জুম’আর খুতবা

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ২৭ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৯:২২ পূর্বাহ্ণ

আল কুরআনের আলোকে উম্মুল মু’মিনীন’র মর্যাদা: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে বৈবাহিক সূত্রে দাম্পত্য জীবনে আবদ্ধ হওয়ার কারনে আল্লাহ তা’আলা নবী পত্নিগনকে মু’মিনদের সম্মানিত ‘মা’ হিসেবে ঘোষণা করে নবীজির ইন্তিকালের পর তাদের সাথে উম্মতের কোন ব্যক্তির বিবাহ করাকে হারাম ঘোষণা করেছেন।

 

এটা নবীজির শ্রেষ্ঠত্ব ও বিশেষত্ব। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “তোমাদের কারো পক্ষে আল্লাহর রাসূলকে কষ্ট দেয়া সঙ্গত নয় এবং তাঁর ইন্তিকালের পর তাঁর পত্নিদেরকে বিবাহ করা তোমাদের জন্য কখনো বৈধ নয়। আল্লাহর দৃষ্টিতে এটা বড়ই অপরাধ যদি তোমরা কোন বিষয় প্রকাশ কর অথবা গোপন রাখ আল্লাহ সর্ব বিষয়ে জ্ঞাত।” (সূরা: আহযাব: ৫৩)

উম্মুল মু’মিনীন হযরত খাদীজা বিনতে খুওয়াইলিদ (রা.)’র পরিচিতি: হযরত খাদীজা বিনতে খুওয়াইলিদ (রা.) ৫৫৫ খ্রি. মক্কার কুরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম খুওয়াইলিদ, মাতার নাম ফাতেমা বিনতে যায়েদা। তাঁর বংশধারা খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ ইবনে আসাদ ইবনে আবদুল উজ্জা ইবনে কুসাই। কুসাই পর্যন্ত পৌছে তাঁর বংশধারা রাসূলুল্লাহর বংশধারার সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে।

উপাধি: তাঁর উপাধি ছিল তাহেরা (পবিত্র) জাহেলী যুগেও তিনি সব ধরণের শির্ক ও মূর্তি পুজা থেকে পুত:পবিত্র ছিলেন।

সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণকারিণী: হযরত খাদিজা (রা.) ছিলেন সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ কারিণী মহিলা। তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রথম স্ত্রী, হাকীম ইবন হিযাম (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, বিবাহের সময় রাসূলুল্লাহর বয়স ছিল পঁচিশ বৎসর আর খাদীজা (রা.) বয়স ছিল চল্লিশ বৎসর। (সূত্র: আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খন্ড: ৫ম, পৃ: ৪র্থ)

নবীজির বহু বিবাহ আল্লাহর নির্দেশেই হয়েছিল: নবীজির জীবনের কোনো কর্ম আল্লাহর নির্দেশ ছাড়া সম্পাদিত হয়নি। নবিিজর বহু বিবাহ একাধিক স্ত্রী গ্রহণ, আল্লাহর নির্দেশে ইসলামের কল্যাণে, দ্বীনের সম্প্রসারণ ও বহুবিধ হিকমত ও তাৎপর্যের নিরিখে সংগঠিত হয়েছে। হাদীস শরীফে উল্লেখ হয়েছে, হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, না আমি নিজে বিবাহ করেছি এবং না স্বীয় কন্যাকে বিবাহ দিয়েছি যতক্ষণ পর্যন্ত হযরত জিবাঈল (🙂 ওহী নিয়ে আমার নিকট আগমন না করেছেন। ( সিরাতুল মুস্তফা, খন্ড: ৩য়, পৃ: ২৬০)

 

ব্যবসার সূত্রে নবীজির সাথে হযরত খাদীজা (রা.) পরিচয়: হযরত খাদীজা (রা.) ছিলেন আরবের প্রসিদ্ধ ধনাঢ্য মহিলা। মক্কার বিধবা ধনীবতি মহিলা হযরত খাদীজা (রা.) তাঁর ভূত্য মায়সারার মুখে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যিনি মক্কায় আল আমীন নামে খ্যাত, যাঁর সততা, ন্যায় পরায়নতা, বিশ্বস্ততা, আমানতদারিতা, উত্তম শিষ্টাচারিতা ও আদর্শিক গুণাবলীর কথা শুনে হযরত খাদীজা নবীজির প্রতি আকৃষ্ট হন।

এক পর্যায়ে রাসূলুল্লাহ কে সিরিয়ায় তার ব্যবসা পরিচালনার দায়িত্ব অর্পন করেন, নবীজির প্রতি ব্যবসা পরিচালনার দায়িত্বভার অর্পন করায় ব্যবসায় প্রচুর মুনাফা অর্জন করেন, এতে হযরত খাদীজা অত্যাধিক খুশী হন এবং নবীজির প্রতি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে আগ্রাহান্বিত হন। বিয়ের প্রস্তাব দেন, এতে নবীজির চাচা আবু তালিবের সম্মতিক্রমে হযরত খাদীজার (রা.) সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন।

মক্কার প্রতিষ্ঠিত বড় বড় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের হযরত খাদীজার প্রতি বিয়ের প্রস্তাব থাকা সত্বেও তিনি সব প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে নবীজি কে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করতে আগ্রহী হওয়া হযরত খাদীজা (রা.)’র জ্ঞানবুদ্ধি দূরদর্শিতা ও তাঁর উৎকৃষ্ট পবিত্রতার সুস্পষ্ট প্রমাণ।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত খাদীজা (রা.)’র সাথে দীর্ঘ পচিশ বছর সুখময় দাম্পত্যজীবন অতিবাহিত করেন। হযরত খাদীজা (রা.) পয়ষটি বৎসর বয়সে ইন্তিকাল করেছেন। তাঁর জীবদ্দশায় নবীজি অন্য কাউকে বিবাহ করেন নি। (ইবন হিশাম সীরাতুন্নবী, ৪র্থ খন্ড, পৃৃ: ৩১১)

হযরত খাদীজা (রা.)’র পিতা হযরত খুইয়ালিদ পূর্বেই ইন্তেকাল করেছেন, বিয়ের সময় তাঁর চাচা আমর ইবন আসদ উপস্থিত ছিলেন এতে তাঁর সম্মতি ছিল তিনি বিবাহে যোগদান করেন, নবীজির চাচা আবু তালিব হযরত হামযা (রা.) সহ বংশের সম্মানিত ব্যক্তিবর্গদের নিয়ে হযরত খাদীজা (রা.)’র বাড়ীতে গমন করেন। বিবাহে পাঁচশত দিরহাম মোহরানা নির্ধারণ করা হয়। (যারকানী, ৩য় খন্ড, পৃ: ২২১)

হযরত খাদীজা (রা.)’র ঘরে নবীজির সন্তান সন্তুতি: হযরত খাদীজা (রা.)’র ঘরে নবীজির সব সন্তান সন্তুতি জন্ম গ্রহণ করেছেন একমাত্র ইবরাহীম (রা.) ছাড়া। তিনি হযরত মারিয়ার গর্ভে অষ্টম হিজরির জিলহজ্ব মাসে মদীনায় জন্ম গ্রহণ করেন এবং আঠার মাস বা ষোল মাস বয়সে মদীনাায় তাঁর ইন্তিকাল হয়। (আল বিদায় ওয়ান নিহায়া, খন্ড: ৫ম, পৃ: ৪৯৭)

হযরত খাদীজার গর্ভে নবীজির চার কন্যা, হযরত যয়নব রুকাইয়া (রা.) হযরত উম্মে কুলসুম (রা.) ও ফাতেমা (রা.) এবং দুই পুত্র সন্তান জন্ম গ্রহণ করেন। (সীরাতুল মুস্তাফা, খন্ড: , পৃ: ২৬৬)

হযরত খাদীজার (রা.)’র জীবদ্দশায় নবীজি অন্য কাউকে শাদী করেননি: হাদীস বিশারদদের এক বর্ণনা মতে উম্মাহাতুল মু’মিনীনের সংখ্যা এগার জন। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পবিত্র বিবিগন হলেন হযরত খাদীজা (রা.), হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.), হযরত উম্মে মাসাকীন, (যয়নাব বিনতে খোযায়মাহ), হযরত জুয়ায়রিয়াহ (বিনতে হারিস) এবং হযরত সফিয়্যাহ রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুন্না। তাঁদের মধ্যে হযরত খাদীজা (রা.)’র জীবদ্দশায় নবীজি অন্য কাউকে শাদী করেন নি। (মিরআতুল মানাজীহ শরহে মিশকাতুল মাসাবীহ, খন্ড: ১ম, পৃ: ৩৪০)

উম্মাহাতুল মু’মিনীনদের জন্য বার্ষিক ভাতা মঞ্জুরী: আমিরুল মু’মিনীন হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর খিলাফতকালে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সহধর্মীণীদের প্রত্যেকের জন্য বার্ষিক বার হাজার মুদ্রা ভাতা মঞ্জুরী দিয়েছিলেন। (আল বিদায় ওয়ান নিহায়া, খন্ড: ৫ম, পৃ: ৪৮০)

হযরত খাদীজা (রা.)’র মর্যাদা: বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত হয়েছে, হযরত জিবরাঈল (.) নবীজির দরবারে এসে আরজ করলেন ইয়া রাসূলাল্লাহ! হযরত খাদীজা আপনার নিকট আগমন করছে যখন তিনি আপনার নিকট পৌঁছবেন, আপনি তাঁকে আল্লাহর পক্ষ থেকে ও আমার পক্ষ থেকে সালাম বলবেন, হযরত খাদীজা এ সুসংবাদ শুনে বললেন, নিশ্চয় আল্লাহ তা’আলা স্বয়ং সালাম। হে জিবরাইল আপনার উপর সালাম হে আল্লাহর রাসূল! আপনার উপর আল্লাহর পাকের শান্তি ও রহমত বর্ষিত হোক। (ফাতহুলবারী, খন্ড: ১ম, পৃ: ১০৫)

হযরত আবদুল্‌রাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, বিশ্ব জগতের নারীদের সরদার হলেন, হযরত মরিয়ম (🙂 অত:পর হযরত ফাতিমা (রা.) এরপর হযরত খাদীজা (রা.) অত:পর হযরত আসিয়া (রা.)( শরহে মাওয়াহিব, ৩য় খন্ড, পৃ: ২৩৩)

ইন্তিকাল: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র নবুয়তের দশম বছরে মদীনা মনোয়ারায় হিজরতের তিন বৎসর আগে হযরত খাদীজা (রা.) মক্কা মুআযযমায় ইন্তিকাল করেন, হাজ্জু নামক স্থানে জান্নাতুল মুআল্লায় তাঁকে দাফন করা হয়। নবীজি নিজে কবরে নেমে হযরত খাদীজার (রা.)’র দাফন কাজ সম্পন্ন করেন। জানাযা নামাযের বিধান তখনো অবতীর্ণ হয়নি।

জান্নাতুল মুআল্লাহ শরীফ কবরস্থানে মু’মিনদের ‘মা’ চির শায়িত আছেন। সংরক্ষিত কবরস্থানে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় তাঁর কবর শরীফ যিয়ারতের সুব্যবস্থা রয়েছে। বিশ্বের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মুসলমানরা হজ্ব ও ওমরা পালনকালে তাঁর যিয়ারত করার সৌভাগ্য লাভ করে নিজেদেরকে ধন্য করছেন। আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে উম্মাহাতুল মু’মিনীনদের আদর্শ অনুসরণ করার তাওফিক নসীব করুন।

লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসাএ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

মুহাম্মদ কায়কোবাদ সুমন

সুলতানপুর, রাউজান, চট্টগ্রাম।

প্রশ্ন: আত্মহত্যা কাকে বলে? আত্মহত্যা সম্পর্কে ইসলামী বিধান জানালে উপকৃত হব

উত্তর: আত্মহত্যা হচ্ছে ইচ্ছাকৃতভাবে আপন সত্বাকে হত্যা করা, এ প্রসঙ্গে আল মাওসুয়াতে উল্লেখ রয়েছে, “আত্মহত্যা হলো এমন ইচ্ছাকৃত কাজ যা মানুষ নিজকে ধ্বংশ করার কারণ হয়, আর আত্মহত্যার মতো অপরাধ সাধারণত হতাশার কারণে সংগঠিত হয়। আল্লাহ তা’আলা এ বিষয়ে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। এরশাদ হয়েছে, এবং তোমরা তোমাদের হাতে (নিজেদেরকে) ধ্বংশের দিকে নিক্ষেপ করোনা। (আল বাকারা: ১৯৫)

আল্লাহ তা’আলা আরো এরশাদ করেছেন, আর তোমরা নিজেদের কে হত্যা করো না। (সূরা: নিসা: :২৯)

আত্মহত্যা জগন্য অপরাধ, মহাপাপ, আত্মহত্যার শাস্তি অবধারিত। আত্মহত্যা হারাম, তার শাস্তি জাহান্নাম। হাদীস শরীফে হযরত সাবিত ইবন দাহহাক (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি দুনিয়াতে কোনো কিছু দ্বারা আত্মহত্যা করবে তাকে কিয়ামত দিবসে শাস্তি দেয়া হবে। (বুখারী , হাদীস : ১৩৬৩)

আত্মহত্যাকারীর জানাযা পড়ানো ও দাফন করা যাবে কিনা? এ প্রসঙ্গে বিভিন্নমত রয়েছে তবে ইমাম আবু হানিফা ও ইমাম মুহাম্মদ (.) এর মতানুসারে আত্মহত্যাকারীর জানাযা পড়া যাবে দাফন করা যাবে। (ফাতওয়ায়ে আলমগীরি, খন্ড:, পৃ: ১৬৩)

আত্মহত্যার মতো জগন্য কাজের প্রতি ঘৃণা ও ভয় প্রদর্শনের জন্য প্রসিদ্ধ আলেম ও খতীব এবং গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ তার জানাযায় অংশগ্রহণ না করা উচিত। (ফিকহ্‌র কিতাব সমূহ দ্রষ্টব্য)

পূর্ববর্তী নিবন্ধসবুজ গম্বুজের ছায়ায় কী মায়া : নবী করিম (সা.) এর রওজা মোবারক
পরবর্তী নিবন্ধবিবাহিত জীবনের স্বাদ