সমকালীন বাংলা সাহিত্য-পাঠ

আহমেদ মাওলা | শুক্রবার , ১২ আগস্ট, ২০২২ at ৭:৫২ পূর্বাহ্ণ

সমকালীন সাহিত্যের দিক তাকালে আমরা যে-নগরজীবনকে দেখি, তা শুষ্ক, পানসে, বিবর্ণ। তাতে গভীর শূন্যতাই কেবল দৃষ্টিগোচর হয়। ইউরোপীয় মডেলে নগরায়ন আমাদের সচল-প্রবহমান নদীকেন্দ্রিক সভ্যতাকে মৃত্যুর দিকে নিয়ে গেছে, আমাদের চোখের সামনে। আমরা চোখ থাকতেও খেয়াল করে দেখিনি। নদী, খাল-বিল, জলাশয়, পাহাড়, বন-বৃক্ষকে রক্ষা না করে আমরা যে অপরিকল্পিত নগর গড়ে তুলেছি তা আজ বসবাস অনুপযোগী, অস্বাস্থ্যকর, দমবন্ধ নগরীতে পরিণত হয়েছে। এই যে নদী-নালা, খাল-বিল-জলাশয় দখল এবং দূষণ করে আমরা কলকারখানা, সুউচ্চ বহুতল ভবন নির্মাণ করে চলছি, এটা তো বসবাসের ফ্লাট নয়, একেকটা মৃত্যুর ফাঁদ। আটকে যাওয়া জীবন। এই নগরের যতটুকু রস-তস, গল্প ছিল- আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শহীদুল জহির, হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন, মঈনুল আহসান সাবের, জাকির তালুকদার, মামুন হোসাইন, শাহাদুজ্জামান, আহমাদ মোস্তফা কামাল, শাহীন আক্তার, প্রশান্ত মৃধা, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম প্রমুখ নিংড়ে রেখে গেছেন। এই নাগরিক মধ্যবিত্ত জীবনের মধ্যে নতুন রস আস্বাদনের কিছু বাকী নেই। পাশ্চাত্য আধুনিকতার শুষ্ক জমিনে সাহিত্যের চাষবাস করা মানে নিষ্ফলা মাঠের কৃষকের আর্তনাদ ছাড়া কিছু নয়। ভাঙা হাটে পোকা খাওয়া বেগুন নিয়ে ক্রেতার অপেক্ষায় থাকে কোন বোকা?

এখন সাহিত্যের নতুন চিন্তা, নিউ ন্যারেটিভস্‌ তৈরি করতে হলে আমাদেরকে হারিয়ে যাওয়া নদী আর সজীব প্রকৃতির কাছে হাত পাততে হবে। এই পথই আমাদের সাহিত্যের নতুন আকাশের সন্ধান দিতে পারে। সম্ভাবনার নতুন দুয়ার খুলে দিতে পারে বলে আমার বিশ্বাস।
ইউরোপ-আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্য বিভাগগুলোতে এখন আর সাহিত্য পড়ানো হয় না। এই খবরটা অনেকের কাছে আজগবী সংবাদ মনে হতে পারে কিন্তু এটাই সত্য। ওখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর শ্রেণিতে শেকসপয়ির, মিল্টন, ক্যামু, বোদলেয়ারের পরিবর্তে ছাত্রছাত্রীদের এখন পড়ানো হয় পল দা মানের দি রেটোরিক অব টেম্পরালেটি (১৯৬৯)। সাহিত্যের বদলে সেখানে এখন পড়ানো হয় ‘তত্ত্ব’। যে রাজ যজ্ঞকে আমরা ‘তত্ত্ব’ বলছি, সেটা ক্ষেপণাস্ত্রের মতো সাহিত্য বিনাশী, সাহিত্যের মৃত্যু, সাহিত্যের অগস্ত্যযাত্রার আয়োজন ছাড়া আর কিছু নয়। শেকসপয়ির, মিল্টন, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কোলরিজ, রবীন্দ্রনাথ, বিভূিতভূষণের পথের পাঁচালী’র অপু কিংবা অরণ্যকের সত্যচরণের রোমান্টিক বিষন্নতা আমার এবং আমাদের কাছে যে যাপিত জীবনের অংশই মনে হয়, সেই বস্তুকেই আক্রমণের লক্ষ্য করা হয়েছে। সাহিত্য বলতে সেই অবিমিশ্র তপস্যালব্ধ সনাতন বস্তুকেই আমরা বুঝি।
সাম্প্রতিক বাংলাদেশেও এ্যাকাডেমিক জার্নালগুলো তত্ত্ব-নিয়ন্ত্রিত এবং পশ্চিমা পুত্তলিকার অনুভুতিশূন্য, ইমেজ পূজারি হয়ে উঠছে। মূল বিষয়টা আরও খোলাসা করে বলা দরকার। বিংশ শতাব্দীর সত্তর-আশির দশকে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি এবং অন্যান্য বিভাগে সাহিত্য-বিদ্বেষী এক প্রপাগাণ্ডা শুরু হয়। পল দা মানের নেতৃত্বে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজাত তাত্ত্বিকরা নিরব অভ্যুত্থান শুরু করেন। ক্রমেই সাহিত্যবিভাগ ছাড়িয়ে ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, ফোকলোরসহ অন্যান্য মানববিদ্যার শাখাগুলোও এই তত্ত্ব-চিন্তার শিকার হয়। শিল্প-সাহিত্যের যে যুগ-যুগ ধরে অনুশীলিত সৌন্দর্র্যসৃষ্টির পরম্পরা, ঐতিহ্য, উৎকর্ষের অমূল্য উত্তরাধিকার, তাকে মূল্যহীন, বাতিল, তামাশার বস্তু করে তোলাই ওই তাত্ত্বিক আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ছিলো। কিন্তু সাধারণ পাঠক তো বটে, এমন কি বিদগ্ধ ব্যক্তির পক্ষেও ‘তত্ত্বের’ আক্রমণ,তত্ত্বের সংক্রমণ আন্দাজ করা কঠিন। তা নাহলে ফ্রাঙ্ক লিনট্রেকিয়ার মতো জাঁদরেল সমালোচক আফটার দি নিউ ক্রিটিসিজম (১৯৮০) বইটি লেখার সময় তাত্ত্বিকদের সাহিত্যবিরোধেী তৎপরতাকে ‘সাহিত্য-সমালোচনা’ বলে ভুল করতেন না। লিনট্রেকিয়ার বোধোদয় হতে সময় লাগে এবং স্মৃতিকথায় দি এইজ অব দি নাইট (১৯৯৪) গ্রন্থে সেই সময় সাহিত্যের শত্রুপক্ষকে চিনতে না পারা এবং বন্ধুত্বের খাতিরে সত্য-উচ্চারণ করতে না পারার গ্লানির কথা অকপটে স্বীকার করেছেন। সাহিত্য-সমালোচকরা প্রথমে সাহিত্যে মূল্য স্বীকার করে কিন্তু ফরাসি তাত্ত্বিকরা তো সাহিত্যের মূল্যই বিশ্বাস করে না। কোনও ব্যক্তি কোনও বস্তুর বিশ্বাসী হলে, সেই ব্যক্তি কর্তৃক সেই বস্তুর ভালো-মন্দ মূল্যায়নের প্রশ্ন আসে। তাত্ত্বিকদের ক্ষেত্রে সে প্রশ্ন আসে না, যেমন হাইডেগারের বিইং এন্ড টাইম (১৯২৭) পল দা মানের ব্লাইন্ডনেস অ্যান্ড ইনসাইট (১৯৭১) জাঁক দেরিদার ডিকনস্ট্রাকশন সাহিত্য নয়, তত্ত্ব। এটা বুঝতে সাহিত্যমনস্ক ব্যক্তির পক্ষেও সহজ নয়। যেমন লিনট্রেয়িার বই পড়লে মনে হবে ‘তাত্ত্বিকতা’ এবং ‘সাহিত্য-সমালোচনা’ বুঝি একই বস্তু। আসলে কী তাই? কেমব্রিজের টেরি ইগলটন ‘ডিকনস্ট্রাকশন’ থিউরির ওপর বেশ চটা, ডিকনস্ট্রাকশনের তাত্ত্বিকতায় অনাগ্রহী হলেও ইগলটনের পরিচয় মার্কসবাদী তাত্ত্বিক হিসেবেই। তার লেখা বই লিটারারি থিওরি (১৯৮৩) ফরাসি তত্ত্বের আবেষ্টনে, অন্তর্গত প্রেরণায় রচিত হলেও সেখানে ‘সাহিত্য’ ‘ইতিহাস’ ‘দর্শন’ সম্পর্কে মার্কিন তাত্ত্বিকদের মধ্যস্থতায় পোস্ট-স্টাকচারাল দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত। যদিও ইগলটন ও অন্যান্যরা পরবর্তীকালে ডিকনস্ট্রাকশনের বিরোধিতা করেন। এবং অন্তঃসারশূন্য ডিকনস্ট্রাকশনের তত্ত্ব বাদ দিয়ে সাহিত্যকে মানবিক মূল্যবোধের জায়গা থেকে বিচার করেন। মোটকথা, ক্লদ লেভি-স্ত্রোসের ‘স্ট্রাকচারালিজম’ দুরূহ বটে, তা দ্বারা যে কোনো কিছুকে বিশ্লেষণ করা যায় এবং ‘স্ট্রাকচারালিজম’ পদ্ধতি হিসেবে বৈজ্ঞানিক। যেমন- সনেট লেখার নিয়ম জানলেই ‘সোনালি কাবিন’ লেখা যায় না।
মাত্রাবৃত্তের মাত্রা সবাই গুণতে জানে কিন্তু ‘ঘোড়সওয়ার’ সৃষ্টি করতে হলে প্রতিভা থাকতে হয়, কল্পনাকে ব্যবহার করার দক্ষতা অর্জন করতে হয়, নচেৎ ওরকম সৃষ্টি সম্ভব নয়। ‘স্ট্রাকচারালিজমের’ লক্ষ্য ছিলো নির্মাণ, অন্যদিকে জাঁক দেরিদার ‘ডিকনস্ট্রাকশন’-এ ঘোষিত উদ্দেশ্য হচ্ছে ভাঙা। সৃষ্টি ও ভাঙা, দুটোর মধ্যে কোনটি সোজা, কোনটি ভালো, সেটা খোকাখুকুরাও বোঝে। সমকালীন বাংলাদেশের উপন্যাস, সমাজের বিদ্যমান অসাম্য, রাজনৈতিক হেজিমোনি, কর্তৃত্ববাদ, ধর্মীয় গোঁড়ামী সম্বন্ধে প্রায় নিঃশব্দ। অথচ পোস্টমডার্নিজম, ম্যাজিকরিয়ালিজম ইত্যাদি তত্ত্ব ও পশ্চিমা বুর্জোয়া সমাজের উৎপাদিত চেতনা নিয়ে আমাদের লেখকরা মহাব্যস্ত। আমাদের কবিতা ব্যক্তিসর্বস্ব, ব্যক্তিক অনুভুতির গর্তের মধ্যে নিমজ্জিত। নাগরিক মধ্যবিত্ত শ্রেণির রোমান্টিক জীবনের মধ্যে সীমাবদ্ধ। সমকালীন কবিতা গণমানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হতে এখন প্রায় নিঃস্ব, জনবিচ্ছিন্ন, গরীব শিল্প মাধ্যমে পণিত হয়েছে। অথচ বাংলা কবিতার আধুনিক-পূর্ব দীর্ঘ ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, কবিতা হচ্ছে গণমানুষের যাপিত জীবনের উজ্জ্বল কণ্ঠস্বর। পরিতাপের বিষয় যে, সমকালীন সাহিত্যে গণমানুষ, প্রান্তিক মানুষ হজির নেই। বৃহত্তরসমাজ ও ব্যক্তি-মানুষের ক্রাইসিস, কৃষক-শ্রমজীবী সাধারণ মানুষের বাস্তব জীবন সমকালীন গল্প-উপন্যাসে-কবিতায় ব্যাপকভাবে উপেক্ষিত, অবহেলিত। অথচ ‘সাহিত্যে নিম্নবর্গ’ শিরোনামে হাজার হাজার পৃষ্ঠা গবেষণাপত্র রচিত হচ্ছে। সমকালীন সাহিত্যের এসব অসুখ-বিসুখ দেখলে, চুপ করে বসে থাকা সত্যি মুশকিল হয়। আমাদেরকে পশ্চিমা চিন্তার আরোপন, তত্ত্বের নিয়ন্ত্রণ, তত্ত্বের আগ্রাসন থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। গুরুত্ব দিতে হবে গণমানুষের যাপিত জীবন, রাজনীতি, অর্থনীতি ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে। কলোনিয়াল কাঠামো থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। নির্মাণ করতে হবে আমাদের সাহিত্যের নতুন পাঠ ও তাৎপর্য। সেটা কলোনিয়াল মাইন্ডসেট দিয়ে সম্ভব নয়, পোস্ট-কলোনিয়াল আর্গুমেন্ট আর উত্তর-ঔপনিবেশিক ক্ষুরধার, প্রবুদ্ধ দৃষ্টিকোণ দ্বারাই সম্ভব।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবর্ষায় কেটেছে দিন
পরবর্তী নিবন্ধসিএসইতে সেরা ট্রেক হোল্ডারদের পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান