শৈশবের স্মৃতি গন্ধময় ঈদ এবং ভয়ঙ্কর ঈদযাত্রা

কাজী রুনু বিলকিস | শনিবার , ২২ মে, ২০২১ at ৬:২৯ পূর্বাহ্ণ

আমাদের ঈদের সাথে মিশে আছে স্মৃতি গন্ধময় শৈশব। সিয়ামের শেষ দিনে দল বেঁধে আমরা পশ্চিম পুকুর পাড়ে ঈদের চাঁদ খুঁজে বেড়াতাম। যে-আগে দেখতো সে ছিল মহাভাগ্যবান। ঈদের বাঁকা চাঁদের ঝিলিকে যেন খুশির বন্যা বয়ে যেতো। এতো আনন্দ! এতো আনন্দ ছোট বুকটা যেন উপচে পড়তো। নতুন জামা নতুন জুতো সাথে পাউডার স্নো, নেইল পলিশ! আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে। রেডিওর সাউন্ড বেড়ে যেতো বেজে চলতো, “ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ, আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানি তাগিদ”, মা ভাবীরা ব্যস্ত হয়ে পড়তেন ঈদের রান্নার যোগাড় করতে। তৈরি হতো নারিকেল, দুধ, ঘি, চিনি দিয়ে হাতে তৈরি সেমাই ব্যালুন। কি অপূর্ব স্বাদ ছিল মায়ের রান্না সেই হাতে বানানো সেমাইয়ের। ঈদের দিন সকালে উঠে যখন মায়ের মুখখানা দেখতাম, অনাবিল শান্তিতে মন ভরে যেতো।
সেই রান্নার সুবাস ছড়িয়ে পড়তো চারপাশে। জুতো, জামা মাথার কাছে রেখে ঘুমানোর চেষ্টা করতাম। উত্তেজনায় ঘুম আর আসতেই চাইতো না। ঈদের বড় আকর্ষণ ছিল “সালামী” ঈদের সালাম করলেই টাকা পাওয়া যেতো, এক টাকা, দু’টাকা। এভাবে হয়তো সর্বোচ্চ বিশ টাকা পর্যন্ত জমাতে পারতাম। মানুষের চাহিদা ছিল সামান্য, আনন্দটা ছিল বিশাল। ক্রমশঃ আনন্দটা কমে এলো বাজারটা বেড়ে গেলো, সিয়ামে আত্মশুদ্ধির ব্যাপারটা চুকে গিয়ে স্বার্থ বুদ্ধিটা বেড়ে গেলো, মানুষের মায়া মমতার ব্যাপারটা ঠিক আগের জায়গায় খুঁজে পাওয়া যায় না। দান খয়রাতেও রাজনীতি ঢুকে পড়লো আত্মপ্রদর্শনটা বড় হয়ে দাঁড়ালো। সিয়াম সাধনার অন্যতম বিষয় রোজা। রোজা কিন্তু শুধু উপবাস নয়-এই রোজা আত্মশুদ্ধি। পঞ্চইন্দ্রিয়ের সংযমও। কিন্তু এ বিষয়গুলো কেবল বাহ্যিক আচার-আচরণে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। এই পবিত্র মাসেও চলেছে নেতিবাচক খবরের সমারোহ।
এই বাংলায় ঈদ উৎসব সার্বজনীন হয়ে উঠার ইতিহাস খুব দীর্ঘদিনের নয়। ঈদ ছিল ক্ষমতাবান মানুষদের হাতে। মোগল আমলে আমীর ওমরাহদের বর্ণাঢ্য ঈদ শোভাযাত্রা ও দান খয়রাতের মধ্য দিয়ে ঈদ পালন করা হতো। এতে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ছিল না। ক্রমান্বয়ে আর্থিক, সামাজিক প্রেক্ষাপট বদলের সাথে সাথে ঈদ আমজনতার হয়ে উঠেছে। এখন ঈদ মানে তো বিরাট বাজার, বিশাল বিপণন। হাজার হাজার কোটি টাকার বিকিকিনি!
পর পর দুটো ঈদ করোনা আটকে দিলো! তারপরেও সাধারণ মানুষকে ঠেকায় কে? জীবনবাজি রেখে ঈদ করতেই হবে। মার্কেটে তিল ধরণের ঠাঁই ছিল না। বাজার শেষে ছুটলো গ্রামে। ঈদ যাত্রায় পিলে চমকে দেওয়ার মত দৃশ্য জাতি অবলোকন করেছে। আহা শিমুলিয়া ঘাট। সর্বংসহা নারীদেরও দেখেছি হাত-পা দিয়ে রশি আটকে ধরে বাদুর ঝুলা হয়ে ফেরিতে উঠতে। এতো এক অভাবনীয় দৃশ্য!
যায় যাবে এ প্রাণ যাক তবুও যেতে হবে! লকডাউন, স্বাস্থ্যবিধি সব চুলোয় যাক! যেতেই হবে! এ যেন অপ্রতিরোধ্য যাত্রা!
পা বাড়ালেই ভারত। হাসপাতাল ছাড়িয়ে রাস্তায় পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে রোগীর সংখ্যা। অঙিজেন-অঙিজেন করে মানুষ মরছে। ডাক্তার-রোগী সরকার সবাই দিশাহীন। সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। অনেকের মতে কুম্ভমেলা ও নির্বাচনী সমাবেশই এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী। এসবের মাশুল দিচ্ছে ভারত। তাহলে এই অভাবনীয় ঈদযাত্রার মাশুল কি গুণতে হবে আমাদেরও। সারাবিশ্বে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ানো করোনার চারটি ভেরিয়েন্ট ইতিমধ্যেই বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশে ২০০ জন কোভিড রোগীর নমুনার জিনোম সিকোরেন্সিং করে চারটি ভেরিয়েন্টের উপস্থিতি পাওয়া গেছে বলে নিশ্চিত করেছে জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট।
স্বাস্থ্যবিধি না মেনে মানুষ যেভাবে এক জেলা থেকে আর এক জেলায় ছুটে যাচ্ছে তাতে ঈদের পরবর্তী সময়ে নেপাল ও ভারতের মত পরিস্থিতি যদি হয় তার দায় কে নেবে? বিশেষজ্ঞ ডাক্তারেরা বলছেন, টিকা সংকট, স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা ও ভারতীয় ভ্যারিযেন্ট পাওয়া সব মিলিয়ে ভীষণ উদ্বেগের ব্যাপার। এই ভেরিয়েন্ট অনেক বেশি দ্রুত ছড়াতে সক্ষম। ভারতের প্রায় বিশ শতাংশ মানুষ এ ভেরিয়েন্টে আক্রান্ত।
লকডাউনের মধ্যে ঈদ উদযাপনের জন্য বিপুল সংখ্যক মানুষ যেভাবে স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে দলে দলে বাড়ি গেছে তারা একইভাবে ফিরে এসে সংক্রমণ ছড়াতে পারে।
আহা ঈদ! এমন ঈদ উদযাপন আমাদের জন্য কি নিয়ে আসছে জানি না। নিত্যদিনের ঠাসবুনট থেকে মুক্তি পেতেই হয়তো নাড়ির টান অনুভব করেছে মানুষ।
হয়তো মায়ের কাছে, বাবার কাছে অথবা স্ত্রী সন্তানের কাছে ফেরার তাগিদ জীবনের মায়া তুচ্ছ মনে হয়েছে। হয়তো সমস্ত চরাচর ঘুমিয়ে, শুধু মা একা জেগে আছে খোকা এলো বলে! হয়তো বা এমন অনুভূতিও কাউকে কাউকে অস্থির করে তুলেছিলো। এই অন্ধকার কেটে যাক মানুষ যেন আগামী ঈদটা স্বস্তি ও শান্তির সাথে করতে পারে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমানুষের মাঝে স্বর্গ ও নরক
পরবর্তী নিবন্ধশুলকবহরে ফ্রি অক্সিজেন ও স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচি উদ্বোধন