সবুজ গম্বুজের ছায়ায় কী মায়া : নবী করিম (সা.) এর রওজা মোবারক

ফখরুল ইসলাম নোমানী | শুক্রবার , ২৭ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৯:১৯ পূর্বাহ্ণ

মুসলিম উম্মাহর হৃদয়ের স্পন্দন মদিনাতুল মুনাওয়ারা। যারা মদিনার প্রেমে আত্মহারা তাঁদের জন্য মদিনার প্রতিটি স্থানের জন্যই রয়েছে হৃদয়ের সীমাহীন ভালোবাসা। আর যদি সে স্থানটি যদি হয় মসজিদে নববীর ভেতরের দৃশ্য। তাহলে তো কথাই নেই।

 

মদিনা মুসলমানদের তীর্থস্থান, ভালোবাসার নিকুঞ্জ, আবেগের সৌধশিখর। কারণ পবিত্র এ ভূমিতেই জীবনের মূল্যবান ১০টি বছর কাটিয়েছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব হজরত মুহাম্মদ (সা.)। শুয়েও আছেন এই ভূমির কোলে নীরবে নিভৃতে। মসজিদে নববীর দক্ষিণপশ্চিম কোণে সবুজ গম্বুজের ছায়াতলে প্রিয়নবীর (সা.)-রওজার অবস্থান।

মদিনার মসজিদে নববী। মসজিদে নববীর সবুজ গম্বুজ। মসজিদে নববীর সবাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ স্থান হলো রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর রওজা মোবারক। উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা (রা.)-এর হুজরার (কামরা) মধ্যে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পবিত্র রওজা মোবারক অবস্থিত। হজ ও ওমরা পালনকারীদের মদিনা যাওয়ার একমাত্র উদ্দেশ্য হলোনবী করিম (সা.)-এর রওজা মোবারক জিয়ারত করা, রওজায় সালাম পেশ করা। রাসূল (সা.) এর রওজার পাশে ইসলামের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) ও ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর কবর। পাশে আরেকটি কবরের জায়গা খালি। এখানে হজরত ঈসা (.)-এর কবর হবে।

রাসূল (সা.)-ইরশাদ করেছেন যে আমার রওজা জিয়ারত করলো তার জন্য আমার সুপারিশ ওয়াজিব হয়ে গেলোসহিহ মুসলিম। রাসূলুল্লাহ (সা.) আরো বলেন, যে হজ করলো কিন্তু আমার রওজা জিয়ারত করলো না ; সে আমার প্রতি জুলুম করলো।সুনানে তিরমিজি

মক্কার কাবা হল মানবপ্রেমের উৎস বা পাওয়ার হাউস। আর সেই পাওয়ার হাউসের সুইচ মদিনার গম্বুজে খাজ্বরা বা সবুজ গম্বুজ। সেখানে কী আকর্ষণ তা আশেক মাত্রই জানেন। সবুজ গম্বুজের ছায়ায় কী মজা যারা সেখানে বসেন তারাই জানেন। রমজানে আসরের পর থেকে ইফতারির দস্তরখানা বিছানো হয়। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য সবুজ গম্বুজের পূর্বপার্শ্বে বাবে বেলালে কোনো দস্তরখানা বিছানো হয় না।

কারণ হল বেলালের উত্তরসূরি আশেকে রাসূলরা এখানে বসে থাকে ইফতারি আশায় নয় নবীর প্রেমের আশায়। ঠিক ইফতারির আগ মুহূর্তে হাতে হাতে ইফতারি দিয়ে দেয় নবীপ্রেমিকগণ।

মসজিদে নববীর আশপাশটা যেন জান্নাত। সব সময় ভালো লাগার একটা আবেশ বিরাজ করে চারপাশে। মানুষগুলোর হৃদয়ও বেশ কোমল। হজে গিয়ে সবুজ গম্বুজটি দেখলেই হাজি সাহেবদের মনে বইতে থাকে আনন্দের ফল্‌গুধারা। আবেগের অশ্রু প্রবাহিত হয় দু’চোখ ছাপিয়ে। উদ্বেলিত হৃদয়ে তাঁরা সালাম পেশ করেন রওজা পাকে। সাহাবায়ে কেরাম (রা.) থেকে আজ পর্যন্ত প্রত্যেক মুমিনের হৃদয়ে সবুজ গম্বুজকে ঘিরে রয়েছে ভালোবাসা আর গভীর আবেগ। তাইতো তা দর্শনের জন্য প্রতিনিয়ত ব্যাকুল থাকে মুমিনের হৃদয়।

মসজিদে নববীতে প্রবেশের অনেকগুলো দরজা রয়েছে। এর মধ্যে পশ্চিম পাশে রাসূলের রওজা জিয়ারতের জন্য যে দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে হয় ওই দরজাকে বাবুস সালাম বলা হয়। বাবুস সালাম দিয়ে প্রবেশ করে রাসূলের রওজায় সালাম শেষে বাবুল বাকি দিয়ে বের হতে হয়।

রাওজাতুম মিন রিয়াজিল জান্নাহ : মদিনায় জিয়ারতে হাজিদের জন্য সৌভাগ্যের বিষয়। মদিনায় এসে দুনিয়ায় জীবিত থাকতে জান্নাতে ভ্রমণের সুযোগ মেলে। কারণ নবী করিম (সা.)-এর রওজা শরিফ এবং এর থেকে পশ্চিম দিকে রাসূলে করিম (সা.)-এর মিম্বর পর্যন্ত স্বল্প পরিসরের স্থানটুকুকে রিয়াজুল জান্নাত বা বেহেশতের বাগিচা বলা হয়। এটি দুনিয়াতে একমাত্র জান্নাতের অংশ।

এই স্থানে স্বতন্ত্র রঙয়ের কার্পেট বিছানো। এই স্থানটুকু সম্পর্কে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আমার রওজা ও মিম্বরের মধ্যবর্তী স্থানে বেহেশতের একটি বাগিচা বিদ্যমান। এখানে প্রবেশ করা মানে জান্নাতে প্রবেশ করা। তৎপর্য ও মাহাত্ম্যের বিবেচনায় রিয়াজুল জান্নাত হলোদুনিয়ায় অবস্থিত জান্নাতের বাগানসমূহের একটি। তাই জিয়ারতকারীরা এখানে নামাজ আদায় ও দোয়ার জন্য ব্যাকুল থাকেন। এখানে একবার নামাজ আদায় বাইরে এক হাজার বার নামাজ আদায়ের সমতুল্য।

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ওফাত ও রওজার স্থান নির্ধারণ : নবী করিম (সা.) ১১ হিজরির ১২ রবিউল আউয়াল চাশতের সময় হজরত আয়েশা (রা.)-এর ঘরে তাঁরই কোলে মাথা রেখে ইন্তেকাল করেন। তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর। ইন্তেকালের পর সবার ঐকমত্যে হজরত আবু বকর (রা.)-কে পরবর্তী খলিফা নির্বাচন করা হয়। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে কোথায় দাফন করা হবে, তা নিয়ে সাহাবায়ে কেরাম (রা.)-এর মধ্যে মতভেদ দেখা দেয়।

কেউ বলেন, জান্নাতুল বাকিতে দাফন করা হোক, কেউ বলেন মসজিদে নববীতে দাফন করা হোক, আবার কেউ প্রস্তাব করলেন, হজরত ইবরাহিম (.)-এর পাশে সমাহিত করা হোক। এ অবস্থায় হজরত আবু বকর (রা.) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, নবীরা যেখানে মৃত্যুবরণ করেন সেখানেই সমাহিত হন। তাঁর এ কথা সবাই মেনে নেন এবং সবার ঐকমত্যে রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে হজরত আয়েশা (রা.)-এর হুজরায় যেখানে তিনি ইন্তেকাল করেন সেখানেই সমাহিত করা হয়।

রওজা জিয়ারতের গুরুত্ব ও ফজিলত : চার মাজহাবের প্রখ্যাত ইমামগণ এ বিষয়ে একমত যে নবীজি (সা.)-এর রওজা পাক জিয়ারতের নিয়ত করা মুস্তাহাব। কেউ কেউ ওয়াজিবও বলেছেন। হজরত ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত নবীজি (সা.) ইরশাদ করেছেন আমার ওফাতের পর যে আমার রওজা পাক জিয়ারত করল সে যেন জীবিত অবস্থায় আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করল।

(বায়হাকি: ৩৪১) নবীজি (সা.) আরো ইরশাদ করেন যে ব্যক্তি ইচ্ছা করে আমার রওজা জিয়ারত করবে কিয়ামতের দিন সে আমার প্রতিবেশী হবে। আর যে ব্যক্তি হারামে (পবিত্র) মক্কা অথবা হারামে (পবিত্র) মদিনায় ইন্তেকাল করবে সে কিয়ামতের দিন নিশ্চিন্তে থাকবে। (তাবরানি : ৪৭২) মানবতার পরম সহৃদ সবুজ গম্বুজের নিবিড় ছায়ায় শুয়ে আছেন।

এই সবুজ গম্বুজ পৃথিবীর প্রতিটি জনপদকে তীব্রভাবে আকর্ষণ করে। তাই তারা অকৃত্রিম ভালোবাসা ও প্রচণ্ড আবেগের টানে ছুটে আসে সবুজ গম্বুজের একটু ঘ্রাণ নেওয়ার জন্য। মদিনার সবচেয়ে বড় কাজ নবীজিকে সালাম দেয়া আর চল্লিশ ওয়াক্ত নামাজ তাকবিরে উলার সঙ্গে মসজিদে নববীতে আদায় করা।

পরিশেষে : আল্লাহতাআলার কাছে এই প্রার্থনা করি হে দয়াময় সৃষ্টিকর্তা! তুমি সকলকে প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রতি বেশি বেশি দরুদ ও সালাম পাঠানোর তৌফিক দিন। সকলেই পড়িআল্লাহুম্মা সাল্লে আলা সাইয়েদিনা মুহাম্মদ, ওয়ালা আলেহি ওয়া আসহাবিহি ওয়া সাল্লাম। আল্লাহ আমাদের সবাইকে মহানবীর (সা.) জীবনাদর্শ অনুসরণ করে চলার তৌফিক দান করুন। আমিন।

লেখক: ইসলামি চিন্তক ও গবেষক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক ও বর্তমান প্রেক্ষাপট
পরবর্তী নিবন্ধজুম’আর খুতবা