খাঁড়ি দিয়ে। নাবিকেরা সেখানে গিয়ে একটি উপকূল দেখত। যেখানে পানির গভীরতা বেশি না। সেটি পরিচিত ছিল ‘জলদস্যু উপকূল’ বলে। ভৌগোলিক দিক থেকে সেটি ছিল পূর্বপশ্চিমের মাঝে যোগসূত্র। বাণিজ্য চলত এই পথ ধরে। জলদস্যু উপকূলে ছিল প্রচুর স্থানীয় আদিবাসী।
তাদের মাঝে ছিল হিংস্র জোয়াসমিস জাতি। যাদের নাম প্রথম ১৬ শতকে জানা যায়। ১৬৩০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৭২০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত জলদস্যুরা বিভিন্ন সমুদ্রে ব্যাপক আতঙ্ক সৃষ্টি করে রেখেছিল। মূলত ক্যারিবিয়ান সাগর ছিল তাদের প্রধান বিচরণ ক্ষেত্র। ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের আশপাশের এলাকা ছিল তাদের মূল ঘাঁটি। তারা পরিচিত ছিল ব্যাকেনিয়া নামে। নিজেদের সম্পর্কে তারা এক অদ্ভুত ধারণা পোষণ করত।
নিজেদেরকে তারা অপরাধী বা দস্যু বলে ভাবত না। তারা দস্যুবৃত্তিকে গ্রহণ করেছিল এক ধরনের পেশা হিসেবে। তারা মনে করত সেটা হচ্ছে নাবিকদের মতই কোনো কাজ। একনাগাড়ে সমুদ্রে দীর্ঘ সময় অবস্থান করত তারা। এতে তাদের কথ্যভাষাও অনেক পালটে গিয়েছিল। এক প্রকার নতুন বুলি প্রচলন করেছিল তারা। যা শুধু তারাই বুঝতে পারত। অন্যদের কাছে সেই ভাষা ছিল দুর্বোধ্য।
জলদস্যুদের লুণ্ঠিত সামগ্রী গুপ্তধন আকারে বিভিন্ন নির্জন দ্বীপে মাটির নিচে লুকিয়ে রাখা হত। ডমিনিকার বিভিন্ন দ্বীপে এ ধরনের গুপ্তধন রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। জলদস্যুদের কারণে সামুদ্রিক অভিযান হয়ে উঠেছিল বিপদসঙ্কুল। ব্ল্যাক বিয়ার্ডের নাম ছিল মহাআতঙ্ক। নারী জলদস্যু ছিল আইরিশ অ্যান বনি। স্কটিশ জলদস্যু ক্যাপ্টেন কিডের জাহাজের নাম ছিল এডভেঞ্চার। হত্যা ও জলদস্যুতার অভিযোগে লন্ডনের ওয়াপিং-এর এঙিকিউসন ডেকে ক্যাপ্টেন কিডকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। ফাঁসি দেওয়ার সময় প্রথমে জল্লাদের দড়ি ছিড়ে গিয়েছিল এবং দ্বিতীয় বারের চেষ্টায় তাকে ফাঁসি দেওয়া হয়। কিডের মৃতদেহ একটি খাঁচায় করে টেমস নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছিল। তাতে লেখা ছিল ‘জলদস্যুতার পরিণতি হবে এমন নির্মম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধযখন আসে বোশেখটা
পরবর্তী নিবন্ধমিয়ানমারের সংকট নিয়ে শীর্ষ সম্মেলনের ডাক আসিয়ানের